Sambaran Bandyopadhyay

আমরাই পারব: রঞ্জি জয়ের অভিযানে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন

সত্তরের দশকেই গাওস্করের সঙ্গে প্রদীপদার আলাপ করিয়ে দিয়েছিলাম ইডেনে। তার পর থেকে দু’জনে আরও ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়ে ওঠে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২১ মার্চ ২০২০ ০৩:৫৪
Share:

১৯৯০ সালের রঞ্জি ট্রফি ফাইনালের আগেও বাংলা দলকে উদ্ব‌ুদ্ধ করেছিলেন।

১৯৭৭ সাল। চেন্নাই (তখন মাদ্রাজ)-এ ভারতীয় টেস্ট দলের আবাসিক শিবিরে যোগ দিয়েছি। কলকাতায় তখন প্রবল উত্তেজনা। পেলে খেলতে আসছেন মোহনবাগানের বিরুদ্ধে কসমস ক্লাবের হয়ে। মোহনবাগানের কোচ ছিলেন প্রদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়। সুনীল গাওস্কর আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘‘কোচ হিসেবে পিকে কতটা ভাল?’’ একটা কথাই বেরিয়েছিল, ‘‘ইন্টারন্যাশনাল’’। গাওস্করের পাল্টা প্রশ্ন, ‘‘তাই নাকি’’? আমি বললাম, ‘‘একেবারেই’’।

Advertisement

সত্তরের দশকেই গাওস্করের সঙ্গে প্রদীপদার আলাপ করিয়ে দিয়েছিলাম ইডেনে। তার পর থেকে দু’জনে আরও ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়ে ওঠে। শুধু ফুটবলারেরা নয়, প্রদীপদাকে সম্মান করতেন প্রত্যেক ক্রিকেটার। খেলার এনসাইক্লোপিডিয়া। সব কিছু নিয়েই তাঁর অগাধ জ্ঞান। টেনিস, অ্যাথলেটিক্স এমনকি খাওয়া-দাওয়ার বিষয়েও তাঁকে তর্কে হারানো যেত না। এক বার আমাদের বাড়িতে ইলিশ মাছ খেতে নিমন্ত্রণ করেছিলাম। খাওয়ার আগে ইলিশ নিয়েই ২০ মিনিটের বক্তৃতা দিলেন। কেন ইলিশ মাছের রাজা, কী ভাবে আট রকম ভাবে রান্না করা যায়, তার বর্ণনা দিয়ে বুঝিয়েছিলেন। আজ বাংলা তাদের সেরা ক্রীড়া ব্যক্তিত্বকে হারিয়েছে।

প্রদীপদা আমাকে প্রচণ্ড স্নেহ করতেন। আমিও তাঁর কাছে ঋণী। সত্তর দশকের শেষের দিকে রঞ্জি ট্রফির প্রি-কোয়ার্টার ফাইনালে হরিয়ানার বিরুদ্ধে ম্যাচ ছিল বাংলার। ইস্টবেঙ্গল মাঠে তখন প্রশিক্ষণ দিচ্ছিলেন প্রদীপদা। লাঞ্চের আগে হ্যামস্ট্রিংয়ে ভয়ঙ্কর চোট পাই। চোট পাওয়ার খবর পেয়ে ইডেনে চলে আসেন। হ্যামস্ট্রিংয়ের চোট এতটাই গুরুতর, উইকেটকিপিং করা তো দূর, ঠিক মতো দাঁড়াতেই পারছিলাম না।

Advertisement

লাঞ্চের সময় একটি ছোট ব্যাগ নিয়ে ড্রেসিংরুমে এলেন উনি। পায়ের অবস্থা দেখে ব্যাগ থেকে একটি ছোট শিশি বার করেন। জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ‘‘শিশির মধ্যে কী?’’ বলেছিলেন, ‘‘সারস পাখির তেল।’’ হ্যামস্ট্রিংয়ে টানা আধা ঘণ্টা সেই তেল দিয়ে মালিশ করেন প্রদীপদা। জাদুর মতো কাজ করেছিল। পরে আর কোনও ব্যথাই অনুভব করিনি। ম্যাচ খেলতেও সমস্যা হয়নি। এ ভাবেই প্রত্যেককে আপন করে নিতেন প্রদীপদা।

আরও মধুর স্মৃতি জড়িয়ে তাঁর সঙ্গে। ১৯৯০ সালের ২২ মার্চ। রঞ্জি ট্রফি ফাইনালের ঠিক আগের দিন। প্রচণ্ড গরম। পাঁচ দিনের ম্যাচ খেলতে হবে, তাই আগের দিন অনুশীলন বন্ধ ছিল। দলকে উদ্বুদ্ধ করার জন্য ম্যাচের আগের দিন বাংলার ড্রেসিংরুমে তাঁকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম। শুরুতে আসতে চাইছিলেন না। অনেক অনুরোধের পরে রাজি হন। পরের দিন সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের অভিষেকের দিন। শরদিন্দু মুখোপাধ্যায়ের দ্বিতীয় ম্যাচ। আমাদের দলে দুই তরুণ ক্রিকেটার। বিপক্ষে শক্তিশালী দিল্লি। ৯জন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিজ্ঞতা সম্পন্ন। এই পরিস্থিতিতে কী ভাবে বিপক্ষের মোকাবিলা করা উচিত তা বলেছিলেন প্রদীপদা। অনেক দুর্গম পথ অতিক্রমের কাহিনি শুনিয়েছিলেন। মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে প্রদীপদার সেই ভোকাল টনিক শুনেছিলাম। জার্মান যুদ্ধের পদ্ধতি থেকে জার্মান ফুটবল। পিছিয়ে পড়া থেকে এগিয়ে যাওয়ার কাহিনি। স্বাধীনতা সংগ্রামের বেশ কিছু ঘটনা আমাদের সামনে তুলে ধরেছিলেন। বলেছিলেন, ‘‘ব্যক্তি দেখে খেলো না। বিপক্ষের মান অনুযায়ী খেলো।’’

কখনওই ভোলা যাবে না তাঁর সেই বিখ্যাত স্লোগান, ‘‘আই ক্যান ডু ইট, ইউ ক্যান ডু ইট, উই ক্যান ডু ইট’’। অর্থাৎ আমি পারব, তুমি পারবে, আমরাই পারব। সেই মন্ত্রই রঞ্জি ফাইনালে এক ধাপ এগিয়ে দিয়েছিল। স্বাধীনতার পরে প্রথম বার রঞ্জি ট্রফি জিতেছিল বাংলা। প্রদীপদা হয়তো চলে গিয়েছেন। কিন্তু তাঁর কণ্ঠস্বর কখনও হারাবে না।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement