সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। ফাইল চিত্র।
ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড থেকে উপেক্ষিত, অপসারিত হলেও এখনই প্রশাসনিক জীবন থেকে সন্ন্যাস নিতে চাইছেন না সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। বরং ক্রিকেটজীবনের মতোই প্রত্যাবর্তনের রাস্তা খুঁজতে শুরু করেছেন তিনি।
বিশ্বস্ত সূত্রের খবর, বোর্ডে উপেক্ষিত, অপমানিত সৌরভ রাজ্য ক্রিকেট সংস্থা অর্থাৎ সিএবির প্রেসিডেন্ট হিসেবে ফিরতে পারেন। বৃহস্পতিবার সিএবি-তে এসেও তিনি এই ইঙ্গিত দিয়ে গিয়েছেন। সদস্যদের বলে গিয়েছেন, যদি সিএবি-তে বিরোধী গোষ্ঠী সক্রিয় হয়, যদি নির্বাচনের দামামা বাজে ইডেনে, তা হলে আর কোনও দ্বিধা না-করে তিনি নিজে ‘মাঠে নামতে চান’। যদি নির্বাচনী দামামা না-ও বাজে, তা হলেও কি তিনি প্রেসিডেন্ট পদে দাঁড়াতে পারেন? সৌরভ নিজে সম্ভবত চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত এখনও নেননি। তবে কারও কারও মত, নির্বাচন না-হলেও প্রেসিডেন্ট পদে আগ্রহী হতে পারেন। কারণ, এ ছাড়া ক্রিকেট প্রশাসনের ময়দানে ভেসে থাকার আর উপায় কী পড়ে থাকছে তাঁর সামনে!
সৌরভ নিজেও বেশ বুঝতে পারছেন, বোর্ডের মসনদ হারানোর পরে আইসিসি চেয়ারম্যানের দৌড়েও বেশ পিছিয়ে পড়েছেন। তার জন্যও তো সমর্থন লাগবে দেশের ক্ষমতাশালী রাজনৈতিক অংশের। বোর্ড প্রেসিডেন্টের মতো বকলমে তাঁরাই যে ঠিক করে দেবেন, আইসিসি পদের জন্য লড়া হলে ভারত থেকে কে মনোনীত হবেন। যেখানে যুগ্ম-সচিব ঠিক হচ্ছে না হাইকমান্ডের নির্দেশ ছাড়া, সেখানে আইসিসি চেয়ারম্যান তো অনেক বড় ব্যাপার! ‘ওই ফোনটা’ না এলে কিছুই হবে না।
ওয়াকিবহাল মহলের মত, সৌরভকে যদি আইসিসির ‘উইকেট’ বাঁচাতে হয় বিজেপি হাইকমান্ডের বরাভয় জোগাড় করতে হবে। আর তা পেতে গেলে তাঁকেও বিনিময়ে ‘কিছুর প্রতিশ্রুতি’ দিতে হবে। ক্রিকেট জীবনের সেই স্টেপ আউট করে হেলায় স্পিনারকে গ্যালারিতে ফেলার মতো সহজ ব্যাপার মোটেও নয়। কারণ, সৌরভ এখনই রাজনীতির ময়দানে নামতে চান না। তবে এক অনুষ্ঠানে তাঁর মুখে শোনা গিয়েছে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নাম। তিনি বলেন, ‘‘লর্ডসে সেঞ্চুরি করার সময় আমি মাত্র ১০ রান করেএগোচ্ছিলাম। শুরুতেই কেউ সেঞ্চুরির জন্য ঝাঁপায় না। কিংবদন্তিরাও এক দিনে কিংবদন্তি হননি। সচিন এক দিনে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ক্রিকেটার হয়নি। আম্বানি এক দিনে সাফল্য পাননি। নরেন্দ্র মোদীও এক দিনে হননি। প্রত্যেকটি ধাপে এগোতে হয়। নিজেকে প্রত্যেক মুহূর্তের জন্য তৈরি থাকতে হয়।’’ ভারতীয় বোর্ডের অন্দরমহলের যা খবর, আইসিসি চেয়ারম্যানের দৌড়ে সৌরভের চেয়ে বেশি এগিয়ে এখন অনুরাগ ঠাকুর বা এন শ্রীনিবাসন। তা সে যতই অনুরাগ সক্রিয় ভাবে বিজেপি পার্টির সঙ্গে ব্যস্ত থাকুন, কেন্দ্রের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী হোন আর শ্রীনির যতই প্রবল শারীরিক অসুস্থতা থাকুক। আর একটা বিকল্প হচ্ছে এ বারে আইসিসি চেয়ারম্যানের জন্য লড়াই না করা। এমনও হতে পারে এ বারে ছেড়ে দিয়ে তিন বছর পরে অন্য কাউকে আইসিসি প্রধান করার জন্য ঝাঁপাল ভারত। এই ‘অন্য কেউ’ অমিত শাহ পুত্র জয় কি না তা নিয়েও চর্চা শুরু হয়ে গিয়েছে নানা মহলে।
