পুজারারা খেলবেন বক্সিং ডে টেস্ট। ফাইল ছবি
রবিবার থেকে বিশ্বের দু’ প্রান্তে শুরু হচ্ছে দু’টি টেস্ট। প্রতি বছর ২৬ ডিসেম্বর নিয়ম করে এই দুটি দেশে শুরু হয় টেস্ট ম্যাচ। একটি অস্ট্রেলিয়ায়, অন্যটি দক্ষিণ আফ্রিকায়। নাম ‘বক্সিং ডে টেস্ট’। নিউজিল্যান্ডেও এই টেস্ট হয়। তবে এখনও পর্যন্ত ধারাবাহিকতায় তা পিছিয়ে।
দক্ষিণ আফ্রিকার সেঞ্চুরিয়নের সুপার স্পোর্ট পার্কে ২৬ ডিসেম্বর নামছে ভারত। সেটি এ বারের সিরিজের প্রথম টেস্ট। সেই দিন মেলবোর্নে অস্ট্রেলিয়া খেলবে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে। আগের দুটি টেস্টে জেতার আত্মবিশ্বাস নিয়ে বক্সিং ডে টেস্টে নামবে অস্ট্রেলিয়া।
দক্ষিণ আফ্রিকায় প্রথম বক্সিং ডে টেস্ট হয় ১৯১৩ সালে। জোহানেসবার্গে ইংল্যান্ডের কাছে দক্ষিণ আফ্রিকা হারে ইনিংস ও ১২ রানে। তারপর সে দেশে ৭৯ বছর আর বক্সিং ডে টেস্ট হয়নি।
দক্ষিণ আফ্রিকায় প্রথম বক্সিং ডে টেস্ট হয় ১৯১৩ সালে।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে প্রত্যাবর্তনের পর থেকে দক্ষিণ আফ্রিকাতে ‘বক্সিং ডে টেস্ট’ ম্যাচ হয় নিয়ম করে। ১৯৯২ সালে প্রথম ম্যাচটি হয়েছিল পোর্ট এলিজাবেথে। ১৯৯৪ সালে তা ডারবানে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। দক্ষিণ আফ্রিকা ক্রিকেট বোর্ড মনে করেছিল, যেহেতু বড়দিনে ডারবানেই সবথেকে বেশি মানুষ ছুটি কাটাতে আসেন, তাই সেখানেই বক্সিং ডে টেস্ট করা হবে। ১৯৯৫ সালে আবার তা পোর্ট এলিজাবেথের সুপার স্পোর্ট পার্কে ফিরিয়ে আনা হয়। ১৯৯৬ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত ডারবানেই নিয়মিত ভাবে বক্সিং ডে টেস্ট হয়। তবে ১৯৯৩, ১৯৯৭, ২০০১, ২০০৫, ২০০৮ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় বক্সিং ডে টেস্ট হয়নি। কারণ এই পাঁচ বছর দক্ষিণ আফ্রিকা বক্সিং ডে টেস্ট খেলেছিল অস্ট্রেলিয়ায়।
পরের দিকে ডারবানে খারাপ আলো, বৃষ্টির জন্য বার বার বক্সিং ডে টেস্টে বিঘ্ন ঘটেছে। সেই কারণে ২০১৪ সাল থেকে আবার তা পোর্ট এলিজাবেথে স্থানান্তরিত করা হয়। ২০১৮ সাল থেকে বক্সিং ডে টেস্ট হচ্ছে সেঞ্চুরিয়নের সুপার স্পোর্ট পার্কে। বিরাট কোহলীরাও এ বার সেখানেই বক্সিং ডে টেস্ট খেলবেন।
এখনও পর্যন্ত দক্ষিণ আফ্রিকায় ভারত মোট পাঁচটি বক্সিং ডে টেস্ট খেলেছে। চারটি ম্যাচেই হারতে হয়েছে ভারতকে।
এখনও পর্যন্ত দক্ষিণ আফ্রিকায় ভারত মোট পাঁচটি বক্সিং ডে টেস্ট খেলেছে। চারটি ম্যাচেই হারতে হয়েছে ভারতকে। শুধু ২০১০ সালে ভারত জিতেছিল ৮৭ রানে। চারটি হারই ছিল বড় ব্যবধানে। ১৯৯২ সালে ভারত হারে ৯ উইকেটে, ১৯৯৬ সালে ৩২৮ রানে, ২০০৬ সালে ৩১০ রানে, ২০১৩ সালে ১০ উইকেটে।
ক্রিকেটে ‘বক্সিং ডে’-এর জন্ম অস্ট্রেলিয়ায়। ‘বক্সিং ডে’-র প্রথম হদিশ পাওয়া যায় ১৮৬৫ সালে। শেফিল্ড শিল্ডে মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ডে (এমসিজি) ভিক্টোরিয়া এবং নিউ সাউথ ওয়েলসের মধ্যে ম্যাচ ছিল। সেই ম্যাচ ২৬ ডিসেম্বর শুরু হওয়ার কথা ছিল না। ম্যাচের একটি দিন ছিল মাত্র। কিন্তু পরিবারের সঙ্গে বড়দিনের ছুটি কাটাতে পারবেন না বলে নিউ সাউথ ওয়েলসের ক্রিকেটাররা মন খারাপ করে বসে থাকেন। তাঁদের দাবি মেনে সেই ম্যাচ বড়দিনের পরের দিন শুরু হয়েছিল। ‘টাইমলেস ম্যাচ’ শেষ হয়ে গিয়েছিল তিন দিনে। ভিকোটেরিয়া ইনিংস ও ২০ রানে জিতে যায়।
ক্রিকেটে ‘বক্সিং ডে’-এর জন্ম অস্ট্রেলিয়ায়।
