সিকান্দারের বোলিংয়ে হারল পাকিস্তান। ফাইল ছবি
জীবন যদি রুটিন মেনে চলত তা হলে হয়তো পার্থে বল হাতে পাকিস্তানকে শেষ করতে নয়, যুদ্ধক্ষেত্রে বিমান নিয়ে উড়ে বেড়াতে দেখা যেত সিকান্দার রাজাকে। ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্ন তিনি কোনও দিনই দেখেননি। চোখে ছিল পাকিস্তানের বিমানবাহিনীতে প্রশিক্ষণ নিয়ে যুদ্ধবিমানের চালক হওয়ার। কিন্তু সেই স্বপ্ন অঙ্কুরেই বিনাশ হয়ে যায়। জীবন রাজাকে নিয়ে যায় অন্য পথে। নীল দিগন্তের বদলে তাঁর বিচরণক্ষেত্র এখন সবুজ ঘাস আর ২২ গজ। সেই রাজা এখন শুধু ক্রিকেটারই নন, বৃহস্পতিবার হারিয়ে দিলেন তাঁরই জন্মদেশ পাকিস্তানকে। রাজার তিন উইকেট ম্যাচে পার্থক্য গড়ে দিল।
পাকিস্তানের শিয়ালকোটে জন্ম রাজার। বড় হওয়া সেখানেই। পাকিস্তানের লোয়ার টোপায় তিন বছর বিমানবাহিনীর বোর্ডিং স্কুলে পড়াশোনা করেছেন। শেষ ধাপে গিয়ে ব্যর্থ হন চোখের সমস্যার জন্য। রাজার ‘বাইলেনট্রিকাল ওপাসিটি’ রয়েছে। অর্থাৎ বেশি উচ্চতায় বিমান ওড়ানোর সময় সামনে কোনও বস্তু চলে এলে রাজা সেটি দেখতে পাবেন না। প্রশিক্ষকরা সে সময় তাঁকে অনেক সান্ত্বনা দেন। বিমানবাহিনীতে অন্য কাজ করতে বলেন। রাজার জবাব ছিল, “আমি এখানে যুদ্ধবিমানের পাইলট হতে এসেছি। সেটা হতে না পারলে থাকার দরকার নেই।”
এর পর রাজা ঠিক করেন তিনি সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হবেন। স্কটল্যান্ডের একটি কলেজে ভর্তি হন। সেই সময়েই রাজার গোটা পরিবার জ়িম্বাবোয়েতে চলে যায়। স্থানীয় কলেজ এবং ক্লাবে সেই সময় থেকেই ক্রিকেট খেলা শুরু রাজার। কখনওই পেশাদার ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্ন দেখেননি। জ়িম্বাবোয়েতে ফিরে সেখানেও ক্রিকেট খেলতে থাকেন।
এর পরেই আসে চমক। এক দিন ক্লাবের সতীর্থদের সঙ্গে থ্রো ডাউন সেশন করার মাঝে সে দেশের টি-টোয়েন্টি লিগের ক্লাব সাদার্ন রক্সের চেয়ারম্যান রাজাকে দেখে ফেলেন। তিনি তাঁর ক্লাবের নেটে রাজাকে অনুশীলনে আসতে বলেন। পর দিন সকালে তিন ঘণ্টার সড়কপথে অনুশীলনে যান রাজা।
কয়েক সপ্তাহ পরেই তিনি ব্রায়ান লারার সঙ্গে ক্লাবের হয়ে ওপেন করা শুরু করেন। প্রথম ম্যাচেই ৪০ বলে ৯৩ রানের ঝোড়ো ইনিংস খেলেন। সেই শুরু। ধীরে ধীরে সুযোগ খুলে যায় জ়িম্বাবোয়ের জাতীয় দলে খেলার। ওপেনার হিসাবে শুরু করলেও ধীরে ধীরে মাঝের সারিতে ব্যাটিং করতে থাকেন। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে একটি টেস্টে শতরান করেন। পাশাপাশি শান দিতে থাকেন অফ স্পিন বোলিংয়ে।
অনেকেই রাজার বোলিংয়ের সঙ্গে সুনীল নারাইনের মিল খুঁজে পেয়েছেন। রাজা নিজেও নারাইনের ভক্ত। ক্যারিবিয়ান বোলারের মতোই বল ধরা হাতটাকে পিছনে লুকিয়ে রেখে দুলকি চালে এগিয়ে আসেন। শেষ মুহূর্তে হাত থেকে বল বেরোয়, যাতে ব্যাটার বুঝতে না পারেন কী ধরনের বল আসতে চলেছে। বছর দুয়েক আাগে ম্যালিগন্যান্ট টিউমার ধরা পড়েছিল রাজার। সুস্থ হওয়ার পর বোলিং অ্যাকশন বদলাতে হত। তখনই নারাইনের সাহায্য নিয়ে নিজের বোলিং অ্যাকশন বদলে ফেলেন রাজা। সেই দিয়েই পাকিস্তান ম্যাচে এসেছে সাফল্য।
ম্যাচের পর রাজা বলেছেন, “অনেক দেরিতে ক্রিকেট খেলা শুরু করেছি। এখন সময়টা কাজে লাগানোর চেষ্টা করছি। উপরের দিকে থাকা দেশগুলির সঙ্গে খেলার বেশি সুযোগ পাই না। ফ্লাডলাইটে খেলাও আমাদের কাছে স্বপ্ন। পার্থে প্রথম বার ম্যাচ খেলতে নামলাম। সেখানে দলকে জেতাতে পেরে খুব ভাল লাগছে।”
রাজা জানিয়েছেন, ম্যাচের আগে রিকি পন্টিংয়ের কিছু কথা তাঁকে অনুপ্রাণিত করেছে। আইসিসির একটি ভিডিয়োয় পন্টিং বলেছেন, “ওর বয়স ৩৬, কিন্তু একজন তরুণের মতো স্বতস্ফূর্ততা লক্ষ্য করি ওর খেলায়। মনে হয় ওর বয়স ২৬। মাঠে দৌড়ে বেড়াচ্ছে, নিজেকে উপভোগ করছে এবং সামনে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছে।”
রাজা সেই সম্পর্কে বলেছেন, “সকালে ওঠার পরেই এক বন্ধু বার্তা পাঠিয়ে জিজ্ঞাসা করল আইসিসির ভিডিয়োটা দেখেছি কিনা। সেখানে রিকি পন্টিং জ়িম্বাবোয়ে এবং আমাকে নিয়ে কথা বলেছে। আমার পরিবার এবং বন্ধুরাও অনেকে সেই বার্তা পাঠায়। সব দেখে চোখে জল এসে গিয়েছিল। নিজের ভেতরে একটা বাড়তি তাগিদ অনুভব করেছিলাম। ওই ভিডিয়োই আমাকে চাঙ্গা করে দেয়। শান্ত ছিলাম, কিন্তু একই সঙ্গে উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলাম।”