উৎসব: জয়ের নায়কের ঘাড়ে লাফিয়ে উঠে উচ্ছ্বাস সের্জিও র্যামোসের। মঙ্গলবার রাতে বের্নাবাউতে। এপি
ভয়ঙ্কর সুন্দর!
ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো সম্পর্কে এর চেয়ে সেরা ব্যাখ্যা আর কী হবে!
সৃষ্টি এবং আগ্রাসী মানসিকতার আশ্চর্য মিশেল সি আর সেভেনের খেলায়। নির্মম ভাবে বিপক্ষের রক্ষণ যেমন ভেঙে ফেলে। তেমনই অবিশ্বাস্য দক্ষতায় বল জড়িয়ে দেয় জালে।
রোনাল্ডো মানেই দুর্ধর্ষ ফিটনেস, হার না মানা মানসিকতা।
লিওনেল মেসির মতো চোখ ধাঁধানো স্কিল হয়তো রোনাল্ডোর পায়ে নেই। তা সত্ত্বেও বিশ্বের অন্যতম সেরা স্ট্রাইকার মকুট ওর মাথায়। পেলে, জর্জ বেস্টের মতো সর্বকালের সেরাদের মধ্যেও থাকবে সি আর সেভেন।
স্ট্রাইকারদের সাফল্যের প্রধান শর্তই হচ্ছে— এক) নিশানা অব্যর্থ। দুই) প্রতিপক্ষের ডিফেন্ডারদের নজর থেকে নিজেকে লুকিয়ে রাখার দক্ষতা। তিন) দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা। রোনাল্ডো তিন জায়গাতেই দুরন্ত।
মঙ্গলবার রাতে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ সেমিফাইনালে আতলেতিকো দে মাদ্রিদের বিরুদ্ধে রোনাল্ডোর হ্যাটট্রিক এই মুহূর্তে বিশ্ব ফুটবলে সবচেয়ে চর্চিত বিষয়। এক জন প্রাক্তন স্ট্রাইকার হিসেবে আমাকে মুগ্ধ করেছে ওর গোল করার বৈচিত্র।
মেসি না রোনাল্ডো— কে শ্রেষ্ঠ সেই তর্ক চলতেই থাকবে। পেনাল্টি বক্সের কাছাকাছি জায়গায় বল পেলে মেসি ও রোনাল্ডো দু’জনের অধিকাংশ শটই হয়তো গোলে থাকবে। কিন্তু সি আর সেভেন এগিয়ে রয়েছে হেড করার দক্ষতায়। রোনাল্ডো বিশ্বের সফলতম স্ট্রাইকার শুধু নয়, অসাধারণ অ্যাথলিটও। চ্যাম্পিয়ন্স লিগ সেমিফাইনালে মাদ্রিদ ডার্বিতে দশ মিনিটে রোনোল্ডোর হেডে গোলটা দেখে মনে হল যেন কেউটের ছোবল!
আরও পড়ুন: আমি রক্তমাংসের মানুষ, জিতিয়ে বললেন নায়ক
আতলেতিকোর ডিফেন্ডারদের নজর এড়ানোর জন্য রোনাল্ডো ছ’গজ বক্সের ধারেকাছে ছিল না। কিন্তু ক্যাসিমিরো-র সেন্টার করার সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যুৎ গতিতে এসে হেড করল।
রোনাল্ডোর প্রথম গোলটা দেখে আমার অমল (দত্ত) স্যারের কোচিংয়ের কথাই মনে পড়ে যাচ্ছিল। আমাদের স্পট জাম্প যাতে ভাল হয় তার জন্য বালির উপর প্র্যাকটিস করাতেন উনি। কারণ, বালিতে অনুশীলন করলে কোমর ও পায়ের মাংসপেশি শক্তিশালী হয়। রোনাল্ডো স্পট জাম্প করে শূন্যে ৩-৪ ফিট উপরে উঠতে পারে। এটা কিন্তু এক দিনে সম্ভব হয়নি। নিরলস পরিশ্রম এবং অধ্যবসায় ওকে এই উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছে।
৭৩ মিনিটে রোনাল্ডোর দ্বিতীয় গোলটার কথা ভাবুন— প্রতিপক্ষ ডিফেন্ডারের পায়ে লেগে বলটা প্রথমে লাফিয়ে উঠেছিল। তার পরে মাটিতে পড়েই শেন ওয়ার্নের স্পিনের মতো ঘুরছিল। রোনাল্ডো চলতি বলেই শট নিল। এক জন স্ট্রাইকারের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া। ও জানত বলটা রিসিভ করতে গেলে বেরিয়ে যাবে। তাই ঝুঁকি নেয়নি।
তৃতীয় গোল রোনাল্ডো করল ম্যাচ শেষ হওয়ার চার মিনিট আগে। মাঝমাঠ থেকে লুকাস ইগলেসিয়াস-কে বলটা দিয়েই ও ঢুকে পড়েছিল পেনাল্টি বক্সে। তার পরে লুকাসের ব্যাক পাস ঠেলে দিল গোলে। রিয়ালে জিনেদিন জিদানের মতো কিংবদন্তিকে ম্যানেজার হিসেবে পেয়ে রোনাল্ডোর খেলা আরও আকর্ষণীয় হয়েছে। বছর তিনেক আগে ব্রাজিল বিশ্বকাপে দেখা পর্তুগাল অধিনায়কের চেয়ে এই রোনাল্ডোকে আরও ভয়ঙ্কর। অভিজ্ঞতার সঙ্গে আত্মবিশ্বাসও কয়েকগুণ বেড়ে গিয়েছে যেন।
রোনাল্ডো আরও একটা বড় গুণ, আদ্যপান্ত ‘টিম ম্যান’। রিয়ালে না হয় করিম বেঞ্জেমা, গ্যারেথ বেল-এর মতো ফুটবলাররা ওর সতীর্থ। পর্তুগালকে কার্যত একাই ইউরো কাপে চ্যাম্পিয়ন করেছিল ও। ফ্রান্সের বিরুদ্ধে ফাইনালের শুরুতেই চোট পেয়ে মাঠ ছাড়তে হলেও সাইড লাইনে দাঁড়িয়ে সারাক্ষণ সতীর্থদের উৎসাহ দিয়ে গিয়েছিল। একই ছবি দেখা গেল মঙ্গলবার রাতে সান্তিয়াগো বের্নাবাউ-তে। প্রথম পর্ব শেষ হতে না হতেই ফিরতি লেগের জন্য সতীর্থদের উজ্জীবিত করতে শুরু করে দিল।
কে বলবে ম্যাচটা তখন রিয়াল তিন গোলে জিতছিল!