-ফাইল চিত্র।
রবিবারের যুবভারতী। ১৯৯৭ সালের ১৩ জুলাই। ফেডারেশন কাপ সেমিফাইনালে সে দিন মুখোমুখি কলকাতার দুই প্রধান। মোহনবাগান বনাম ইস্টবেঙ্গল। ম্যাচের কয়েক দিন আগে থেকেই গোটা কলকাতা উত্তাল হয়ে উঠেছিল এই খেলা ঘিরে।
দ্বৈরথটা ছিল অমল দত্তের ডায়মন্ড সিস্টেমের সঙ্গে প্রদীপ কুমার (পিকে) বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভোকাল টনিকের। একটা ডার্বি ঘিরে টিকিটের এমন হাহাকার এর আগে কখনও দেখা যায়নি। বহু আলোচিত এই ডার্বিতে যদিও অমল দত্ত হেরে গিয়েছিলেন। পিকে-র ইস্টবেঙ্গল ম্যাচটা জিতেছিল ৪-১ ফলে। যুবভারতীতে সে দিন এক লক্ষ ৩১ হাজার দর্শকের সামনে লাল-হলুদ জার্সি গায়ে হ্যাটট্রিক করেছিলেন ‘পাহাড়ি বিছে’ ভাইচুং ভুটিয়া। শুধু ভারতেই নয়। এশিয়ার ক্লাব ফুটবলের ইতিহাসেও একটি ম্যাচে এটাই বৃহত্তম দর্শক সমাগমের রেকর্ড।
ঠিক তার ২০ দিনের মাথায়, ১৯৯৭ সালের ২ অগস্ট, কলকাতা লিগের ডার্বি দেখতে যুবভারতীতে হাজির হয়েছিলেন এক লক্ষ ২৫ হাজার দর্শক। দীপেন্দু বিশ্বাসের ‘বিতর্কিত’ গোলে সেই ম্যাচটি আবার জিতে ফিরেছিল অমল দত্তের মোহনবাগান। তার চেয়েও বড় কথা, মাত্র ২০ দিনের ব্যবধানে যুবভারতীতে দু’টি ডার্বি ম্যাচ দেখতে সোয়া লক্ষ বা তার বেশি দর্শক স্টেডিয়াম ভরিয়ে দিয়েছিলেন।
আরও পড়ুন: আবেগ নয়, মস্তিষ্ক ব্যবহার করো, মন্ত্র কোচ ফাওলারের
যুবভারতীর প্রথম ডার্বি হয়েছিল, ১৯৮৪ সালে আইএফএ শিল্ডের ফাইনালে। প্রায় এক লক্ষ দর্শকের উপস্থিতিতে। এখানেও লড়াই ছিল সেই দুই ফুটবল মস্তিষ্কের মধ্যে। অমল দত্ত বনাম পিকে বন্দ্যোপাধ্যায়। খেলার শেষ দিকে কার্তিক শেঠের গোলে যুবভারতীর প্রথম মহারণ জিতেছিল ইস্টবেঙ্গল। যুবভারতীতে দুই প্রধানের সাক্ষাৎকারের বেশির ভাগ ম্যাচেই লাখ খানেক দর্শকের স্টেডিয়ামে উপস্থিত থাকাটা স্বাভাবিক ব্যাপার ছিল। এখন অবশ্য স্টেডিয়াম সংস্কারের পরে দর্শকাসন কমেছে। বাংলা ফুটবলের প্রয়াত দুই কিংবদন্তি কোচ প্রদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং অমল দত্ত আজ বেঁচে থাকলে হয়তো আইএসএলের প্রথম ডার্বিতে ও রকম একটা ‘ডায়মন্ড দ্বৈরথ’ দেখা যেতেই পারত।
