কলকাতায় দিয়োগো মারাদোনা। ছবি সংগৃহীত।
মারাদোনাকে যখন আমরা নিয়ে আসি, তখন দেশে বিশ্বকাপ বাদ দিয়ে আন্তর্জাতিক ফুটবলের জনপ্রিয়তা ততটা ছিল না। আর এ দেশের ফুটবলের জনপ্রিয়তাও কমছিল। সেই কারণে আমরা কয়েকজন বিশ্বের তারকা ফুটবলারদের নিয়ে জনপ্রিয়তা ফিরিয়ে আনার একটা প্রকল্প নিয়েছিলাম। সেই সূত্রেই আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ হয় মারাদোনার। মূলত আমি, ভাস্কর গোস্বামী, সিকে পাণ্ডে-রা কাজ করেছিলাম। সেই সময় আমরা মারাদোনাকে বলি যে, ১০০ কোটির দেশকে বাইরে রেখে কি পৃথিবীর ফুটবল মানচিত্র তৈরি হতে পারে? উনি এই একটি কথাতেই ভীষণ প্রভাবিত হয়েছিলেন।
মারাদোনার বাড়িতে মাত্র পাঁচ মিনিটের জন্য দেখা করার অনুমতি মিলেছিল। উনি বলেছিলেন, এতদূর থেকে আমরা যেহেতু গিয়েছি, তাই উনি পাঁচ মিনিট আমাদের সঙ্গে কথা বলবেন। কিন্তু তার বেশি নয়।
প্রসঙ্গত, মারাদোনার সঙ্গে যোগাযোগ হওয়ার বিষয়টা একটু বলতে হয়। প্রাথমিক ভাবে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছিল ওই দেশেরই সেবাস্তিয়ান ও হ্যারিসের। হ্যারিসের দাদা আর্জেন্তিনার জাতীয় দলের হয়ে খেলতেন। তারপর ওঁদের মাধ্যমেই যোগাযোগ হয় মারাদোনার প্রথম স্ত্রী ক্লদিয়ার সঙ্গে। তিনিই শেষ পর্যন্ত মারাদোনার অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে দিয়েছিলেন। ডাউন টাউনের বাড়িতে আমাদের ড্রাইভ করে নিয়ে গিয়েছিলেন মারাদোনার তৎকালীন ছোট জামাই।
আরও পড়ুন: রাত দু’টোতেও মারাদোনাকে ফোন করতেন কাস্ত্রো
তারপর ওঁর বাড়ি পৌঁছে যা হল, তাতে আমরা অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। প্রায় দু’ঘণ্টা উনি আমাদের সঙ্গে কথা বলেছিলেন। নানা বিষয় নিয়ে সেদিন ওঁর বাড়িতে আমাদের কথা হয়েছিল। ছোট্ট একটা ছিমছাম বাড়িতে তখন থাকতেন উনি। সুইমিং পুল, টেনিস কোর্ট, ওই পরিসরেও ছিল রাজকীয় আয়োজন। যেখানে উনি টিম মিটিং করেন, সেখানেই আমাদের বসালেন। আর আমরা পুরো বিষয়টা নিয়েই যেন বিস্ময়ের ঘোরে ছিলাম। কিন্তু দেখা হওয়ার পর উনি এমন ভাবে আমাদের জড়িয়ে ধরলেন, তাতে বিস্ময় আরও বেড়ে গেল। এমনও হয়, ভাবছিলাম আমরা!
আরও পড়ুন: একই ম্যাচে নিন্দিত ও প্রশংসিত, ফুটবলার হিসাবে যতটা সফল কোচিংয়ে ততটাই ব্যর্থ রাজপুত্র
মিনিট পাঁচেকের মধ্যে ভাষার দূরত্ব কোথায় উবে গেল। ওখানে বসেই উনি বলেছিলেন, ‘‘দাও, তোমাদের কন্ট্রাক্ট পেপারে কোথায়? সই করতে হবে।’’ আমরা প্রস্তুতি নিয়ে যায়নি। বললাম, দেশে ফিরে সব ব্যবস্থা করছি। সেবারে মারাদোনাকে একটা প্লেনের ফার্স্ট ক্লাসের টিকিটও দিতে পারিনি। যাই হোক, উনি এক কথায় রাজি হয়ে গিয়েছিলেন ভারতে আসতে।
ভারতে ফুটবল নিয়ে উন্মাদনা র ব্যাপারে জানা ছিল না মারাদোনার।
তারপর কলকাতায় এলেন মারাদোনা। তৎকালীন ক্রীড়ামন্ত্রী ছিলেন সুভাষ চক্রবর্তী। ক্রীড়া দফতরের পক্ষ থেকে একটা অভ্যর্থনা জানানো হয়েছিল মারাদোনাকে। কলকাতার রাস্তায় বিমানবন্দর থেকে উপচে পড়েছিল মানুষের ঢল। বাসে আসতে আসতেই উনি বলেছিলেন, ১৯৮৬-৮৭ সালে ইতালির ক্লাব নাপোলির হয়ে জেতার পর যেমন করে তাঁদের অভ্যর্থনা জানানো হয়েছিল, কলকাতা দেখে তাঁর সেই রাতের কথা মনে পড়ে গিয়েছিল। আবেগে চোখে জল এসেছিল মারাদোনার।
