মেয়ে কোলে ওয়ার্নার। টিম হোটেলে। ছবি: গৌতম ভট্টাচার্য।
শুধু ওপরের দুটো হেডলাইনই তাঁকে বিতর্কে টেনে আনার পক্ষে যথেষ্ট! বিশ্বকাপের মতো হাইপ্রোফাইল প্রতিযোগিতার আগে কেউ বিপক্ষ দল বা তার মহাতারকা ব্যাটসম্যান সম্পর্কে এমন আলটপকা মন্তব্য করে নাকি! তাও আবার ভারতেরই আইপিএল থেকে যার প্রচুর রোজগার সে কখনও ইন্ডিয়াকে চটায়? অন্য যে কেউ হলে বলত ইন্ডিয়া বিশ্বকাপে ভাল খেলবে বা কোহলিকে দারুণ শ্রদ্ধা করি। কিন্তু তিনি— ডেভিড ওয়ার্নার যতই বিধ্বংসী ব্যাটসম্যান হয়ে টেস্ট এবং ওয়ান ডে-তে ভারতকে ধ্বংস করুন না কেন (সিরিজের টেস্ট রান ৪ ম্যাচে ৪২৭, দুটো ওয়ান ডে-র একটাতে সেঞ্চুরি) বদলাননি এতটুকু। তিনি হলেন অকৃত্রিম কাউবয়। শহুরে চালচলন মানার কোনও কারণ দেখেন না। মেলবোর্নে টিম হোটেলে বসে এবিপি-কে সোজাসাপ্টা সাক্ষাৎকার দিলেন...
প্রশ্ন: বিশ্বকাপ কারা জিততে পারে এমন প্রথম চারটে টিমের একটা তালিকা করে দিন না!
ওয়ার্নার: করে দিচ্ছি। এক নম্বরে অস্ট্রেলিয়া। দুই সাউথ আফ্রিকা। তিন-তিন নিউজিল্যান্ড। চার পাকিস্তান... দাঁড়ান দাঁড়ান। চার পাকিস্তান। দাঁড়ান পাকিস্তান-ইন্ডিয়া জয়েন্টলি।
প্র: শ্রীলঙ্কাকে রাখবেন না?
ওয়ার্নার: না, শ্রীলঙ্কা না।
প্র: ইন্ডিয়া পরে রাখলেন বাদ দিতে দিতেও। সত্যি ভারতকে প্রথম চারে দেখছেন?
ওয়ার্নার: ইয়েস, দে উইল বি ওকে ইন দ্য ওয়ার্ল্ড কাপ। বাট, আপনাদের টিম কম্বিনেশন ঠিক করতে হবে। ভারত যা দল বাছে তার কোনও মাথামুন্ডু নেই। আজ এক কম্বিনেশন কাল আর এক রকম কম্বিনেশন! কে টিমের এক নম্বর স্পিনার সেটাই ওরা ঠিক করে উঠতে পারল না। ভাল খেলতে হলে ব্যালান্সটা ঠিক করতে হবে।
প্র: সহবাগের সঙ্গে কয়েক বছর আইপিএল খেলেছেন। ভারতীয় দলে সহবাগ বা যুবরাজ না থাকায় আপনি কি আশ্চর্য?
ওয়ার্নার: সহবাগ আমার খুব ঘনিষ্ঠ। ও একজন দারুণ মানুষ। একসঙ্গে আইপিএল খেলার সময় আমাকে প্রায় দাদার মতো আগলে রেখেছিল। সহবাগই আমাকে প্রথম বলে, তোমার এক দিন টেস্ট ক্রিকেট খেলার জন্য বেশি নাম হবে। শুনে আমি তো বিশ্বাসই করতে পারিনি। তখন আমায় সবাই টি-টোয়েন্টি বা ওয়ান ডে প্লেয়ার হিসেবেই চিনত। টেস্ট প্লেয়ার হিসেবে কেউ ধরেইনি। এই উৎসাহটা সহবাগ যে দিয়েছিল আমার মনে থাকবে। তা ছাড়া ছ’বছর আগে কী করে বলেছিল যে, আমি সাকসেসফুল টেস্ট প্লেয়ার হব? এই উৎসাহটা যে সহবাগ দিয়েছিল আমার মনে থাকবে।
তা বলে কী করে অগ্রাহ্য করি যে ইন্ডিয়ান টিমে অনেক ভাল প্লেয়ার এখন এসে গিয়েছে— রোহিত শর্মা কোহলি, রাহানে, ধবন। ইয়ংরা তো ফাটিয়ে খেলছে।
প্র: বিশ্বকাপের প্রথম বল মাঠে পড়ার আগেই বলা হচ্ছে টুর্নামেন্টের এক্স ফ্যাক্টর হওয়ার জন্য তিন জনের মধ্যে কম্পিটিশন। বিরাট কোহলি, এবি ডে’ভিলিয়ার্স আর আপনি। আপনার কী মনে হয় এই তুলনা সম্পর্কে? আগাম এই সব কথা কি নিজের ওপর বাড়তি চাপ?
