শাস্ত্রীর ক্লাসে ধোনিও। শুক্রবার অ্যাডিলেডে। ছবি: দেবাশিস সেন
ধোনি-মিসবাদের টিম হোটেলটা যদি সাউথ সিটি হয়, কাতারে কাতারে নারীপুরুষ দাঁড়িয়ে রয়েছে যাদবপুরের মোড়ে।
শুক্রবার সন্ধে সাতটার সময় এমন ভিড় যে, ডান পকেটে মানিব্যাগ শক্ত করে চেপে ভিড় ঠেলে এগোতে হচ্ছে। চার দিকে সবাই ভিডিওয় ছবি তুলছে বলে আরও আলোয় আলো। আর এত চিৎকার যে মোবাইলে কল এলে পাশের দোকানের মধ্যে ঢোকা ছাড়া উপায় নেই। রাস্তায় রিসিভ করলে ও প্রান্তে যে কে, শোনাই যাবে না।
ভারত-পাকিস্তান দুটো টিমকেই অ্যাডিলেড ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে রাখা হয়েছে বলে তাদের দেখতে উৎসাহীরা ভিড় করেছে ভাবার কোনও কারণ নেই। এটা বার্মিংহ্যাম বা ম্যাঞ্চেস্টার নয় যে, দেশের হোটেলের মতোই বাইরে ভক্তদের লাগাতার ভিড় লেগেই থাকবে।
এটা অ্যাডিলেড। যেখানে শ্বেতাঙ্গ সম্প্রদায়ের মুখ্যত বাস এবং যারা অ্যাডিলেড ওভালে উপমহাদেশীয় ‘একদিনের বিশ্বকাপ’ নিয়ে এখনও আলোড়িত হতে পারেনি। শুক্রবার সন্ধেবেলা যেটা ঘটছিল তা একান্তই অ্যাডিলেডবাসীদের নিজস্ব পরব। একে বলে অ্যাডিলেড ফ্রিঞ্জ প্যারেড। সন্ধের প্যারেড শেষ হলে আনুষ্ঠানিক ফেস্টিভ্যাল শুরু। যা সরকারি সমর্থিত তো নিশ্চয়ই কিন্তু মানুষেরও মনের খুব কাছাকাছি উৎসব।
সেই ফ্রিঞ্জ ফেস্টিভ্যালের ভেতর আবার একটা ভাগ রয়েছে। দ্য গার্ডেন অব আনআর্থলি ডিলাইটস। সেখানে ক্যাবারে থেকে শুরু করে মুখে ফুঁ দিয়ে বিকিনি পরিহিত তরুণীর আগুন জ্বালানো— সব রকম আমোদ রয়েছে। একে উইকএন্ড, তার ওপর ফ্রিঞ্জ ফেস্টিভ্যাল। গোটা অ্যাডিলেড যেন রাত্তিরে রাস্তায় নেমে এসেছিল। জায়গায় জায়গায় রাস্তা বন্ধ। ট্যাক্সি পাওয়া যাচ্ছে না। মানুষের দুর্ভোগ। সব একই সঙ্গে হাজির।
ভারত-পাক গড়পড়তা ম্যাচেরও তো বরাবর তাই বৈশিষ্ট্য। ট্যাক্সি পাওয়া যাবে না। অনেক আগে থেকে পুলিশ রাস্তা বন্ধ করে দেবে। প্রচণ্ড ভিড়ে ঠাসা জনতার মধ্যে দিয়ে মাঠে ঢুকতে আর বেরোতে হবে। রোববার ধরে নেওয়া যায় অ্যাডিলেড নামক আয়তক্ষেত্র সাইজের মাঠকে কেন্দ্র করে এ সবই আরও বেশি মাত্রায় ঘটবে। কিন্তু শুক্রবার পর্যন্ত অ্যাডিলেডবাসীদের হাতেই শহরের ভার। উপমহাদেশীয় ফেস্টিভ্যাল দখল নেবে খুব সম্ভবত আরও চব্বিশ ঘণ্টা বাদে।
