ডার্বি ড্র করে লিগ জয়ের পরে চলল হুল্লোড়। চুলোভা, ব্রেন্ডন, রালতে। ছবি: বিশ্বরূপ বসাক
ফেন্সিং টপকে দলে দলে ঢুকে পড়ছেন লাল-হলুদ সমর্থকরা। গ্যালারিতে টানা বাজতে থাকা ঢাকের বাদ্যির সঙ্গে নাচতে নাচতে।
কারও হাতে জ্বলন্ত মশাল, কারও হাত আবিরে রাঙানো। কেউ আবার মুঠোর আবির নিয়ে লুটিয়ে পড়ছেন আল আমনা, মহম্মদ রফিকদের পায়ে। লাঠি নিয়ে তেড়ে যাচ্ছে পুলিশ, কলার ধরে টানতে টানতে বের করে দিচ্ছে শৃঙ্খলা বজায় রাখতে। কিন্তু কোনও কিছুই তাতে আটকাচ্ছে না।
হবে না-ই বা কেন? ইতিহাস তৈরির দিন! টানা আটবার কলকাতা লিগ জয়। এই খেতাব জেতাটা অনেক দিনই অভ্যেস করে ফেলেছে মশালবাহিনী। কিন্তু লিগের দীর্ঘ একশো বছরের ইতিহাসে যা করতে পারেনি কোনও ক্লাব, সেই দুর্লভ সম্মান প্রাপ্তি। উচ্ছ্বাসটা তো একটু বেশি হবেই। সেটা বাঁধনহারা হল আরও দু’টো কারণে। এক) মোহনবাগানের সঙ্গে দু’দুবার পিছিয়ে পড়েও প্রত্যাশিত লক্ষ্যে পৌছনো। দুই) রবিবাসরীয় হাই ভোল্টেজ ডার্বিটা এত নাটকীয়ভাবে শেষ হয়েছিল বলে। সদস্য-সমর্থকদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে উৎসবে মাতলেন ফুটবলাররাও। যে যেমন পারেন।
মহম্মদ রফিক ঘামে ভেজা জার্সিটা শরীর থেকে খুলে মাটিতে রেখে তাতে প্রণাম করছেন আর বুকে চাপড় মারছেন নাগাড়ে। আল আমনা, উইলিস প্লাজা-রা গ্যালারির উৎসবে মাতোয়ারা সমর্থকদের কাছে গিয়ে মাথায় লাল আবির মাখছেন হাসতে হাসতে। চুলোভা, রালতে-রা একে অন্যের ঘাড়ে উঠে নাচছেন পাহাড়ি নাচ। টানা আটবার খেতাব জেতার একমাত্র সাক্ষী গুরবিন্দর সিংহ নাচছেন ভাঙড়া। কিন্তু তিনি কোথায়? কোচ খালিদ জামিল?
