সরফরাজ খানের পাশে সব সময় রয়েছেন তাঁর বাবা নওশাদ খান। —ফাইল চিত্র
বেঙ্গালুরুর চিন্নাস্বামী স্টেডিয়ামে সরফরাজ খান যখন রঞ্জি ট্রফির ফাইনালে শতরান করছেন, তাঁর বাবা নওশাদ খানও তখন সেখানে। ছেলে মাঠে শতরান করে কাঁদছেন, আর স্টেডিয়ামে গর্বে বাবার বুক চওড়া হচ্ছে। তাঁর স্বপ্ন সত্যি করছে ছেলে। বেঙ্গালুরু থেকে সেই কথাই আনন্দবাজার অনলাইনকে জানালেন নওশাদ।
নওশাদ নিজে স্বপ্ন দেখেছিলেন মুম্বইয়ের হয়ে খেলার। রঞ্জি দলে ঢোকার খুব কাছে এসেও অধরা থেকে গিয়েছিল সেই স্বপ্ন। একের পর এক ম্যাচে শতরান করে তাঁর ছেলে সেই স্বপ্ন সত্যি করেছে। রঞ্জি ফাইনালেও শতরান করেছে। মুম্বইয়ের ‘মাচো’র (মুম্বইয়ে এই নামেই পরিচিত নওশাদ) ছেলে গোটা এলাকার মানুষের গর্ব হয়ে উঠেছে। মুম্বইয়ের কুরলায় বাড়ি নওশাদের। তিনি যেখানে বড় হয়েছেন, বছর দশেক হল সেখান থেকে কুরলার অন্য জায়গায় একটি ফ্ল্যাটে চলে এসেছেন তাঁরা। ফ্ল্যাটের অন্য বাসিন্দাদের অনুমতি নিয়ে সেখানেই বানিয়েছেন পিচ। সরফরাজকে সেই পিচে অনুশীলন করান নওশাদ। তিনিই যে তাঁর ছেলের কোচ। তিন বছর বয়স থেকে সরফরাজের ক্রিকেট শেখা শুরু তাঁর হাত ধরেই।
মাঠে বসে ছেলের খেলা দেখার সময় মোবাইল ফোন বন্ধ রাখেন নওশাদ। কোনও রকম ব্যাঘাত পছন্দ করেন না তিনি। নওশাদ বললেন, “বেঙ্গালুরুতে আত্মীয়, বন্ধুবান্ধব সকলে একসঙ্গে বসে খেলা দেখছি। চেষ্টা করি ছেলের সব ম্যাচ মাঠে বসে দেখার।” ছোটবেলা থেকে তিনিই তো সব জায়গায় খেলতে নিয়ে যান ছেলেকে। ছেলে মুম্বইয়ের হয়ে রঞ্জি ফাইনালে খেলবে আর তিনি থাকবেন না সেটা হতে পারে?
বিরাট কোহলীর থেকে প্রশংসা পেয়েছেন সরফরাজ খান। —ফাইল চিত্র
ছোটবেলা থেকেই সরফরাজ তাঁর বাবাকে দেখেন সাদা জামা প্যান্ট পরে, ক্রিকেটের সরঞ্জাম নিয়ে বাড়ি থেকে বেরতে। সেখান থেকেই ক্রিকেটের প্রতি আগ্রহ তৈরি হয় তাঁর। বাবার প্রশিক্ষণেই শুরু হয় ক্রিকেট শেখা। মুম্বইয়ের আজাদ ময়দানে শুরু তাঁদের ক্রিকেটপর্ব। নওশাদের জেদ ছিল ছেলেকে ক্রিকেটার বানাবেন, ছেলের জেদ ছিল তিনি ক্রিকেটার হবেন। অন্য কোনও দিকে মন ছিল না সরফরাজের। বাবাও খুব একটা পছন্দ করতেন না ছেলের অন্য দিকে মন যাক। বন্ধুদের জন্মদিনে গেলে বেশি রাত হবে ফিরতে। তাতে সকালে অনুশীলনে যেতে দেরি হবে। এই কারণে নওশাদ পছন্দ করতেন না ছেলে রাতে বন্ধুদের বাড়ি যাক। সরফরাজের ঘুরতে যাওয়ার শখ রয়েছে। কিন্তু সময় নেই। অনুশীলনেই মগ্ন থাকেন সরফরাজ। ক্রিকেট ছাড়া অন্য কিছুর দিকে ছেলের মন যাক, পছন্দ নয় নওশাদের। সরফরাজ জানিয়েছেন, অন্য দিকে মন গেলে বাবার হাতে চড়ও খেতে হয়েছে তাঁকে।