প্রথম বক্সিং ডে টেস্ট হয় মেলবোর্নে ১৯৫০-৫১ সালের অ্যাশেজে। সেই ম্যাচও ২৬ ডিসেম্বর শুরু হয়নি। ম্যাচ হয়েছিল ২২ থেকে ২৭ ডিসেম্বর (তৃতীয় দিনের পর একটি দিন বিশ্রামের জন্য দেওয়া হত বলে তখন টেস্ট ম্যাচ ছ’ দিন ধরে হত)। চতুর্থ দিনের খেলাকে ‘বক্সিং ডে’ বলা হয়েছিল।
১৯৫৩ থেকে ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত মেলবোর্নে কোনও বক্সিং ডে টেস্ট হয়নি। ১৯৬৮ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে বক্সিং ডে টেস্ট হয়েছিল। কিন্তু ১৯৬৯ থেকে ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত ফের বক্সিং ডে টেস্ট হয়নি। কখনও ২৬ ডিসেম্বর ম্যাচ শুরু করা যায়নি, কখনও তার আগেই ম্যাচ শেষ হয়ে গিয়েছিল, কখনও সেই ম্যাচ হয়েছিল অ্যাডিলেড ওভালে।
এর পর ১৯৭৪-৭৫ অ্যাশেজ সিরিজে ছ’টি টেস্ট ছিল। সবকটি ম্যাচ নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে যাতে শেষ করা যায়, সেই কারণে মেলবোর্নে তৃতীয় টেস্ট দেওয়া হয়েছিল ২৬ ডিসেম্বর থেকে। আধুনিক বক্সিং ডে টেস্টের সেটিই শুরু। তবে ১৯৮০ সালে বক্সিং ডে টেস্ট নিয়ে মেলবোর্ন ক্রিকেট ক্লাবের সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট বোর্ডের চুক্তি হয়। তার পর থেকে প্রতি বছর নিয়ম করে এমসিজি-তে ২৬ ডিসেম্বর থেকে টেস্ট শুরু হয়।
বড়দিনের পরের দিন এই টেস্টের এই রকম নামকরণ হওয়ার পিছনে বেশ কয়েকটি তত্ত্ব আছে।
ধারাবাহিকতায় এক বারই ছেদ পড়ে। ১৯৮৯ সালে বক্সিং ডে-তে টেস্ট ম্যাচের বদলে অস্ট্রেলিয়া এবং শ্রীলঙ্কার মধ্যে একটি এক দিনের ম্যাচ খেলা হয়।
২০১৯ সালের ডিসেম্বরে ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া জানায়, পরের বছর অর্থাৎ ২০২০ সাল থেকে প্রতি বছর বক্সিং ডে টেস্টের সেরাকে তাদের দেশের প্রাক্তন ক্রিকেটার জনি মুল্লাঘের নামে মুল্লাঘ পদক দেওয়া হবে।
অনেক স্মরণীয় ঘটনার সাক্ষী বক্সিং ডে টেস্ট। ১৯৮৫ সালের অ্যাশেজে বক্সিং ডে টেস্টেই অভিষেক হয়েছিল স্টিভ ওয়ের। ১৯৮৮ সালে ম্যালকম মার্শাল ৩০০ টেস্ট উইকেট নিয়েছিলেন। ১৯৯৪ সালে শেন ওয়ার্ন অ্যাশেজে হ্যাটট্রিক করেছিলেন। ১৯৯৫ সালে এই টেস্টেই অস্ট্রেলিয়ার আম্পায়ার ড্যারেল হেয়ার শ্রীলঙ্কার স্পিনার মুথাইয়া মুরলীধরনকে বল ছোড়ার অভিযোগে বার বার ‘নো বল’ ডাকেন। সেই নিয়ে তোলপাড় হয় ক্রিকেট বিশ্ব। ২০০৬ সালে বক্সিং ডে টেস্টেই শেন ওয়ার্ন ৭০০ টেস্ট উইকেট নেন। এখন অস্ট্রেলিয়ার খেলাধুলোয় বক্সিং ডে টেস্ট অন্যতম জনপ্রিয়।
অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা ছাড়াও বক্সিং ডে টেস্ট হয় আর এক কমনওয়েলথ দেশ নিউজিল্যান্ডে। ১৯৯৮ সাল থেকে শুরু করে ২০০৩ সাল পর্যন্ত নিয়ম করে সে দেশে বক্সিং ডে টেস্ট হয়েছে। তারপর থেকে আর নিয়মিত টেস্ট হয়নি। বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে সাদা বলের ক্রিকেটকে।
বড়দিনের পরের দিন এই টেস্টের এই রকম নামকরণ হওয়ার পিছনে বেশ কয়েকটি তত্ত্ব আছে। অনেকে মনে করেন, বড়দিন, অর্থাৎ ২৫ ডিসেম্বর যে সব উপহার পাওয়া যায়, সেগুলি আর সেই দিন দেখার সময় পাওয়া যায় না। তাই উপহারের বাক্স (বক্স) খেলা হয় পরের দিন, অর্থাৎ ২৬ ডিসেম্বর। বক্স খোলা হয় বলে এর নাম হয়েছে ‘বক্সিং ডে’।
দ্বিতীয় একটি তত্ত্ব হল, ২৫ ডিসেম্বর অনেকে খেটে কাজ করেন, বিশেষ করে পরিচারকরা। সেই কাজের জন্য তাঁদের পরের দিন ২৬ ডিসেম্বর পুরস্কারের বাক্স দেওয়া হয়। সেই কারণেও এর নাম ‘বক্সিং ডে’।