বর্ণোজ্জ্বল: রাজপথে জনজোয়ার। প্রিয় দলের পতাকা হাতে ইস্টবেঙ্গল ভক্তদের প্রাণোচ্ছল পদযাত্রায় রবিবার সূচনা হল শতবর্ষের। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক
একশো ঢাকির বোলে শতবর্ষের বোধন হয়ে গেল ইস্টবেঙ্গলের।
ক্যালেন্ডারে দুর্গাপুজোর এখনও আটষট্টি দিন বাকি। তার অনেক আগেই রবিবার সকাল থেকে দুপুর— শঙ্খধ্বনি, ঢাক, ব্যান্ডের সুরেলা তালে শহর কলকাতার পথে হঠাৎ-ই পুজো পুজো গন্ধ। উত্তর কলকাতার কুমোরটুলি পার্কে ক্লাবের ধাত্রীগৃহ থেকে ময়দানের লাল-হলুদ তাঁবুতে ‘মশাল মিছিল’ পৌঁছতে সময় লাগল প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা। ক্লাব তাঁবুর লনে সুভাষ ভৌমিক, ভাইচুং ভুটিয়ারা যখন মশাল হাতে নিচ্ছেন, তখন মিছিলের লেজ সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউতে।
মোহনবাগান, মহমেডান, কুমোরটুলি-সহ বাঙালিয়ানায় মোড়া সাতটি ক্লাবের শতবর্ষের উদযাপন হয়েছে ময়দানে। বহু অনুষ্ঠান বা ম্যাচ হয়েছে তা ঘিরে। কিন্তু আবেগের বিস্ফোরণ আর উচ্ছ্বাসে ভেসে যাওয়া এ রকম মিছিল কখনও দেখা যায়নি। যেখানে ক্লাবের সমস্ত প্রজন্মের ফুটবলাররাই শুধু নন, ক্রিকেটার, অ্যাথলিট, হকি খেলোয়াড়রাও হাজির মিছিলে। ছিলেন কয়েকশো মহিলা সমর্থকও। বর্ণময় মিছিলে প্রায় প্রত্যেকেই পরে এসেছিলেন ‘স্পর্ধার শতবর্ষ’ লেখা লাল-হলুদ জার্সি। মেয়েদের অনেকেই পরেছিলেন ক্লাবের জার্সির রঙের শাড়ি। প্রবল গরমেও উচ্ছ্বাসে ভাসতে থাকা দেবপ্রিয়া গুহ বলছিলেন, ‘‘পুজোর ঠাকুর দেখতেও কখনও সাত কিলোমিটার হাঁটিনি। জীবনে কখনও মিছিলে পা-ও মেলাইনি। কিন্তু এই মিছিলটা তো আমার ক্লাবের।’’
গাড়ি, বাইক নিয়ে এসেছিলেন সমর্থকেরা। লাল-হলুদ পতাকা আর বেলুনে মোড়া সাতটি ট্যাবলো, কুড়িটি ঘোড়ার গাড়ি, দু’শো ফুট লম্বা পতাকা—কি ছিল না মিছিলে! বিধানসরণী, সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ ছেয়ে গিয়েছিল লাল-হলুদ পতাকায়। বিভিন্ন ফ্যানস ক্লাবের সদস্যরা ব্যান্ড বাজিয়ে নানা ধরনের গান গাইছিলেন হ্যান্ড মাইকে। আর অনুষ্ঠান অন্য মাত্রায় পৌঁছেছিল দুই কট্টর মোহনবাগানীর উপস্থিতিতে—প্রাক্তন রাজ্যপাল শ্যামলকুমার সেন ও ডেপুটি মেয়র অতীন ঘোষ ছিলেন মঞ্চে। শতবর্ষের মিছিলে কত মানুষ পা মিলিয়েছিলেন? ক্লাবের শীর্ষ কর্তা দেবব্রত সরকার বললেন, ‘‘পুলিশ আমাকে বলেছে ষাট হাজার মানুষ হেঁটেছেন মিছিলে। সংখ্যাটা বড় কথা নয়। আবেগের টানে এত মানুষ এসেছেন এটাই বড় ব্যাপার।’’ আর মিছিল শেষে গেটের মুখে দলের ম্যানেজার ও কর্মসমিতির সদস্য দেবরাজ চৌধুরীর মন্তব্য, ‘‘ইস্টবেঙ্গল সমর্থকরা কতটা স্পর্ধা দেখাতে পারেন তা বুঝিয়ে দিয়েছেন।’’