রেফারি রঞ্জিত বক্সী ম্যাচ শেষের বাঁশি বাজাতেই আকাশের দিকে তাকালেন খালিদ। তারপর হাঁটু মুড়ে বসে পড়লেন মাটিতে। রিজার্ভ বেঞ্চের ফুটবলারদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে হনহন করে ঢুকে পড়লেন উৎসবের মঞ্চে। সব ফুটবলারকে ডাকলেন। নির্দেশ দিলেন, গ্যালারির সামনে গিয়ে সমর্থকদের অভিনন্দন জানিয়ে আসতে।
তারপর পুরো ব্রিগেডকে নিয়ে লাল-হলুদের নতুন কোচ ঢুকে গেলেন ড্রেসিংরুমে। সেখানে ফের হল উৎসব। শ্যাম্পেনের কায়দায় জল ছেঁটানো। খালিদ দাঁড়িয়ে সেটা উপভোগও করলেন। তারপর বেরিয়ে এসে বললেন, ‘‘খুব চাপে ছিলাম। ইতিহাস নিয়ে মাথাব্যথা ছিল না। রেজাল্টটা দরকার ছিল।’’ মুখে হালকা হাসি। উচ্ছ্বাসের লেশ মাত্র নেই। ‘‘শুরুটা ভাল হয়েছিল। শেষটাও। কলকাতায় আসার পর একটা ট্রফি চেয়েছিলাম। কঠিন ম্যাচ থেকে পয়েন্ট পেয়ে ট্রফি পেলাম,’’ বলে থামলেন তিনি।
তারপর মেনে নিলেন এ দিনের ডার্বিতে ভাগ্যের সাহায্য পেয়েছেন। মন্তব্য করলেন, ‘‘ভাগ্যের জোরে আজ পয়েন্ট পেয়ে লিগ জিতেছি। কিন্তু ভাগ্য তো সাহসীদের সঙ্গ দেয়। পজিটিভ রেজাল্ট চেয়েছিলাম। সেটাই হয়েছে।’’ সংযত, ধীর স্থির। জানালেন, পরের লক্ষ্য আই লিগ। ‘‘ওটা অনেকদিন আসেনি। চেষ্টা করতে হবে। দেখি কী করা যায়।’’
কোচ সংযত থাকলেও অন্যরা ছিলেন বাঁধনহারা। আল আমনা যেমন বললেন, ‘‘কলকাতায় এসে বলেছিলাম, ট্রফি জিততে চাই। সেটা হল। ম্যাচটা একসময় আমাদের হাতের বাইরে চলে যাচ্ছিল। কিন্তু সেটা হতে দিইনি। চাপের মধ্যেও ড্র করতে পেরেছি।’’ তাঁর পেনাল্টি থেকে করা গোলেই পয়েন্ট পেয়ে খেতাব এসেছে। ম্যাচ হয়েছে ২-২। আমনা বলছিলেন, ‘‘গোলটা আমি আমার পরিবার, সমর্থক এবং যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়ার মানুষকে উৎসর্গ করছি।’’
খালিদের মতোই আমনাও আই লিগ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার স্বাদ পেয়েছেন গত মরসুমেই। আইজলের সেই জয়ের সঙ্গে তুলনায় আনতে চাইলেন না ইস্টবেঙ্গলের এই ইতিহাস সৃষ্টির দিনটিকে। শুধু বললেন, ‘‘দুটো আলাদা অনুভূতি। তবে ইস্টবেঙ্গল সমর্থকদের আবেগটা আলাদা।’’
খালিদ বলছিলেন, এই ম্যাচের টার্নিং পয়েন্ট রালতের ১-১ করার গোল। সেই মিজোরামের ছেলেই পেলেন ডার্বি সেরার পুরষ্কার। ইংরেজি বা হিন্দি জানেন না। সতীর্থ ব্রেন্ডন ফার্নান্ডেজ-কে দোভাষী করে রালতে শুধু বললেন, ‘‘ট্রফি জিতে ভাল লাগছে। গোলটা আসল নয়, খেতাব জেতাটাই বড় ব্যাপার।’’
এই উচ্ছ্বাসের মধ্যেই সবথেকে বিমর্ষ দেখাল উইলিস প্লাজার দেশের স্টপার কার্লাইল মিচেল-কে। শুকনো মুখ করে এক পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তাঁর দোষেই দু’টো গোল হজম করতে হয়েছে। সেটা মেনে নিতে পারছেন না ত্রিনিদাদ ও টোব্যাগোর এই ফুটবলার। তাঁকে দেখে ডেকে নিলেন খালিদ। বললেন, ‘‘সবার ভুলে গোল হয়েছে। তোমার একার কোনও দোষ নেই। এটা টিম গেম। সব একসঙ্গে ভাগ করে নিতে হবে।’’
কার্লাইল তখন কোচের দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে। খালিদ জামিলকেও মনে হল যেন অন্য গ্রহের মানুষ। তা সে তাঁর তুকতাক নিয়ে যতই আলোচনা হোক।