Diego Forlan

সোনার বল পেয়েও ওই শটের আক্ষেপ আজও যায়নি, আনন্দবাজারকে ফোরলান

২০১০-এর পরে কেটে গিয়েছে ন’টা বছর। দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্বকাপের মহানায়ক চলতি মাসের গোড়ার দিকে বুট জোড়া তুলে রেখেছেন। ৯ বছর আগের বিশ্বকাপের সেই ক্ষতে সময় কি এখন প্রলেপ ফেলে দিয়েছে?

Advertisement

কৃশানু মজুমদার

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৯ অগস্ট ২০১৯ ১৬:২৬
Share:

ম্যাজিশিয়ান ফোরলান। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ

ফুটবলভক্তদের কাছে উরুগুয়ান তারকা দিয়েগো ফোরলান এক ট্র্যাজিক চরিত্র। মাঠে তিনি ফুল ফোটাবেন, রামধনুর মতো বাঁকানো ফ্রি কিক থেকে গোল করবেন, প্রায় হারা ম্যাচ একাই জিতিয়ে দেবেন, কিন্তু মোক্ষম সময়ে বিশ্বাসঘাতকতা করে বসবে তাঁর বুট জোড়া।

Advertisement

২০১০ ফুটবল বিশ্বকাপের তৃতীয় স্থান নির্ণায়ক ম্যাচটাই যেমন। পোর্ট এলিজাবেথে অনুষ্ঠিত জার্মানি-উরুগুয়ে ম্যাচের একেবারে শেষ লগ্নে আকাশি জার্সির ফোরলানের ফ্রি কিক জার্মানির বারে চুম্বন করে বেরিয়ে যায়। উরুগুয়ে তখন ম্যাচে পিছিয়েছিল। ফোরলানের ফ্রি কিকটা দক্ষিণ আফ্রিকায় বাঁচিয়ে রেখেছিল জার্মান বধের স্বপ্ন।

গোটা টুর্নামেন্ট জুড়ে দামাল জাবুলানি বলকে পোষ মানিয়েও আসল সময়ে ফোরলানের ‘মিসাইল’ লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। তার পরের দৃশ্য আরও হৃদয়বিদারক। শূন্য দৃষ্টিতে কিছু ক্ষণ জার্মানির গোলের দিকে তাকিয়ে রইলেন উরুগুয়ের ১০ নম্বর জার্সিধারী। সেই মহাকাব্যিক ম্যাচের শেষে যন্ত্রণার হাসি মুখে ঝুলিয়ে ঠোঁটে দাঁত চেপে ফোরলানকে বলতে শোনা গিয়েছিল, ‘‘আমার জীবনের অন্যতম দুঃখের দিন।” ওই বিশ্বকাপে সোনার বল পেলেও যে দুঃখ কোনও দিনই যায়নি তাঁর।

Advertisement

আরও পড়ুন: অবসর নিলেন কলকাতায় খেলে যাওয়া, বিশ্বকাপে সোনার বল জেতা বিখ্যাত এই স্ট্রাইকার

আরও পড়ুন: ফোরলানের পরামর্শে অ্যাথলেটিক্স ট্র্যাকে প্রণয়

২০১০-এর পরে কেটে গিয়েছে ন’টা বছর। দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্বকাপের মহানায়ক চলতি মাসের গোড়ার দিকে বুট জোড়া তুলে রেখেছেন। ৯ বছর আগের বিশ্বকাপের সেই ক্ষতে সময় কি এখন প্রলেপ ফেলে দিয়েছে? ২০১০ বিশ্বকাপের সোনার বল জয়ী ফুটবলার আনন্দবাজারকে বললেন, ‘‘এটাই ফুটবল। কখনও আপনার মন ভাঙবে। আবার কখনও এই খেলাটা আপনার ভাঙা মন জুড়ে দেবে। কেরিয়ারে আমি অনেক গোল করেছি। আবার অনেক গোল নষ্টও করেছি। ২০১০ বিশ্বকাপে জার্মানির বিরুদ্ধে ওই শটটা অল্পের জন্য গোলে ঢোকেনি। বারে লাগে। একটা সময়ে ওই শটটা নিয়ে অনেক ভেবেছি। এখন আর সে ভাবে ভাবি না।’’ কেরিয়ারে দাড়ি টানার পরে দার্শনিক শোনায় ফোরলানকে।

নেলসন ম্যান্ডেলার দেশে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপ ফোরলানকে নিয়ে গিয়েছিল আকাশচুম্বী উচ্চতায়। সে বারে জাবুলানি বলকে পোষ মানাতে হিমসিম খেতে হয়েছিল বিখ্যাত সব ফুটবলারদের। ফোরলান ছিলেন ব্যতিক্রম। নিখুঁত সব দূরপাল্লার শটে জাল কাঁপাচ্ছিলেন। তাঁর শটের নাগাল পাননি বিখ্যাত সব গোলকিপাররা। সেই বিশ্বকাপের ঠিক পরেই কলকাতায় পা রেখেছিলেন উরুগুয়ান তারকা। একটি টেলিভিশন চ্যানেলের রিয়্যালিটি শোয়ের জন্য তাঁকে আনা হয়েছিল। তার কয়েক বছর পরে মুম্বই সিটি এফসি-র জার্সি গায়ে আইএসএল খেলতে চলে আসেন তিনি। সেই সূত্রেই ভারতের বিভিন্ন শহর কাছ থেকে দেখেছেন। কলকাতা এখনও তাঁর স্মৃতিতে জীবন্ত। এই শহরের হৃৎস্পন্দন এখনও যেন শুনতে পান তারকা। উরুগুয়ে থেকে ফোরলান বলছিলেন, ‘‘কলকাতা তো বটেই, পুরো ভারতেই আমার অভিজ্ঞতা দারুণ। মাস ছয়েক আমি ছিলাম ভারতে। দারুণ সময় কাটিয়েছি। অনেকের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। অল্প কয়েক দিনে অনেকেই আমার বন্ধু হয়ে গিয়েছিল। তাঁদের কয়েক জনের সঙ্গে এখনও আমার কথাবার্তা হয়। কলকাতাকে আমি ভুলিনি।’’