ওয়ার্নার: চাপ কেন হতে যাবে? এটা তো মস্ত প্রশংসা। তবে এবি আমার চেয়ে অনেক এগিয়ে। আমার মতে সব ধরনের ফর্ম অব ক্রিকেটে ও-ই বিশ্বের এক নম্বর ব্যাটসম্যান। ও যে ভাবে ব্যাট করে, অবিশ্বাস্য! যে ভাবে পরিস্থিতি বিচারে ভাবে সেটাও অসাধারণ। ওর সঙ্গে আমার তুলনা হচ্ছে এটাই তো সবচেয়ে বড় প্রশংসা।
প্র: ডে’ভিলিয়ার্সের অবিশ্বাস্য সেঞ্চুরিটা দেখেছিলেন?
ওয়ার্নার: পুরোটা না। হাইলাইটস প্যাকেজটা দেখেছি। অসাধারণ! এবি খেলা এত ভাল বোঝে যে জানে, কখন কী করতে হবে! এই বিশ্বকাপে আর এক জনের দিকে লক্ষ রাখবেন— ম্যাক্সওয়েল! দুর্ধর্ষ প্লেয়ার। প্রতি বলে চমক তৈরি করতে জানে। ম্যাক্সওয়েল যে দিন খেলবে একাই মাঠ আলো করে দেবে। আর এক জন প্লেয়ার হল ফকনার। দুর্দান্ত ফিনিশার। প্রচুর ম্যাচ ও জেতায়।
প্র: কোহলি?
ওয়ার্নার: কোহলি খুব ভাল। আমার যেমন ইন্ডিয়ান টিমে রোহিত শর্মার ব্যাটিংও দারুণ লাগে। রোহিতও যে দিন খেলবে একাই জিতিয়ে দিতে পারে। মনে হচ্ছে এখন ও দারুণ ফর্মেও আছে।
প্র: আমি কোহলির ব্যাপারে জানতে চাইছিলাম। টেস্ট সিরিজে এত ভাল খেলার পর ওয়ান ডে-তে হঠাৎ করে যে ফর্ম খারাপ হয়ে গেল...
ওয়ার্নার: আমার মনে হয় না ফর্ম খারাপ হয়েছে বলে।
প্র: তা হলে?
ওয়ার্নার: ফাস্ট উইকেটে শট সিলেকশনে গন্ডগোল হচ্ছে। টেস্ট সিরিজ আলোচনায় আনছি না। ব্রিসবেন বাদে বাকি সারফেসগুলো খুব স্লো ছিল। সারফেস যখনই ফাস্ট হচ্ছে তখনই ও স্টিয়ার করে যে শটটা খেলছে তাতেই আউট হচ্ছে। বেশির ভাগ সময় দেখবেন থার্ডম্যানে আউট হচ্ছে। ও যেটা করছে সেটায় ইন্ডিয়ান উইকেটে ছয়ও পেতে পারে। কিন্তু এখানে বাড়তি বাউন্সের জন্য ক্যাচ হয়ে যাবে। একই শট শেন ওয়াটসন খেলে কী ভাবে দেখবেন! ব্যাটটা স্কুপ করে না, নামায়— তাই বলও সেফ ল্যান্ড করে।
প্র: ভারতীয় বোলিংয়ের ইদানীং আপনি এমন বিভীষিকা হয়ে দাঁড়িয়েছেন যে আপনাকে ব্যাট হাতে ক্রিজে দেখলেই ভারতীয় সমর্থকেরা ডিপ্রেসড্ হয়ে যাচ্ছে। বোলারদের তো কথাই নেই। ছক্কা হাঁকড়ানো প্লেয়ার থেকে আপনার এমন ধারাবাহিকতায় উত্থানের রহস্য কী?
ওয়ার্নার: আমার স্ত্রীকে কৃতিত্ব দেব সবচেয়ে বেশি। ও এমন একটা মানসিক প্রশান্তি দিয়েছে যে আগের মতো ভেতরে ভেতরে আমি হাঁকপাক করছি না। এই মেন্টাল চেঞ্জটা খুব ইম্পর্ট্যান্ট। প্লাস আমার টিমমেটরা আমাকে ফ্রি খেলতে দিচ্ছে। ওদের ব্যাকিং না পেলে আমার ভঙ্গিতে ফ্রি ব্যাট করা যায় না।
প্র: ফ্রি তো আগেও ব্যাট করতেন। এখন সেঞ্চুরি হয়ে যাওয়ার পরেও নতুন করে কনসেনট্রেট করছেন...