মোহালিতে গত বিশ্বকাপ সেমিফাইনাল যদি প্রধানমন্ত্রী আর রাষ্ট্রপতিদের উপস্থিতিতে উত্তেজনার থার্মোমিটারে সবচেয়ে বেশি ক্রিকেট-জ্বর উঠিয়ে থাকে, এ বারের ভারত-পাক টেম্পারেচার হল ছিয়ানব্বই! ইমরান খান সে বার সর্বগ্রাসী চাপ সামলানোর কিছু টোটকা দু’দলকে দিয়ে গেছিলেন। স্লিপিং পিল খাবে ম্যাচের আগের রাতে। ম্যাচের আগের দিন বন্ধুদের টিকিট দেওয়া নিয়ে একদম মাথা খারাপ করবে না। আর কাগজ-টিভি থেকে যথাসম্ভব দূরে থাকবে। টিম ইন্ডিয়ার অবশ্য এমনিতেই গোটা বিশ্বকাপে কাগজ পড়ার উপায় ছিল না। মনোবিদ প্যাডি আপটন প্রতিদিন সকালে উঠে হোটেলে প্লেয়ারদের দরজার বাইরে থেকে কাগজগুলো সরিয়ে ফেলতেন।
এ বার এ সব কোনও কিছুরই দরকার হওয়া উচিত নয়। ভারত-পাক ম্যাচ নিয়ে যে পরিমাণ উত্তাপ অবধারিত তৈরি হওয়ার কথা তা তো তৈরি রয়েছেই। হয়তো যুগ-যুগ ধরেই হবে। কিন্তু স্থানীয়র আবেগের প্রাবল্য সাবেকি মাত্রায় একেবারেই নেই। ঐতিহাসিক ভাবে ০-৫ পিছিয়ে থাকায় বেশি চাপে রয়েছে পাকিস্তান। রাহুল দ্রাবিড়ের মতো সচরাচর দৃঢ় ভাবে কোনও পক্ষ না নিতে চাওয়া মানুষেরও মনে হচ্ছে, ভারত পরিষ্কার ফেভারিট ৫৫-৪৫। দ্রাবিড় এখানে থেকে ভারতীয় অনুশীলনে গেলে অবশ্য আবিষ্কার করতেন টিম ইন্ডিয়ার অধিনায়কও চাপে রয়েছেন বিস্তর। ইদানীং ওয়ান ডে-তে রান পাচ্ছেন না। এ দিন বোর্ড নির্বাচিত চাপিয়ে দেওয়া ডিরেক্টর রবি শাস্ত্রীর সঙ্গে টেকনিক্যাল পরিমার্জন নিয়ে কিছুক্ষণ আলোচনাও করলেন। যা শাস্ত্রী-রাজে এই প্রথম! সরি, ধোনি-রাজে এই প্রথম। যা ঘটছিল সেন্ট পিটার্স কলেজ মাঠে।
মাত্র কয়েক কিলোমিটার উত্তরের অ্যাডিলেড ওভালে তখন শাহিদ আফ্রিদি বিদেশি সাংবাদিককে ক্ষোভের সঙ্গে বলছেন, “আমাদের দেশের সাংবাদিকরা একটা ছোট জরিমানা দেওয়ার ঘটনা ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে কোথায় নিয়ে চলে গেল।” ড্রেসিংরুমের ওধারে পাকিস্তান বোলিংয়ের আপাতত প্রধান ভরসা মহম্মদ ইরফানকে তখন সবাই ছেঁকে ধরেছে। অটোগ্রাফ নেওয়ার ফাঁকে আবদার, ম্যাচ জেতাতে হবে। ইরফান এত বড় চাপ কখনও নেননি। কেউ না কেউ তাঁর সামনে সব সময় ছিলেন। হয় জুনেইদ খান, নয় সইদ আজমল। নয়তো হাফিজ। “আল্লাহ্ তালাহ যা করেন,” বলতে বলতে লজ্জিত ভাবে ইরফান সেঁধিয়ে গেলেন ড্রেসিংরুমে।
সমর্থকদের ওভালে ঢোকার কোনও নিষেধাজ্ঞা ছিল না। তাতেও অতীতের অনুপাতে কোনও ভিড় হয়নি। বেশির ভাগই শুক্র বা শনিবার রাতে অ্যাডিলেড ঢুকছেন। পাকিস্তান হোটেলে ফেরার সময় দেখা গেল মৌলবী জাতীয় পোশাক-আশাক পরে অনেকে দলের সঙ্গে। সত্তর দশকের সেই অক্সফোর্ড শিক্ষিত-অভিজাত ইংরেজি বলিয়ে, কখনও মাঠের মধ্যে নমাজ না পড়াদের গ্রুপটা একেবারেই ডাইনোসর হয়ে গিয়েছে পাকিস্তান টিমে। আর ততই যেন বেড়েছে ভাগ্য আর ধর্ম-নির্ভরতা!