এক নজরে ফোরলান। গ্রাফিক— শৌভিক দেবনাথ।

ফুটবল মাঠে বিপক্ষের কড়া চ্যালেঞ্জ তাঁর মুখ থেকে কাড়তে পারেনি হাসি। সেই হাসিও অবশ্য ফোরালানকে বিতর্ক থেকে মুক্তি দিতে পারেনি। ২০১১ সালের কোপা আমেরিকা চলাকালীন আর্জেন্তিনায় চরম হেনস্থার মুখে পড়তে হয়েছিল ফোরলানকে। আর্জেন্তিনার নামী মডেল জায়রা নারার সঙ্গে ফোরলানের বিয়ে হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু, কোপা শুরু হওয়ার মাস খানেক আগে সেই সম্পর্ক ভেঙে দিয়েছিলেন জায়রা নিজেই। তার জন্য আর্জেন্তিনীয় মহিলারা গ্যালারিতে হাজির হয়ে ফোরলানকে ‘বিশ্বাসঘাতক’ বলেছিলেন। যখনই মাঠের ধারে গিয়েছেন বল কুড়োতে, তখনই তাঁর উদ্দেশে উড়ে এসেছিল বিদ্রুপ। দেশের মেয়ের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন হওয়ার পরে মেসির দেশের মহিলারা বলেছিলেন, “ভাগ্যিস আমাদের সঙ্গে ফোরলানের সম্পর্ক তৈরি হয়নি।’’ সে দিন মাথা নীচু করে মাঠ ছাড়তে হয়েছিল উরুগুয়ের তারকা ফুটবলারকে। ফুটবল মাঠকে বিদায় জানানোর পরে সেই সব ‘কালো দিন’ যেন অদৃশ্য ইরেজার দিয়ে মুছে দিয়েছেন ফোরলান। তাঁর জীবন বয়ে গিয়েছে অন্য খাতে। ফোরলান বলছিলেন, “পেশাদার ফুটবলারের জীবনে ভাল-মন্দ হাত ধরাধরি করেই হাঁটে। ভাল সময়ের স্মৃতি মনে রেখে এগিয়ে যেতে হয়। আর খারাপ সময় মানুষকে অনেক কিছু শেখায়। আমিও নিজের ফুটবল কেরিয়ারে সেটাই করেছি। খারাপ সময় থেকে অনেক কিছু শিখেছি। সেই শিক্ষা আমাকে পরিণত করেছে। আমি ফুটবলের কাছে ঋণী। এই খেলাটার জন্যই আজ আমার এত নাম ডাক।”

গোলের পরে ফোরলান। তখন তিনি মুম্বই সিটি-র ফুটবলার।

সেই ফুটবলকেই তিনি দিলেন ছুটি। শেষ এক বছরে ক্লাব ছিল না ৪০ বছর বয়সী তারকার। বয়স থাবা বসিয়েছিল তাঁর খেলাতেও। বাস্তবটা বুঝতে পেরেছিলেন ‘ম্যাজিশিয়ান’। ফুটবল মাঠ ছেড়ে দিলেন। এ বার কী করে সময় কাটাবেন? ২১ বছরের দীর্ঘ ফুটবলজীবনে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে খেলেছেন। পরিবারকে সে ভাবে সময় দিতে পারেননি উরুগুয়ের বিখ্যাত ১০ নম্বর জার্সিধারী। সেই তিনি এখন পরিবারের সঙ্গে সময় কাটাতে চান। ফোরলান বললেন, ‘‘এতদিন ফুটবল খেললাম। খেলার জন্য বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরে বেড়িয়েছি। এ বার পরিবারকে একটু সময় দিতে চাই। বন্ধুদের সঙ্গে গল্প করব। আমার দেশ উরুগুয়েতেই থাকব। ফুটবল খেলা ছেড়ে দিয়েছি বলে যে ফুটবলের সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গিয়েছে তা নয়। আমি বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে ধারাভাষ্য দেব। ফুটবল দেখব। সব থেকে ভাল লাগছে, পরিবারের সঙ্গেই সময় কাটাতে পারব।”

ফোরলানের হাতে এখন অঢেল সময়। সকাল থেকে আর নেমে পড়তে হবে না হাড় ভাঙা অনুশীলনে। মাঠে নেমে নিরন্তর ফ্রি কিক অনুশীলন করতে হবে না। হাতে সময় থাকলে মানুষ হয়ে পড়েন কল্পনাপ্রবণ। পিছিয়ে যান ফেলে আসা সব দিনে। মনে পড়ে যায় অনেক ঘটনা। কোনও এক অলস পড়ন্ত বিকেলে ফোরলানের মনেও হয়তো উঠবে ঝড়, কেন সে দিন তাঁকে ব্যর্থ হতে হল? জার্মানির জালে কেন জড়াল না বল? উত্তর খুঁজে পেলেও তিনি যে আর বদলাতে পারবেন না তাঁর ভাগ্য। সে দিনের ওই একটা শটের জন্য আজও তাঁকে শুনতে হয় নানা প্রশ্ন। সবাই ভুলে যান, তিনিও রক্তমাংসের মানুষ।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement