ফাইনালে বাংলার তিন অস্ত্র। মুকেশ, ঈশান ও আকাশ কি পারবেন ধারাবাহিক থাকতে? —নিজস্ব ছবি।
সে দিন আর এ দিন! মাঝের ব্যবধানটা প্রায় ৩০ বছরের। তিন দশক আগে বাংলার রঞ্জিজয়ী দলের দুই পেসার ছিলেন দত্তাত্রেয় মুখোপাধ্যায় ও রাজীব শেঠ। তিন দশক পর সৌরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে রঞ্জি ফাইনালে বাংলার আক্রমণের প্রধান ভরসা আবার পেস ত্রিভূজ। যাঁদের দাপটে তারকাখচিত কর্নাটক সেমিফাইনালে কোনও ইনিংসেই দুশো পার করতে পারেনি। সে বার রঞ্জি ফাইনালে দত্তাত্রেয় ও রাজীব, দুই পেসারই অতিষ্ঠ করে তুলেছিলেন দিল্লি ব্যাটসম্যানদের। দু’জনেই নিয়েছিলেন তিনটি করে উইকেট। এ বারও মরসুম জুড়ে বাংলার পেসাররা মিলিত ভাবে করছেন শিকার।
দুটো সময়, দুটো প্রজন্ম, দুটো দল। মাঝে ৩০ বছরের ফারাক। আনন্দবাজার ডিজিটালের কাছে বাংলার পেস আক্রমণের দুটো সময়কে তুলে ধরলেন দত্তাত্রেয় ও রাজীব। ফাইনালে বাংলার প্রধান কাঁটা, সৌরাষ্ট্রের জয়দেব উনাদকটকে খেলার টিপসও দিলেন।
১৯৯০ ও ২০২০, দুই সময়ের পেস আক্রমণের তুলনা—
দত্তাত্রেয়: এখনকার পেস বোলিং আক্রমণ অনেক বেশি ভাল। ঈশান, মুকেশ, আকাশরা খেলছে। বসে রয়েছে নীলকন্ঠ। এরা আমাদের চেয়ে অনেক বেশি প্রতিভাবান। এরা আমাদের চেয়ে অনেক জোরে বল করে। সবচেয়ে বড় কথা, এরা পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিয়ে বল করে। এটা খুব জরুরি। বিশেষ করে এই গুণটা আমাদের চেয়ে এদের মধ্যে অনেক বেশি রয়েছে। এই চার জন পেসার পরিস্থিতি অনুযায়ী মানিয়ে বল করতে জানে। শেষ তিন-চারটে ম্যাচ ধরলে এরা দুর্দান্ত পরিণত মানসিকতার পরিচয় রেখেছে।
রাজীব: তুলনা করা কঠিন। গাওস্করের সঙ্গে সচিন বা কোহালির তুলনা হয়? এটা বলতে পারি যে আমাদের বোলিং আক্রমণ বিধ্বংসী ছিল কারণ, পেস ও মুভমেন্ট, দুটোই ছিল। দত্তাত্রেয় একটা অফ দ্য উইকেট বল মুভ করাত। যা সিম ছিল, অফ দ্য উইকেট, তা সহজ কথা নয়। আমি গতিতে বল করতাম। তার পর ভিতরে-বাইরে, দুই দিকেই বল মুভ করাতাম। তখন আর এখনের একটা কমন দিক হল, বোলিং আক্রমণের ক্লিক করে যাওয়া। পোড়েল ও মুকেশ, এই দু’জন একটা কম্বিনেশনে বল করছে, জায়গায় বল রাখছে। ভাল দলের বিরুদ্ধে লাইন-লেংথ খুব জরুরি। ওড়িশার বিরুদ্ধে যেমন প্রথম দিনের এক ঘণ্টা পরে উইকেট পাটা হয়ে গিয়েছিল। সেখানে পোড়েল অনেক ওভার বল করেছিল। মুকেশও তাই। সে বার আমাদের বোলিং আক্রমণ ব্যালান্সড ছিল। এ বার নতুন ছেলেরা দায়িত্ব পালন করছে দারুণ ভাবে। ফাইনালে সৌরাষ্ট্রকে দুশোর আশপাশে থামাতে হবে। আর সেটা করার ক্ষমতা এই দলটার রয়েছে।
আরও পড়ুন: দলে ধোনি-সহ চার ভারতীয়, এ বার সর্বকালের সেরা টি২০ দল বেছে নিলেন হরভজন সিংহ
আরও পড়ুন: দলে তিন ভারতীয়, সর্বকালের সেরা টেস্ট দল বেছে নিলেন হরভজন
ঈশান পোড়েল সম্পর্কে মূল্যায়ন—