বোর্ড থেকে রাজ্য সংস্থার প্রধান হওয়া নিশ্চয়ই উন্নতি নয়। তবু কারও কারও মত, এই পদক্ষেপ করলে ক্রিকেট প্রশাসনে অন্তত ভেসে থাকতে পারবেন সৌরভ। তা ছাড়া যে ভাবেজয় শাহ, এন শ্রীনিবাসনেরা রীতিমতো অবজ্ঞা, অবহেলা, অপমান করে তাঁকে প্রেসিডেন্ট পদ থেকে সরিয়েছেন, তা-ও মেনে নিতে পারছেন না সৌরভ। বাকি সকলকে মোটামুটি ভাবে রেখে দেওয়া হয়েছে, মাঠের বাইরে চলে গিয়েছেন একমাত্র তিনি। বৃহস্পতিবার দুপুরেই একটি অনুষ্ঠানে সৌরভ বলেন, সারাজীবন কেউ পদে থাকতে পারে না। তিনি বোর্ড প্রধানের পদ উপভোগ করেছেন, সফল হয়েছেন বলেও মনে করেন। কিন্তু এটা তাঁর মনের কথা হলে এটাও মানতে হবে যে, অনিল কুম্বলের অপসারণ একেবারেই চাননি বিরাট কোহলি। দ্বিধার কোনও জায়গাই নেই। বোর্ডের মসনদ হারিয়ে সৌরভ আহত, রক্তাক্ত, অপমানিত।
আইনজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে নতুন গঠনতন্ত্র অনুযায়ী খতিয়ে দেখা হচ্ছে, সৌরভের সিএবির পদে বসা নিয়ে কোনও জটিলতা আছে কি না। সংশোধিত গঠনতন্ত্র অনুসারে তিনি তা পারেন কি না। যদি দেখা যায়, নিয়মের দিক থেকে কোনও বাধা নেই তা হলে ফের রাজ্য সংস্থার সর্বোচ্চ পদে বসার সম্ভাবনা আরও গতি পাবে। সৌরভ এর আগে জগমোহন ডালমিয়ার আমলে সিএবি সচিব হয়েছেন। ডালমিয়ার মৃত্যুর পরে সংস্থার প্রেসিডেন্ট হন। সিএবি-তে তাঁর ছয় বছর হয়ে গিয়েছে। টানা ছয় বছরের মেয়াদের পরেই তিনি বোর্ডে যান প্রেসিডেন্ট হিসেবে। পদাধিকারীদের টানা মেয়াদ বাড়ানোতে সম্মতি জানিয়ে সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টও নতুন রায় দিয়েছে। সে সব খতিয়ে দেখা হচ্ছে। যাতে সৌরভের ইডেনের মসনদে অন্তত বসানোর ব্যবস্থা তৈরি রাখা যায়। বিরোধী পক্ষ সক্রিয় ভাবে নির্বাচনের দামামা বাজায় কি না, সে দিকেও চোখ রাখছে ময়দান। আবার বোর্ডে যেমন বিজেপি নেপথ্যে সক্রিয় ছিল বলে ধরে নেওয়া হচ্ছে, তেমনই সিএবি নির্বাচনে তৃণমূল তথা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কী ভূমিকা থাকতে পারে, তা-ও দেখার। ডালমিয়ার প্রয়াণের পরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঘোষণাতেই সৌরভ সিএবি প্রেসিডেন্ট পদে বসেছিলেন।
এমনিতে ঠিক ছিল, সৌরভের দাদা স্নেহাশিস গঙ্গোপাধ্যায় এ বার সিএবি প্রেসিডেন্ট হবেন। কিন্তু রাজ্য সংস্থার কাছেও এখন সৌরভের বিষয়টি সম্মানের লড়াইয়ে দাঁড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা। তাই বাংলার রঞ্জি ট্রফি জয়ের বছরে ফাইনালে যেমন দাদাকে জায়গা করে দিতে হয়েছিল ভাইয়ের জন্য, ক্রিকেট প্রশাসনেও এ বার তার পুনরাবৃত্তি ঘটলে অবাক হওয়ার থাকবে না।