মানবিক: প্রতিকূলতা জয় করেও মানুষের পাশে দীপা মালিক।
শরীরে ১৮৩টি সেলাই। কোমরের নীচের অংশ সম্পূর্ণ অসাড়। ১৯৯৯ সালে তিন বারের অস্ত্রোপচার সত্ত্বেও আটকে গিয়েছেন হুইলচেয়ারে। কিন্তু তার পরেও হার মানেননি দীপা মালিক। ভারতের প্রথম মহিলা ক্রীড়াবিদ হিসেবে ২০১৬ সালে প্যারালিম্পিক্সে পদক পান। সেই দীপা এ বার অন্য লড়াইয়ে নেমেছেন। যে লড়াই কোভিড-১৯ নামক অতিমারির বিরুদ্ধে।
‘‘আমার জীবনটাই লড়াই করে কেটেছে। নিভৃতবাস আমার কাছে নতুন কিছু নয়। তাই এই অতিমারির বিরুদ্ধেও লড়তে তৈরি আমি,’’ ফোনে আনন্দবাজারকে একান্ত সাক্ষাৎকার দিতে গিয়ে বললেন দীপা। যে লড়াইয়ের ছাপ দেখা যাচ্ছে তাঁর প্রতিটা পদক্ষেপে। কখনও গুরুগ্রামের রাস্তায় হুইলচেয়ারে বসেই গরীব মানুষদের খাদ্য বিতরণ করে চলেছেন। কখনও নিজের ‘কর্পোরেট ফি’-র পুরোটাই তুলে দিচ্ছেন প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে। দীপা বলছিলেন, ‘‘আমরা একটা লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছি। চেষ্টা করছি যাতে দিন-আনে-দিন-খায় পরিযায়ী শ্রমিক বা বিশেষ ভাবে সক্ষম মানুষরা অভুক্ত না থেকে যান।’’
কী কী পদক্ষেপ করেছেন দীপা? পদ্মশ্রী, খেলরত্ন পুরস্কারজয়ী এই অ্যাথলিট বলছেন, ‘‘আমরা দিনে ১৫০টি খাবার প্যাকেট তুলে দিচ্ছি কানপুরের দৈনিক জীবিকা অর্জনকারীদের হাতে। এ রকম ৩০টি পরিবারের দায়িত্ব নিয়েছে আমার সংস্থা। যাদের হাতে শুকনো খাবার, স্যানিটাইজার্স, ভিটামিন তুলে দেওয়া হচ্ছে।’’ শুধু কানপুরেই নয়, জম্মুতেও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন তিনি। জানালেন, জম্মুর বিশেষ ভাবে সক্ষম কিছু মানুষের হাতে দু’সপ্তাহের খাদ্যসামগ্রী, ন্যাপকিন, ডায়াপারও তুলে দেওয়া হয়েছে।
এতেই শেষ নয়। দীপা বলছিলেন, ‘‘করোনা ত্রাণে তখনও প্রধানমন্ত্রীর তহবিল শুরু হয়নি। কিন্তু মোটিভেশনাল স্পিকার হিসেবে পাওয়া পাঁচ লক্ষ ৭৫ হাজার টাকা আমি প্রধানমন্ত্রীর প্রাকৃতিক বিপর্যয় মোকাবিলা করার তহবিলে দান করেছিলাম।’’ দীপা সবাইকে আহ্বান জানাচ্ছেন তাঁর সংস্থার পাশে দাঁড়ানোর জন্যও। চার বছর আগে রিয়ো প্যারালিম্পিক্সে শটপাটে জিতে দেশকে গর্বিত করেছিলেন দীপা। এখন তিনি খাদ্য তুলে দিচ্ছেন অভাবীদের মুখে। কোনটা বেশি তৃপ্তি দিয়েছে আপনাকে? দীপার জবাব, ‘‘মনে হচ্ছে, যেন এখন আবার দেশের হয়ে পদক জিতছি।’’ যোগ করছেন, ‘‘আপনি বলছেন তৃপ্তি পাওয়ার কথা, আমি বলছি এই কাজটা করা তো আমার কর্তব্য। আমি পদক পেলে সেটা দেশের ১৩০ কোটি মানুষের মুখে হাসি ফোটায়। মনে হয় পদকটা ওদেরই। আর এখন সেই দেশবাসীর জন্য আমি কিছু করছি। এই সুযোগে আমি তাদের কিছু ফিরিয়ে দিচ্ছি।’’ তিনি নিজে সেনা অফিসারের মেয়ে, সেনা অফিসারের স্ত্রী। সে কথা মনে করিয়ে দিয়ে দীপা বলছিলেন, ‘‘সে কারণে হয়তো আমার মধ্যে দেশপ্রেমটা একটু বেশি।’’
ভারতীয় প্যারালিম্পিক সংস্থার প্রেসিডেন্ট হওয়ার সুবাদে ৪৯ বছর বয়সি দীপার বাড়তি দায়িত্ব তাঁর বিশেষ ভাবে সক্ষম অ্যাথলিটদের মানসিক ভাবে তাজা রাখাও। দীপা অবশ্য আশাবাদী। বলছিলেন, ‘‘আমরা যারা বিশেষ ভাবে সক্ষম মানুষ, তারা কিন্তু এই ধরনের চ্যালেঞ্জ ছোটবেলা থেকেই সামলে এসেছি। আমাদের এক কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে উঠে আসতে হয়েছে। তাই অন্যদের চেয়ে প্যারা অ্যাথলিটরা এই চ্যালেঞ্জ আরও ভাল ভাবে সামলাবে বলেই মনে হয়।’’
সারা জীবন তিনি প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে লড়াই করে এসেছেন। ভয়ঙ্কর এই পরিস্থিতিতে দেশবাসীর জন্য কী হবে তাঁর বার্তা? দীপার জবাব, ‘‘আমি এক সময় হেঁটে-চলে বেড়াতাম। হঠাৎ এক দিন ডাক্তার বললেন, বুকের নীচ থেকে তোমার শরীর অসাড় হয়ে গিয়েছে। এই অবস্থায় আমার কাছে দুটো রাস্তা খোলা ছিল। এক, ভাগ্যকে মেনে নিয়ে হাল ছেড়ে দেওয়া। দুই, লড়াই করে ফিরে আসা। আমি হাল ছাড়িনি। লড়েছি এবং জিতেছি। এই লড়াইটা সবাইকে লড়তে হবে। সব নিয়ম আর ভাল অভ্যাস মেনে চলতে হবে।’’
জীবন যুদ্ধে জয়ী দীপা ফোন রাখার আগে বলে গেলেন, ‘‘করোনাভাইরাসের সঙ্গে রাজনীতি বা ধর্মের সম্পর্ক না খুঁজে সবাইকে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়তে হবে। জয় আমাদের হবেই।’’
আরও পড়ুন: ভারত-সহ যে কোনও দেশের পেসারদের কোচিংয়ে আগ্রহ প্রকাশ প্রাক্তন পাক তারকার