দত্তাত্রেয়: দুর্দান্ত ফর্মে রয়েছে। খুব জোরে বল করে। সবচেয়ে বড় কথা, নিশানায় অভ্রান্ত থাকে। শুধু জোরে বল করলেই এখন হয় না। এখন ক্রিকেট যে জায়গায় পৌঁছে গিয়েছে, তাতে নিশানায় ভুলচুক হলে যত জোরে বল করবে, তত জোরে মার খাবে। ঈশানের আর একটা গুণ হল, দু’দিকে বল মুভ করে। যখনই ওকে বল করতে দেখেছি, তখনই মনে হয়েছে এর মধ্যে অনেক প্রতিভা রয়েছে। ভারতের জন্য ও অনেক দিন খেলার ক্ষমতা ধরে। বাচ্চা ছেলে। বয়স কম। ঈশানের অ্যাকশনটা ইনসুইং অ্যাকশন। কিন্তু ওর বল বাইরে যায়। এটা ওর মস্ত সুবিধা। ব্যাটসম্যান বুঝে উঠতে পারে না যে বলটা পড়ে কোন দিকে যাবে। সবাই ভিতরে আসছে ভেবে খেলে। আর দুম করে বাইরে চলে যায়। রাউন্ড দ্য উইকেটে এসেও খোঁচা নিয়ে যাচ্ছে। ইনসুইং অ্যাকশনে আউটসুইং বল করছে ও। আর সবচেয়ে জরুরি, লাইন-লেংথে অভ্রান্ত থাকা। এটা না হলে কিন্তু কোনও সুইংয়েই কাজ হত না। ও জানে কোন ব্যাটসম্যানকে কোথায় বল করতে হয়। এই হোমওয়ার্কটা মাঠে ওর বোলিংয়ে বোঝাও যায়।
রাজীব: ওর বোলিং যা দেখেছি, তাতে দুর্দান্ত ট্যালেন্ট। প্রচুর সম্ভাবনা ওর মধ্যে। লম্বা, ভাল গতিতে বল করে। অ্যাকশন ভাল। ফলো থ্রু-র টেকনিক্যাল দিক নিয়ে রণদেব নিশ্চয়ই খাটছে। তা ছাড়া, অনেক দূর এগিয়ে যাওয়ার মশলা রয়েছে। এটা নিয়ে আমার মনে কোনও সংশয় নেই। সেমিফাইনালে মুকেশ বেশি উইকেট পেলেও ফাইনালে ঈশানই আমার মতো আসল লোক। ওর দিকে নজর রাখতেই হবে।
ঈশান পোড়েলের অ্যাকশন তাঁকে আরও মারাত্মক করে তুলেছে বলে মনে করছেন দত্তাত্রেয়। —ফাইল চিত্র।
সেমিফাইনালে মোট ৮ উইকেট নেওয়া মুকেশ কুমার—
দত্তাত্রেয়: মুকেশ কুমারকে দেখে মনে হয়েছে, ও কোনও কোনও স্পেলে শুইয়ে দিতে পারে বিপক্ষকে। মানে ওই স্পেলে ও বেশ কয়েকটা উইকেট নিয়ে বেরিয়ে যেতে পারে। পরে দেখা গেল, ওই স্পেলটাই টার্নিং পয়েন্ট হয়ে উঠল। প্রতিপক্ষকে পুরো শেষ করে দিল। ওর বল সুইং করে। বাইরে যায়। যা এখন বিশেষ দেখাই যায় না। এখন তো সবারই বল ভিতরে আসে। ওর ক্ষেত্রে উল্টোটা হয়। নিশানাও ঠিক আছে। গতি হয়তো ঈশানের চেয়ে একটু কম। শুনেছি ওর আঙুলে একটা সমস্যা আছে। তবে তার জন্য সুইংয়ে কোনও সুবিধা হয় বলে আমি মনে করি না। টেকনিকাল দিক দিয়ে এর কোনও প্রভাব হওয়া উচিত নয়।
রাজীব: খুব ভাল বোলার। ও মুভ করাতে পারে। জায়গায় বল রাখতে পারে। একেক জন বোলারের আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট থাকে। মুকেশের ক্ষেত্রে যেমন নিশানা। ও লম্বা সময় ধরে বল করতে পারে। শক্তিশালী বিপক্ষের বিরুদ্ধে এমন দুটো পেসার দরকার যাতে তারা ম্যাচে ৫০ ওভার করতে পারে। যদি তা না হয়, যদি দুটো পেসার মিলিয়ে ২৫-৩০ ওভারের বেশি ব্যবহার করা না যায়, তখন চাপ এসে পড়ে স্পিনারদের উপর। মুকেশকে ছোট ছোট স্পেলে অনেক সময় ধরে আক্রমণে রাখা যায়।
আরও পড়ুন: ওদের তিন পেসারের মোকাবিলায় আমাদের একা উনাদকটই যথেষ্ট, ফাইনালের আগে হুঙ্কার ঘাউড়ির