মিসবা অবশ্য প্রাণপণ চেষ্টা করছেন দলকে ০-৫ নিয়ে মাথা না ঘামাতে দিয়ে বরং এ দেশে বিরানব্বইয়ের গৌরবজনক অধ্যায় থেকে প্রেরণা দিতে। পাকিস্তান ড্রেসিংরুম প্রায়ই আলোচনা করে, ভাগ্যের সাহায্য ছাড়া এ দেশে বিশ্বকাপ জেতা কিছুতেই তাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। সে বার প্রথম পাঁচ ম্যাচের মধ্যে চারটে ম্যাচই তারা হেরেছিল। যে সেমিফাইনাল ম্যাচ নিউজিল্যান্ডে জেতানোর জন্য ইনজামাম আজও এত প্রসিদ্ধ, সেটা তিনি টেনশন আর ব্যর্থতার ভয়ে খেলতেই অস্বীকার করেছিলেন। ইমরান নিজে না পেরে মুস্তাক আহমেদের মাধ্যমে ইনজিকে রাজি করান। জাভেদ মিয়াঁদাদ ফাইনালে রিভার্স সুইপ মারতে গিয়ে ৫৮ রানে আউট হয়ে যান। গোটা বিশ্ব আজও গ্যাটিংকে ইডেনের রিভার্স সুইপের জন্য দোষে। মিয়াঁদাদ একই অপরাধ কাপ ফাইনালে করে ছাড় পেয়ে যান যেহেতু টিম চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। ইমরানের ক্যাচ ফাইনালে ফেলে দেন গুচ। তখন পাক অধিনায়কের রান দশও পেরোয়নি। আর তিনি করে যান ৭২। মিসবা এ সবই বলে বোঝাতে চেয়েছেন, ভাগ্য তার মতো করে থাকবে। ইতিহাস তার মতো রয়েছে। সে সব নিয়ে না ভেবে নিজেদের কাজটা করে যাও।
শুক্রবার অ্যাডিলেড ওভালে ঢোকার সময় দেখলাম পাশের টেনিস কোর্টে দুই প্রতিবন্ধী হুইলচেয়ারে বসে টেনিস খেলছেন। চেয়ারে বসেই ফোরহ্যান্ড ক্রসকোর্ট মারছেন। সার্ভ করছেন। ওভালের ভেতরে আরও বিস্ময়কর কিছু। নীচের তলায় ব্র্যাডম্যান জাদুঘরে ঢোকার মুখে স্থানীয় ফুটবল তারকার বিশাল ছবি। ফুটবল নিয়ে লেখা। ব্র্যাডম্যানের ডেরায় লারউড, এই অবধি ঠিক ছিল। এ বার ফুটবলও আস্তানা গাড়ল। চিরবিস্ময়কর এই দৃশ্য দেখতে দেখতে খবর পাওয়া গেল এমনই অভাবিত কিছুর। মাইকেল ক্লার্কের সঙ্গে নাকি ফিটনেস নিয়ে জোর লেগেছে প্রধান অস্ট্রেলীয় নির্বাচক রডনি মার্শের। ক্লার্কের নিজেকে ফিট ঘোষণা করা মানতে না চেয়ে কালকের ইংল্যান্ড ম্যাচে তাঁকে বাইরে রেখেছেন মার্শ, তা নিয়েই ক্লার্কের রাগ।
ব্রিসবেন থেকে বিখ্যাত অস্ট্রেলীয় ক্রিকেট প্রতিনিধি বললেন, ক্লার্ক কন্ট্রোল ছাড়া কিছু বোঝে না। দল নির্বাচন থেকে নিজের ফিটনেস—সবটাই ও নিজে করবে। শুনে মনে হল ধোনি সম্পর্কে ভারতীয় মিডিয়া তো অবিকল এক কথা বলে— নির্বাচক মনোনয়ন থেকে টিমের জার্সির নতুন ডিজাইন, কোচ কে হবে ঠিক করা, সবটা ও করবে।
বিশ্বকাপ শুরুর ঠিক আগে এত সব তাজ্জব ঘটনার সমাহার। অ্যাডিলেড ওভালের বাইশ গজও কি রবিবাসরীয় কোনও চমক নিয়ে ওঁত পেতে থাকবে? কাছের সমুদ্র থেকে সামুদ্রিক পাখিগুলো বিরানব্বই বিশ্বকাপের মতো আর অ্যাডিলেড ওভাল উইকেটে এসে বসবে না, ক্রিকেট টিভি কভারেজে ব্যবহৃত অত্যাধুনিক স্পাইক্যাম বোধহয় তাদের চিরতরে সরিয়ে দিয়েছে। কাল সারা পৃথিবীর মতো অ্যাডিলেডেও ভ্যালেন্টাইনস্ ডে পালিত হবে। এখানে বসে এই দু’টোই শুধু নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে! তাই না?