আরও পড়ুন: লাল-হলুদ প্রশাসনে আসতে আগ্রহী ভাইচুং
কুমোরটুলি পার্কে শতবর্ষের প্রদীপ জ্বালানোর সময়ও যেন ফিরে এল পুরানো স্মৃতি। ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত সুরেশচন্দ্র চৌধুরীর ছেলে অমরেশ চৌধুরী এবং মেয়ে সঞ্জনা চৌধুরীর সঙ্গে সেখানে হাজির মোহনবাগানের গোষ্ঠ পালের ছেলে নিরাংশু। লন্ডনে থাকেন সঞ্জনা—বাবার হাতে গড়া ক্লাবের গৌরবের দিনে শামিল হতে এসেছেন। মিছিলে হাঁটতে হাঁটতে বলছিলেন, ‘‘ক্লাবের আমন্ত্রণ পেয়ে চলে এসেছি। আমাদের বাড়ি তো লাল-হলুদের সমর্থক। ছোটবেলা থেকে তাই আমিও ইস্টবেঙ্গল সমর্থক হয়ে বড় হয়েছি।’’ মদনমোহনতলায় ১৯২০ সালে যে বাড়িতে ইস্টবেঙ্গলের প্রতিষ্ঠা, সেই চৌধুরী বাড়িতে শতবাষির্কী বিশেষ ফলকের উন্মোচন করলেন ক্রীড়ামন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস। ছিলেন আইএফএ প্রেসিডেন্ট অজিত বন্দ্যোপাধ্যায়ও। মশাল প্রজ্জ্বলনের সময় মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য, ভাস্কর গঙ্গোপাধ্যায়, সুকুমার সমাজপতির পাশে দাঁড়িয়ে ভাইচুং-ও আবেগে স্লোগান দিয়ে উঠলেন, ‘‘আমার বুকে?’’ উপচে পড়া পার্কের জনতা উত্তর দিল, ‘‘ইস্টবেঙ্গল!’’
সকাল থেকেই শহরের বিভিন্ন জায়গা থেকে কুমোরটুলি পার্কে চলে এসেছিলেন সমর্থকরা। কাতারে কাতারে। বাসে, লরিতে, মেট্রোয়। সুকুমার-মনোরঞ্জন-ভাস্কর-ভাইচুং ভুটিয়ারা ছাড়াও বিভিন্ন প্রজন্মের বহু ফুটবলার ছিলেন অনুষ্ঠানে। তরুণ দে, স্বপন সেনগুপ্ত, বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য, বিকাশ পাঁজি, মিহির বসু, অমিত ভদ্র, শিশির ঘোষ, কল্যাণ চৌবে, স্বরূপ দাশ, চন্দন দাশ, অ্যালভিটো ডি’কুনহা অনীত ঘোষরা অনুষ্ঠানে ছিলেন। ক্রিকেটারদের মধ্যে উৎপল চট্টোপাধ্যায়, শিবশঙ্কর পাল, ইশান্ত পোড়েল এসেছিলেন। ক্লাবের সব বিভাগের জুনিয়র দলের খেলোয়াড়রা এলেও দেখা যায়নি সিনিয়র দলের কোনও ফুটবলারকে। আসেননি কোচ আলেসান্দ্রো মেনেন্দেস। সবাই পয়লা অগস্টের মঞ্চে উপস্থিত থাকবেন।