জয়োল্লাস: মঙ্গলবার জামশেদপুর দলের বিরুদ্ধে জোড়া গোল করলেন ইস্টবেঙ্গলের কোলাদো। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক
ইস্টবেঙ্গল ৬ • জামশেদপুর ০
সাত মিনিটের মধ্যে ২-০।
বত্রিশ মিনিটে ৩-০।
ঊনআশি মিনিটে ৫-০।
কলকাতা ময়দানে যে কোনও দলের কোচ এ রকম পারফরম্যান্সের পরে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে বসে পড়তেন রিজার্ভ বেঞ্চে। কিন্তু আলেসান্দ্রো মেনেন্দেস তো সে বান্দা নন। শেষ মিনিট পর্যন্ত তাঁকে দেখা গেল বিরামহীন অবস্থায়। ডাগ আউটে বসলেন তো না-ই, উল্টে চেঁচিয়ে গেলেন সারাক্ষণ। কখনও তাঁকে দেখা গেল হাত নেড়ে রক্ষণকে নির্দেশ দিচ্ছেন, হুড়মুড় করে বিপক্ষের এলাকায় উঠে না আসতে। কখনও কেউ গোল নষ্ট করলে ধমকও দিচ্ছেন।
দলবদলের বাজারে যখন পড়শি ক্লাব মোহনবাগান একের পর এক ফুটবলার নিয়ে চমক দিচ্ছে, তখন লাল-হলুদের স্প্যানিশ কোচকে নিয়ে সমালোচনায় সরব হয়েছিল সোশ্যাল মিডিয়া। প্রশ্ন তোলা হয়েছিল, দেশে বসে কী করছেন কোচ? ক্লাব কর্তারাও তোপ দাগছিলেন বিনিয়োগকারীদের দল গঠনের ব্যর্থতা নিয়ে। সেটা যে আলেসান্দ্রোর কানে যায়নি, তা নয়। মরসুমের দ্বিতীয় ম্যাচেই হাফ ডজন গোলে জেতার পরে সম্ভবত সে জন্যই তাঁর বাঁকা হাসি মাখানো মুখ থেকে বেরিয়েছে, ‘‘পিন্টু মাহাতো আমার দলের সম্পদ হয়ে উঠছে। ভাল অনুশীলন করছে। কথা শোনে। আর বিদ্যাসাগর সিংহ যে ভাবে খেলে তাতে বিপক্ষের রক্ষণের ওকে আটকানো মুশকিল। তবে কেউ একা নয়, পুরো দলই আজ ম্যান অব দ্য ম্যাচ।’’ দেড় বছর শহরে এসেছেন আলেসান্দ্রো। এ রকম উচ্ছ্বসিত হতে কি কখনও দেখা গিয়েছে তাঁর মতো গম্ভীর স্বভাবের মানুষকে? মনে পড়ছে না। ম্যাচের পর তাঁবুতে না ঢুকে লাল-হলুদ কোচ যখন গাড়ি করে বেরিয়ে যাচ্ছেন, তখন তাঁর উপরে হামলে পড়া জনতার মধ্য থেকে একজনকে বলতে শোনা গেল, ‘‘কোচ স্যর, আপনি আছেন। কোনও চিন্তা নেই।’’ হাসতে হাসতে হাত নেড়ে বেরিয়ে গেলেন আলেসান্দ্রো।
ইন্ডিয়ান সুপার লিগের দল জামশেদপুরের রিজার্ভ দল একেবারেই শক্তিশালী প্রতিপক্ষ নয়। টাটা ফুটবল অ্যাকাডেমির পাঁচ ফুটবলার দলে। বাকিরা সবাই যুব দলের। গড় বয়স একুশ। কোনও বিদেশি নেই। এ রকম একটা অনভিজ্ঞ দলকে শক্তিশালী ইস্টবেঙ্গল যে দুমড়ে মুচড়ে দেবে, তাতে কোনও অভিনবত্ব নেই। কিন্তু যেটা দেখার তা হল, আগের ম্যাচের নয় ফুটবলারকে এ দিন বদলে দিয়েছিলেন আলেসান্দ্রো। সেই ‘নতুন দল’ হেলায় ছয় গোলে জিতছে, এটা চমক বইকি। যা থেকে স্পষ্ট, শতবর্ষে পা দেওয়া ক্লাবের রিজার্ভ বেঞ্চও তৈরি। ডুরান্ড এবং লিগ পাশাপাশি চলছে। এক দিন বা দু’দিন অন্তর ম্যাচ রয়েছে সূচিতে। পরিবর্ত ফুটবলার তৈরি তো রাখতেই হবে আলেসান্দ্রোকে। সেই চেষ্টাই তিনি শুরু করলেন মঙ্গলবার থেকে।
জিতলে কোলাদোরা ডুরান্ড কাপের শেষ চারে কার্যত পৌঁছে যাবেন, এটা জানা সত্ত্বেও ইস্টবেঙ্গল গ্যালারির তিরিশ শতাংশ ফাঁকা ছিল। যা সত্যিই চোখে পড়ার মতো। আবার অত্যন্ত দৃষ্টিকটু লেগেছে গান গাওয়ার ফাঁকে এক শ্রেণির লাল-হলুদ সমর্থকের কদর্য ভাষায় অশ্লীল গালাগালিকেই স্লোগান হিসেবে ব্যবহার করা দেখে। প্রচুর মহিলা সমর্থকও এসেছিলেন খেলা দেখতে। তাও এই অভব্যতা কেন?