ওয়ার্নার: হা হা। আসলে আগে কার্পেট বম্বিং করেই সন্তুষ্ট থাকতাম। এখন ভেতর থেকে একটা সঙ্কেত পাচ্ছি যে আমাকে বেশিক্ষণ থাকতে হবে। টিমকে জেতাতে হবে। এ বার বিশ্বকাপের আগে যেমন নিজেকে বলছি ছোটবেলা থেকে ডেভ তোমার স্বপ্ন ছিল বিশ্বকাপ খেলবে দেশের হয়ে। এ বার সেই আশটা এমন ভাবে মেটাও যেন দলের কাজে আসতে পারো। মোটিভেশন তো ভেতর থেকে আসে।
প্র: তবু বিশ্বকাপে যে সবাই আপনার কাছে রান চাইছে, সেটা কি চাপ নয়?
ওয়ার্নার: চাপ তো নিশ্চয়ই। এক এক সময় মনে হচ্ছে অলিম্পিকের একশো মিটার দৌড়ের স্টার্টিং ব্লকে দাঁড়িয়ে আছি।
প্র: ভারতীয় দল আপাতত আপনার এবং আপনার বন্ধুদের কার্পেট বম্বিংয়ে এমন বিধ্বস্ত যে বিশ্বকাপের আগে আপনি কি মনে করেন ওদের মনোবিদের কাছে যাওয়া উচিত?
ওয়ার্নার: মনোবিদের সাহায্য সবাই নেয়। আমাদের অস্ট্রেলিয়া টিমের সঙ্গেও তো মনোবিদ যুক্ত। কিন্তু মাঠে রানটা তো আপনাকে করতে হবে। মনোবিদের কাছে যাওয়ার আগে ভারতীয় বোলারদের রাইট জায়গায় বল করা শিখতে হবে। ডেথ বোলিংটাই তো হচ্ছে না। একমাত্র শামি। আর লোক কোথায়? আমার অবাক লাগছে উমেশ যাদবকে কিন্তু আমি আইপিএলে দেখেছি ডেথ ওভারে দারুণ বল করতে। ওর কী হল কে জানে! আসলে এখন ব্যাটসম্যানরা এত চালাক হয়ে গেছে যে পুরনো জমানার ইয়র্কারে চলবে না। টি-টোয়েন্টি খেলে খেলে সবাই ওস্তাদ হয়ে গেছে। ইয়র্কার আরও সূক্ষ্ম করতে হবে।
প্র: তা হলে ভারতের সমস্যা মনোবিদে সারবে না?
ওয়ার্নার: ধুর। আইপিএলের সময় তো দেখি সব স্বামী আর সাধুদের ধরে নিয়ে আসে। আর ওরা কপালে লাগিয়ে দেয়। ওটাকে কী যেন বলে?
প্র: তিলক।
ওয়ার্নার: ইয়েস তিলক। ওটা হতেই পারে কোনও ধার্মিক ব্যাপার। আমি অত জানি না। তবে তিলকে কি পারফরম্যান্স হয় নাকি? বোলারদের ঠিক লাইনে বল করতে হবে। ইন্ডিয়ান বোলাররা নাগাড়ে শর্ট বল করে গেছে।
প্র: বিশ্বকাপের আগেই শোনা যাচ্ছে আপনি, কোহলি, জনসন— এমন কিছু টেম্পারামেন্টাল প্লেয়ারের ওপর আম্পায়ার ও ম্যাচ রেফারি কড়া নজর রাখবেন। আচরণে সামান্য বেচালে রেড কার্ড পরিস্থিতি তৈরি হয়ে যেতে পারে। আগাম কোনও আতঙ্ক হচ্ছে না?
ওয়ার্নার: না, আমি লাইনের ওপারে যাব না। আমার একমাত্র লক্ষ্য এখন প্রথম দশ ওভারের পর নট আউট থাকা। তার পর চালাও। ফিল্ডিংয়েও দারুণ করতে হবে। ক্যাচ ধরতে হবে। রান আউট করতে হবে।
প্র: কিন্তু আপনি তো ফিল্ডিংয়ের সময়ও প্রায়ই মাথা গরম করছেন। ব্রিসবেনে রোহিত শর্মার সঙ্গে আপনার যেমন লাগল!
ওয়ার্নার: ক্রিকেটে ছোটখাট ও সব হয়েই থাকে। মনে রাখলে চলে না।
প্র: অ্যাডিলেড টেস্টে ৬৩ করার পর আপনি ফিল হিউজের জন্য ব্যাট তুলছিলেন। অভ্যেসটা বন্ধ করে দিলেন কেন?
ওয়ার্নার: বন্ধ করিনি। তার পরেও ৬৩ করলে ব্যাট তুলেছি।
প্র: বিশ্বকাপেও প্রতি বার ৬৩-তে পৌঁছলে তুলবেন?
ওয়ার্নার: না। ওই ব্যাট তোলাটা শুধুই টেস্ট ম্যাচে।