আরও পড়ুন: ‘ক্রিকেটে এমন সময় আসে, যখন সব কিছু ক্লিক করে যায়, বাংলার এখন সেটাই ঘটছে’
দলের তৃতীয় পেসার আকাশদীপ—
দত্তাত্রেয়: আকাশের পেস বাকি দু’জনের চেয়ে একটু বেশি। এবং ওর বলটা ভীষণ ভাল ভিতরে আসে। খুব ভাল বাউন্সার দেয়। যদি নিশানার দিকে আর একটু জোর দেয়, তবে আনপ্লেয়েবল বোলার হয়ে উঠবে। এটাতে জোর দেওয়া উচিত বলে মনে করি।
রাজীব: বেশি দেখিনি। তবে যা শুনেছি, তাতে ও ভাল আবিষ্কার। ট্যালেন্ট আছেই। এই পর্যায়ে নিয়মিত খেলছে যখন নিশ্চয়ই ভিতরে কিছু না কিছু স্পেশ্যাল রয়েছে। না হলে টিকে থাকতে পারত না। একটা বা দুটো ম্যাচ খেলেই বাদ পড়ে যেত।
জয়দেব উনাদকট কতটা বিপজ্জনক—
দত্তাত্রেয়: উনাদকট রীতিমতো অভিজ্ঞ। ও এ বার রঞ্জি ট্রফিতে প্রচুর উইকেট নিয়েছে। ঘরোয়া ক্রিকেটে প্রতি বছরই ও ধারাবাহিক থাকে। ওর বলটা বাইরে যায়। বাঁ-হাতি জোরে বোলারের বল বাইরে গেলে তা সামলানো খুব মুশকিল। আড়াআড়ি বের করানোর সঙ্গে ভিতরেও আনে। আবার ভিতরে আনতে আনতে দুম করে বাইরে বের করে। ওর অ্যাকশনটা এমনই যে এটা বোঝা সহজ নয়। ব্যাটসম্যানদের কাছে এটা খুব বিপজ্জনক। সঙ্গে নিশানা। আমি কিন্তু জোরের কথা বলছি না। আমাদের তিন পেসারই উনাদকটের চেয়ে জোরে বল করে। কিন্তু, ওর নিশানা খুব ভাল। আমাদের তিন জনের চেয়ে একটু বেশিই বলব। অনেক দিন ধরে ও খেলছে। দেশের হয়েও খেলেছে। আইপিএলেও খেলে নিয়মিত। জানে কোন ব্যাটসম্যানকে কী বল করতে হবে।
রাজীব: ওর বল চট করে ভিতরে আসে। বাঁহাতি পেসারের যদি গতি থাকে, তবে খেলা সহজ নয়। এটা ওর সুবিধা, আমাদের অসুবিধা। তাই সতর্ক থাকতে হবে। লম্বা, হিট দ্য ডেক বোলার ও। সেমিফাইনালে ১০ উইকেট নিয়েছে বলে কিন্তু আমি এটা বলছি না। ইনকামিং ডেলিভারি কিন্তু পা পেয়ে যায় ব্যাটসম্যানের। তাই সাবধানে থাকতে হবে। তবে উনাদকট থাকলেও খুব পেস সহায়ক উইকেট ফাইনালে দেবে না সৌরাষ্ট্র। কারণ, আমাদের বোলাররাও তখন তার ফায়দা নিতে পারবে। ফিফটি-ফিফটি উইকেটেই নির্ঘাত ফাইনালে খেলবে সৌরাষ্ট্র।
বাংলার উদ্বেগের জায়গা—
দত্তাত্রেয়: আমাদের দলটা বেশ ভাল। উদ্বেগের জায়গা একটাই। ব্যাটিং। প্রতিদিন ৭০ রানে ছয় উইকেট পড়বে আর অনুষ্টুপ পরিত্রাতা হয়ে উঠবে, এটা হয় না। প্রথম দিকের ব্যাটসম্যানদের রান করতে হবে। বিশেষ করে মনোজ ও অভিমন্যুকে দায়িত্ব নিতে হবে।
রাজীব: বোলিং ক্লিক করলেও টপ অর্ডার আমাদের চিন্তায় রাখছে। আগে বাংলার সুনাম ছিল ব্যাটিং শক্তির জন্য। এ বার কিন্তু বোলাররাই টানছে। তবে ঈশ্বরন, মনোজরা অভিজ্ঞ। ওদেরও এ বার রান করার পালা। আত্মতুষ্টি যেন না থাকে শিবিরে। বিশ্বাস করি, এ বার সঠিক টিম স্পিরিট রয়েছে দলে। আর বাংলাকে আগে বলা হল নিজেদের এলাকায় রাজা। এখন কিন্তু আর তা নয়!
আরও পড়ুন: ‘বার বার কঠিন পরিস্থিতি থেকে ফিরে আসছে, এমন বাংলা দল আগে দেখিনি’
আরও পড়ুন: ফাইনালে বাংলার দুই ওপেনারকে কী করতে হবে? টিপস দিলেন দুই রঞ্জিজয়ী বঙ্গসন্তান