গ্যালারিতে গান শুরু হয় সাত মিনিটের মধ্যেই। কোলাদোর জোড়া গোল (প্রথমটি পেনাল্টি থেকে) মশালধারীদের উচ্ছ্বাসের ঢেউয়ে ভাসিয়ে দেওয়ার রসদ জোগাড় করে দিয়েছিল। কোলাদো কাঁধে চোট পেয়ে বসে যাওয়ার পরেও আলেসান্দ্রোর দলের আগুনে মেজাজে ভাটা পড়েনি। তিকিতাকা ঝলকও দেখা গেল কোনও কোনও সময়। একসঙ্গে পাঁচ-ছ’টা পাসও খেলছিলেন বিদ্যাসাগর-পিন্টুরা। বিরতির আগেই পিন্টু মাহাতো গোলও করে ফেললেন। মোহনবাগান ছেড়ে আসা জঙ্গলমহলের ছেলে বিদেশি কোচের হাতে পড়ে এখন অনেক পরিণত। ম্যাচের পরে পিন্টু বলছিলেন, ‘‘বিদেশি কোচের কাছে উইথ দ্য বল খেলাটা শিখেছি। সেটা কাজে দিচ্ছে।’’ মাঝমাঠে পিন্টুর দৌরাত্ম্য আর বিদ্যাসাগর সিংহের বিপক্ষ রক্ষণকে ফালাফালা করে দেওয়ার কৌশল— তরুণ এই দুই ফুটবলারের বিস্ফোরণে অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছিল ইস্টবেঙ্গল। বিদ্যাসাগর নিজে দু’টো গোল করলেন, শেষটি করালেন বৈথাং হাওকিপকে দিয়ে। ডুরান্ডে ম্যাচ সেরার পুরস্কার নেই। থাকলে তা পেতেই পারতেন লাল-হলুদ অ্যাকাডেমি থেকে উঠে আসা এই স্ট্রাইকার।
ছয় গোলে জেতার দিনেও ইস্টবেঙ্গলে যে কাঁটা ছিল না, তা নয়। বিরতির পরে জামশেদপুর তেড়েফুঁড়ে খেলতে শুরু করতেই নড়বড়ে লেগেছে আলেসান্দ্রোর রক্ষণকে। ইস্পাতনগরীর অনভিজ্ঞ ছেলেরা অন্তত দুটো গোলের সুযোগ পেয়ে গিয়েছিল। বোরখা গোমেসকে প্রথম একাদশে না নামিয়ে এ দিন লাল-হলুদ শিবিরের আর এক নতুন স্প্যানিশ স্টপার মার্তি ক্রেসপিকে নামানো হয়েছিল। বৃষ্টির মাঠে তিনি বিশেষ নজর কাড়তে পারেননি। চাপের মুখে তাঁকে তুলে নিতে বাধ্য হন কোচ।
ইস্টবেঙ্গল: মিরশাদ, কমলপ্রীত সিংহ, মার্তি ক্রেসপি (বোরখা গোমেজ), আসির আখতার, ব্রান্ডন ভানলালরেমডিকা, টোনডোম্বা নওরেম সিংহ (প্রকাশ সরকার), কাশিম আইদারা, পিন্টু মাহাতো, বিদ্যাসাগর সিংহ, খাইমে সান্তোস কোলাদো (বৈথাং হাওকিপ)।