মর্মস্পর্শী: বিরাটে মুগ্ধ আমির।
লাইন অব কন্ট্রোলে দু’দেশের মধ্যে যতই টেনশন থাকুক। যতই দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক ভেঙে পড়ুক। যতই দু’দেশের মধ্যে সমস্ত রকম আদানপ্রদান বন্ধ হয়ে যাক। যতই বিশ্ব মানের ইভেন্ট ছাড়া খেলার মাঠে দু’দেশের দ্বৈরথ বন্ধ থাকুক। এর পরেও ভারত-পাক ক্রিকেট মাঠের প্রেম কিন্তু অটূট। পুরুষদের ক্রিকেট হোক কী মহিলাদের, সীমান্তের কাঁটাতারের বাধা উপেক্ষা করে চলছে দু’দেশের ক্রিকেটারদের পারস্পরিক বন্দনা এবং শ্রদ্ধা নিবেদন।
ইংল্যান্ডে মহিলাদের বিশ্বকাপে ভারত বনাম পাকিস্তান ম্যাচে যেমন মৈত্রীর অসাধারণ ছবি দেখা গিয়েছে। পাকিস্তানের মহিলা ক্রিকেটার কাইনাত ইমতিয়াজ দেখা করেন তাঁর আদর্শ ঝুলন গোস্বামীর সঙ্গে। ইনস্টাগ্রামে ঝুলনের সঙ্গে কাইনাতের সেই ছবি সারা বিশ্বের ক্রীড়াপ্রেমীরা ‘লাইক’ করেন।
কয়েক দিন আগে ইংল্যান্ডেই কোহালির স্বপ্নভঙ্গ করে দুর্দান্ত পেস বোলিংয়ে পাকিস্তানের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি জয়ের অন্যতম স্থপতি ছিলেন মহম্মদ আমির। কিন্তু মাঠের লড়াইকে দূরে সরিয়ে রেখে আমির মঙ্গলবার বলে দিয়েছেন, তাঁর মতে কোহালিই বিশ্বের এক নম্বর ব্যাটসম্যান। টুইটারে ভক্তদের সঙ্গে একটি বিশেষ সেশন করেছিলেন পাক পেসার। সেখানে তাঁকে প্রশ্ন করা হয়— জো রুট, স্টিভ স্মিথ, কেন উইলিয়ামসন এবং বিরাট কোহালি। কাকে বিশ্বের সেরা মনে করেন আপনি? আমিরের জবাব, ‘ওরা প্রত্যেকেই স্পেশ্যাল। কিন্তু ব্যক্তিগত ভাবে আমার মনে হয়, বিরাটই বিশ্বের এক নম্বর ব্যাটসম্যান’। এর পর আরও এক ভক্ত তাঁকে টুইটারে প্রশ্ন করেন, আপনার মতে বিশ্বের সেরা ব্যাটসম্যান কে? ফের আমিরের জবাব, ‘বিরাট কোহালি’।
ঝুলনই প্রেরণা কাইনাতের।
সৌজন্যের ‘ইনিংস’ শুরু করেন বিরাটই। যখন ম্যাচ গড়াপেটার অভিশাপমুক্ত হয়ে আমির ফিরছেন, বহু আন্তর্জাতিক তারকা সেই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিলেন। কোহালি মুক্ত কণ্ঠে তাঁকে স্বাগতই শুধু জানাননি, উচ্ছ্বসিত প্রশংসাও করেন প্রত্যাবর্তনেই দারুণ বল করার জন্য। ইডেনে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ম্যাচের আগে আমিরকে ব্যাট উপহারও দেন কোহালি।
আরও পড়ুন: শাস্ত্রীয় মতে বোলিং কোচ ভরত, জাহিরদের নিয়ে ধোঁয়াশা
এমনিতে কোহালি-আমিরই একমাত্র নয়। ভারত-পাক যতই মাঠের মধ্যে যুদ্ধ দেহিং মনোভাব থাকুক, মাঠের বাইরে বন্ধুত্বের প্রচুর উদাহরণ আছে। আশির দশকে রবি শাস্ত্রীদের যেমন পাকিস্তান ঘোরাতে নিয়ে যেতেন জাভেদ মিয়াঁদাদ। সেই মিয়াঁদাদ, ভারতের সঙ্গে খেলায় মাঠের মধ্যে যাঁকে সব চেয়ে আক্রমণাত্মক দেখাত। জাহির খান থেকে ইরফান পাঠান— অনেক ভারতীয় বাঁ হাতি পেসারকে মূল্যবান পরামর্শ দিয়েছেন ওয়াসিম আক্রম। পাকিস্তানের প্রাক্তন বাঁ হাতি স্পিনার ইকবাল কাশিম এই সে দিনও ফোনে কথা বলতে গিয়ে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছেন, ‘‘বিষাণ বেদীর সঙ্গে কথা হলে বলে দেবেন প্লিজ, আমি আন্তরিক শুভেচ্ছা জানিয়েছি।’’ দিল্লিতে এসে বেদীর বাড়িতে থেকে গিয়েছেন যে কাশিম! আজও ভুলতে পারেননি প্রতিপক্ষ শিবিরের প্রিয় বন্ধুর সেই আতিথেয়তা।
মৈত্রীর তালিকায় নতুন সংযোজন ঝুলন এবং কাইনাত। ২০০৫ সালে ঝুলন পাকিস্তানে গিয়েছিলেন এশিয়া কাপে খেলতে। সেই সময় কাইনাত ছিলেন বল গার্ল। বিশ্বের দ্রুততম পেসার ঝুলনকে দেখেই কাইনাতের ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্ন দেখা শুরু। বিশ্বকাপের ভারত-পাক ম্যাচে খেলেননি কাইনাত। কিন্তু ঝুলনের সঙ্গে দেখা করতে ছাড়েননি। ঝুলন সে দিন ম্যাচ শেষ হওয়ার পর কথা বলছিলেন ইয়ান বিশপের সঙ্গে। প্রায় আধ ঘণ্টা ভারতীয় পেসারের অপেক্ষায় ঠায় দাঁড়িয়ে ছিলেন কাইনাত। ড্রেসিংরুমে ফিরে যাওয়ার পথে তাঁকে অনুরোধ করেন, একটা ছবি তুলতে পারি আপনার সঙ্গে? তার পর ২০০৫-এর এশিয়া কাপে বল গার্ল থাকার কাহিনি শোনান। যা শুনেই দলের অধিনায়ক মিতালি রাজকে ডেকে আনেন ঝুলন। সেই এশিয়া কাপে খেলেছিলেন মিতালিও। তাঁকে ডেকে ঝুলন মজা করে বলেন, মেয়েটিকে চিনতে পারছিস? আমরা শেষ বার যখন পাকিস্তানে এশিয়া কাপ খেলতে গিয়েছিলাম, ও ছিল বল গার্ল।
এতটাই মর্মস্পর্শী ছিল এই কাহিনি যে, মুহূর্তে ভারতীয় দলের ড্রেসিংরুমেও তা ছড়িয়ে পড়ে। ম্যাচ হেরে যায় পাকিস্তান। কিন্তু মন জিতে নেন পাকিস্তানের মেয়ে কাইনাত। আইসিসি টুইট করে কাইনাতের ইনস্টাগ্রাম পোস্ট। ক্রিকেট দুনিয়ায় বিরল সম্প্রীতির ছবি হয়ে থাকেন ঝুলন-কাইনাত। কে বলবে দুই দেশের মধ্যে ক্রিকেটই বন্ধ! a