—ফাইল চিত্র
একটি গোল। এবং জীবনভর বিতর্ক।
মৃত্যুর পরও উঠে আসছে ১৯৮৬ সালে মেক্সিকো বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে দিয়েগো মারাদোনার সেই বহুল চর্চিত গোলের প্রসঙ্গ।
হ্যান্ড অব গড!
ডেটলাইন মেক্সিকো সিটির আজটেকা স্টেডিয়াম।
২২ জুন ১৯৮৬।
বিশ্বকাপের এই ম্যাচের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটও স্মরণ করা যেতে পারে। বছর চারেক আগেই ফকল্যান্ড যুদ্ধে ইংল্যান্ডের কাছে পর্যুদস্ত হয়েছিল আর্জেন্টিনা। ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে কোয়ার্টার ফাইনালে যেন সেই যুদ্ধের উত্তাপ ছিল স্পষ্ট। ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে বিশ্বকাপের ম্যাচটির প্রথমার্ধ ছিল গোল শূন্য। প্রথম অর্ধে চেষ্টা করেও ইংল্যান্ডের রক্ষণ ভাঙতে পারেনি মারাদোনার আর্জেন্টিনা। দ্বিতীয়ার্ধের শুরু থেকেই তাই ইংল্যান্ডকে চেপে ধরে আর্জেন্টিনা। মাত্র ৬ মিনিটের মাথাতেই ওই গোল। বক্স থেকে বল পাওয়ার পর মারাদোনা বাঁ পায়ে সেটিকে পাস করে দেন টিমমেট জোর্গে ভালদানোকে। ভালদানো ইংলিশ ডিফেন্ডারদের কাটানোর চেষ্টা করতে থাকেন। কিন্তু তিনি সুবিধে করে উঠতে পারেননি। ইংলিশ ডিফেন্ডার স্টিভ হজ বলটি ক্লিয়ার করেন। বলটি এর পর যখন পেনাল্টি বক্সের মধ্যে উড়ে আসে, তখন ইংল্যান্ডের গোলকিপার পিটার শিল্টন ডান হাত তুলে লাফিয়ে বলটি ফিস্ট করতে যান। মারাদোনাও অন্য দিকে বল তাড়া করে ছুটতে ছুটতে লাফান হেড করার জন্য। সে সময় তাঁর বাঁ হাতটি মাথার খুব কাছেই ছিল। মারাদোনা গোল করার সময় আগে তাঁর বাঁ হাতটি বলে লাগে। তার পর বল মাথা ছুঁয়ে গোলে ঢুকেছিল। কিন্তু ঘটনাটি এত দ্রুত ঘটে যে তা তিউনিশিয়ান রেফারি আলি বেন্নাসিউরের নজর এড়িয়ে যায়। মারাদোনাও এক বার রেফারি এবং লাইন্সম্যানের দিকে তাকিয়ে পুরোদস্তুর উল্লাস শুরু করেন।
আরও পড়ুন: আকাশে একসঙ্গে ফুটবল খেলব একদিন, লিখলেন পেলে
এর কিছু পরেই আসে চোখ ধাঁধাঁনো সেই গোল। যাকে সর্বকালের অন্যতম সেরা গোল হিসাবে ধরা হয়। যেখানে সতীর্থ হেক্টর এনরিকের থেকে বল পেয়ে আউটফিল্ডে ইংল্যান্ডের ৪ জন ফুটবলারকে কাটিয়ে গোল করেন মারাদোনা। আর্জেন্তিনা ম্যাচটি ২-১ জিতেছিল। এই বিশ্বকাপেই ফাইনালে পশ্চিম জার্মানিকে ২-১ হারিয়ে আর্জেন্টিনা বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয়।
কিন্তু, সব নজর গিয়ে পড়ে প্রথম গোলটি নিয়ে। ম্যাচের পর ওই গোলটি নিয়ে প্রশ্ন করা হলে মারাদোনা বলেন, ‘‘গোলটা এসেছিল আমার হেড এবং ঈশ্বরের হাত থেকে।’’
আরও পড়ুন: ‘ফুটবল দেখতাম তোমার জন্য’, মারাদোনার প্রয়াণে শোকস্তব্ধ সৌরভ-সচিনরা
মেক্সিকোর এক ফটোগ্রাফার আলেসান্দ্রো ওদেদা কার্বাজাল একটি ছবি তোলেন ওই গোলের। যে ছবিতে পরবর্তী কালে দেখা যায় মারাদোনার হাত বলে লেগেছিল। এ নিয়ে সারা জীবন ধরেই মারাদোনাকে নানা সময় প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়েছে।
২০০৮ সালে ইংল্যান্ডের একটি পত্রিকা যেমন মারাদোনাকে এক সাক্ষাৎকারে এ নিয়ে প্রশ্ন করেছিল। তিনি বলেছিলেন, ‘‘যদি ফিরে গিয়ে ইতিহাস বদলাতে পারি, তা হলে সেটা করব।’’ তার পরই অবশ্য যোগ করেন, ‘‘কিন্তু একটা গোল সবসময়ই গোল। সে বার আর্জেন্টিনা বিশ্বজয়ী হয়েছিল। আমি সেরা প্লেয়ার হয়েছিলাম। সেই ইতিহাস তো বদলানো যাবে না। তাই আমিও জীবনে এগিয়ে যেতে চাই।’’
আরও পড়ুন: রাত দু’টোতেও মারাদোনাকে ফোন করতেন কাস্ত্রো
তবে ওই গোলের জন্য শেষ পর্যন্ত ক্ষমা চাননি তিনি। বলেছিলেন, ‘‘এ নিয়ে ক্ষমা চাইব না। আমি বলতে চেয়েছি সে দিনের ইতিহাস বদলানো যাবে না। তাই আমার ক্ষমা চাওয়ারও প্রশ্ন ওঠে না। সে দিন স্টেডিয়ামে ১ লক্ষ দর্শক ছিলেন। ২২ জন ফুটবলার ছিল। দু’জন লাইন্সম্যান ও এক জন রেফারি ছিলেন। তখন ইংল্যান্ডের ফুটবোলাররা প্রশ্ন তোলেনি কেন? তা ছাড়া জীবনে কখনওই ক্ষমা চাইনি। আর এত দিন বাদে ক্ষমা চাওয়ারও অর্থ হয় না।’’
সম্প্রতি করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধেও তিনি সেই ‘হ্যান্ড অব গড’-এর হস্তক্ষেপ চেয়েছিলেন। আর্জেন্টিনার ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন সম্প্রতি দুই মরসুমের জন্য লিগে অবনমন বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। যার ফলে লিগ তালিকার তলানিতে থাকা জিমনাসিয়া ক্লাব রক্ষা পায়। এই ক্লাবের কোচ ছিলেন মারাদোনা। অবনমনের হাত থেকে মারাদোনার ক্লাবের বেঁচে যাওয়াকে অনেকে চিহ্নিত করেন ‘দৈব ব্যাপার’ হিসেবে। মারাদোনা তখন বলেছিলেন, “অনেকে অবনমন বেঁচে যাওয়াকে নতুন হ্যান্ড অব গড বলে ডাকছেন। কিন্তু আমি এখন সেই হাতকে করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য আহ্বান করছি। মানুষ যেন সুখে-শান্তিতে, সুস্থ শরীরে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারে, সেটাই চাইছি।”
মারাদোনার জীবনে ‘হ্যান্ড অব গড’ সত্যিই এক রূপকথা। মৃত্যুর পরও যে রূপকথা থেকে যাবে।