ময়দানে পরের পর রোমাঞ্চকর ডার্বি দেখার স্মৃতি এখনও উজ্জ্বল। ১৯৭৫ সালের বড় ম্যাচে মোহনবাগানের বিরুদ্ধে ৫-০ গোলে ইস্টবেঙ্গলের জয় ভোলা যাবে না। ইডেনেও দুই প্রধান মুখোমুখি হয়েছে ১৯৬৭ থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত। ১৯৬৭ সালে ইডেনের প্রথম ডার্বি ২-১ জিতেছিল ইস্টবেঙ্গল। মোহনবাগান বিক্রমজিৎ দেবনাথের গোলে এগিয়ে গেলেও সমতা ফেরান প্রশান্ত সিংহ। খেলার শেষ লগ্নে অসীম মৌলিকের গোলে ইস্টবেঙ্গল জিতে যায়। ইডেনে শেষ ডার্বি ১৯৮৪ সালে। বাবু মানির গোলে সেই ম্যাচটি জেতে মোহনবাগান।
১৯৭৬ সালের কলকাতা লিগের ম্যাচে খেলা শুরুর ১৭ সেকেন্ডে গোল করেন মহম্মদ আকবর। ডার্বির দ্রুততম গোল সেটাই। যা দীর্ঘ ছ’বছর পরে মোহনবাগানকে লিগ খেতাব দিয়েছিল।
১৯৭৭ সালের ডার্বিতে দুরন্ত দল গড়েও ঘরের মাঠে পিকে বন্দ্যোপাধ্যায়ের মোহনবাগান হেরে যায়। মিহির বসুর চমকপ্রদ ভলি ও সমরেশ চৌধুরীর ফ্রি-কিকের গোলে জেতে ইস্টবেঙ্গল।
আরও পড়ুন: অ্যাওয়ে ম্যাচেও চেষ্টা সবুজ-মেরুন জার্সির
১৯৭৮ সালের ডার্বিতে মোহনবাগান মাঠে ৪০ মিনিট দেরিতে প্রবেশ করে দুই দল। এর পিছনে ছিল না কি সংস্কার। তবে ম্যাচের শেষ মুহূর্তে শ্যাম থাপার শূন্যে শরীর ভাসিয়ে ব্যাকভলিতে করা গোল আজও চোখে ভাসে। জিতেছিল মোহনবাগান।
১৯৭৯ সালের ডার্বিতে সাবির আলির গোলে এগিয়ে যাওয়ার পরে আরও প্রাধান্য বিস্তার করে ইস্টবেঙ্গল। কিন্তু প্রথমার্ধ শেষ হওয়ার একটু আগে ইস্টবেঙ্গল গোলরক্ষক ভাস্কর গঙ্গোপাধ্যায়ের উদ্দেশে চিন্ময় চট্টোপাধ্যায় ব্যাকপাস করেন অনেক দূর থেকে। সঙ্গে সঙ্গে গোলের গন্ধ পাওয়া মানস ভট্টাচার্য দৌড় শুরু করে দেন। ভাস্করের আগেই বলের কাছে পৌঁছে গিয়ে তা গোলে ঠেলে দেন তিনি। ম্যাচের ফল ১-১। লিগ চ্যাম্পিয়নও হয় মোহনবাগান।
ডার্বির আরও কত স্মৃতি ছড়িয়ে রয়েছে পাতায় পাতায়। মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল ডার্বি ছাড়া ভারতের কোনও ফুটবল প্রতিযোগিতা হতে পারে না। ২০২০-’২১ মরসুমে এটিকের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে আইএসএলে খেলার ব্যাপারটা মোহনবাগান অনেক আগে নিশ্চিত করে ফেললেও ইস্টবেঙ্গলকে নিয়ে কয়েক মাস আগেও ছিল ঘোরতর সংশয়। তার পরে নাটকীয় পট-পরিবর্তন। সবাইকে চমকে দিয়ে, সব সমস্যা কাটিয়ে উঠে এ বারের আইএসএলে খেলবে ইস্টবেঙ্গলও।
এটিকে-মোহনবাগান বনাম এসসি ইস্টবেঙ্গল মহারণের অপেক্ষায় প্রহর গোণা শুরু হয়ে গিয়েছে। ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের শতবর্ষ এ বছর। তাই শতবর্ষে আইএসএলে ডার্বি বিস্ফোরণের অপেক্ষায় গোটা ভারতের ফুটবল সমাজ।