আরও পড়ুন: আকাশে একসঙ্গে ফুটবল খেলব একদিন, লিখলেন পেলে
কলকাতা দেখে আরেকটা কথা বলেছিলেন। উনি জানতেনই না ভারতে ফুটবল নিয়ে এমন উন্মাদনা আছে। বলেছিলেন, ‘‘আমাকে দেখার জন্য এত লোক রাস্তায়? দেখে তো আমার ধারণাই পাল্টে গেল।’’ তারপর উনি মহেশতলা গেলেন। মোহনবাগান অ্যাকাডেমি গেলেন। সাংবাদিক বৈঠক করলেন। ফিদেল কাস্ত্রোর সমবয়সী একজন বাম নেতা রাজ্যে আছেন শুনে উনি জ্যোতিবাবুর বাড়িতেও গিয়েছিলেন। সেখানে দশ মিনিটের সাক্ষাৎ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু উনি রইলেন প্রায় এক ঘণ্টা। আসলে, আবেগে ভরপুর একটা মানুষ ছিলেন মারাদোনা। এই সব মিলিয়ে ওই তিনটে দিন একেবারে স্বপ্নের মতো ছিল কলকাতা আর পশ্চিমবঙ্গের মানুষের কাছে।
মারাদোনাকে আনার সময়ে দেশের ফুটবলজগত যেন আমাদের পাশে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল।
এখনও স্পষ্ট মনে আছে, আমাদের কাছে প্রায় আড়াইশোর বেশি প্রেস কার্ড রেজিস্টার্ড হয়েছিল। পাকিস্তান, ভুটান, বাংলাদেশ, নেপাল থেকে সাংবাদিকরা এসেছিলেন। আর আসবেন না কেন, এশিয়ায় প্রথমবার মারাদোনা আসছেন, তাঁকে দেখতে তো আসবেনই। ভারতের ফুটবল উন্মাদনা নিয়ে মহেশতলাতে অনেকক্ষণ কথা বলেছিলেন মারাদোনা। মনে আছে, আমরা বাচ্চাদের দিয়ে একটা বল জাগলিংয়ের অনুষ্ঠান আয়োজন করেছিলাম। মারাদোনা সেই ছোট ছোট ছেলেগুলোকে দেখে, হাঁ করে তাকিয়ে ছিলেন। বলেছিলেন, ‘‘এই তো, এত ছোট ছেলেগুলো এমন করে জাগলিং করছে, এ দেশে ফুটবল হবে না কে বলল?’’
আরও পড়ুন: ‘ফুটবল দেখতাম তোমার জন্য’, মারাদোনার প্রয়াণে শোকস্তব্ধ সৌরভ-সচিনরা
মারাদোনাকে আনার সময়ে দেশের ফুটবলজগত যেন আমাদের পাশে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। শৈলেন মান্না, সুব্রত ভট্টাচার্য থেকে শুরু করে সেই সময়ে কলকাতা মাঠের প্রতিদিনের খেলোয়াড়, সকলের মধ্যে ছিল প্রবল উন্মাদনা। কারণ, মারাদোনা মানে জাদু। সেই জাদুকরকে প্রথমবার দেশ চোখের সামনে দেখবে। উন্মাদনা তো থাকবেই। মনে পড়ছে, আমরা সেই সময়ে একটি ম্যাচের আয়োজন করেছিলাম সল্টলেক স্টেডিয়ামে। ক্রীড়ামন্ত্রী একদাশ বনাম প্রণব মুখোপাধ্যায় একাদশ। সেই খেলা দেখতে গোটা বাংলা ভেঙে পড়েছিল। সেখানেই অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকার কথা ছিল মারাদোনার। কিন্তু মাঠে বল পড়তেই তিনি আর বসে থাকতে পারলেন না। মাঠে নেমে পড়েছিলেন। এক সময়ে ওঁকে মাঠ থেকে তোলাটাই কষ্টের হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কলকাতা দেখেছিল, জাত খেলোয়াড় কাকে বলে। শার্ট, প্যান্ট পরেও ওই রকম দৌড়, চোখের সামনে এখনও জীবন্ত।
ব্যক্তিগত ভাবে একটা ভয়ঙ্কর দুঃখের রাত আমার কাছে। চোখের সামনে সমস্ত স্মৃতি ভেসে আসছে। সম্প্রতি ওঁর অসুস্থতার খবর পেয়ে খোঁজও নিয়েছিলাম। যার সূত্র ধরে ওঁর সঙ্গে আমার যোগাযোগ, সেই সেবাস্তিয়ানকে আমি জিজ্ঞাসা করলাম, উনি বললেন, মারাদোনা ভাল আছেন। কিন্তু হঠাৎ করে আজ রাতে এই খবরটা পেয়ে, সব কেমন চোখের সামনে ভেসে উঠল আবার।