রঞ্জি ফাইনালে ছেলের শতরান দেখে আপ্লুত বাবা। তিনি বললেন, “আমার অনেক স্বপ্নই সরফরাজ পূর্ণ করেছে। মুম্বইয়ের হয়ে রঞ্জি খেলেছে। রঞ্জি ফাইনালে শতরান করেছে। ঘরোয়া ক্রিকেটে এই মরসুমে সব থেকে বেশি রান করেছে। আমার আশা রয়েছে ও ভারতের হয়েও খেলবে। সব আশা পূরণ হয় না। কিন্তু এখনও পর্যন্ত সরফরাজ যে ভাবে খেলছে তাতে আমি খুশি।”
সরফরাজ এবং তাঁর বাবার কাছে ক্রিকেটই সব। বাড়িতেও তাঁদের মধ্যে ক্রিকেট নিয়েই আলোচনা হয় সব থেকে বেশি। অন্য বিষয় নিয়ে কথা হলেও ক্রিকেটই তাঁদের ধ্যানজ্ঞান বলে জানালেন নওশাদ। তাঁদের জুটি মনে করিয়ে দেয় যুবরাজ সিংহ এবং তাঁর বাবা যোগরাজের কথা। যুবরাজকে ক্রিকেটার তৈরি করার জেদ ছিল যোগরাজের। ভারতের হয়ে দু’টি বিশ্বকাপ জিতে যুবরাজ তাঁর বাবার স্বপ্নপূরণ করেছিলেন। সরফরাজ অনূর্ধ্ব-১৯ ভারতীয় দলের হয়ে দু’বার বিশ্বকাপ খেললেও এখনও সিনিয়র দলে খেলা বাকি। নওশাদের আশা এক দিন তাঁর ছেলে সেই দলেও খেলবেন।
রঞ্জি ফাইনালে শতরানের পর সরফরাজ। —ফাইল চিত্র
সরফরাজের ওজন নিয়ে কথা শুনতে হয় তাঁর বাবাকেও। কিন্তু তা নিয়ে খুব বেশি চিন্তা নেই নওশাদের। তিনি বললেন, “আট বছর আইপিএল খেলে ফেলেছে সরফরাজ। বিরাট কোহলী, এবি ডিভিলিয়ার্স, ক্রিস গেলের মতো ক্রিকেটারদের সঙ্গে খেলেছে। আরসিবি, পঞ্জাব কিংসের মতো দলে খেলেছে। এই বছর দিল্লি ক্যাপিটালসের হয়ে খেলছে। এই সব দলগুলি ফিটনেস পরীক্ষা নেয়। ভারতের হয়ে অনূর্ধ্ব-১৯ দলে খেলার সময়ও ফিটনেস পরীক্ষা দিয়েছে। জাতীয় ক্রিকেট অ্যাকাডেমিতে ফিটনেস পরীক্ষা দিয়েছে। মুম্বই রঞ্জি দলও ফিটনেস পরীক্ষা নিয়েছে। সেই সব ফিটনেস পরীক্ষায় পাশ করেছে বলেই খেলার সুযোগ পাচ্ছে। চার দিনের ম্যাচে তিনশো রান করেছে। টানা দু’দিন ব্যাট করেছে। রঞ্জি ফাইনালেও শতরান করার পর ফিল্ডিং করছে। মাঠ ছেড়ে বেরিয়ে যায়নি ও। তা হলে ওর ওজন নিয়ে কেন প্রশ্ন তোলা হবে?”
ওজনকে হার মানিয়ে এগিয়ে চলেছেন সরফরাজ। বাবার একের পর এক স্বপ্নপূরণ করছেন তিনি। এ বার লক্ষ্য ভারতীয় দলে খেলা। বাবার সেই স্বপ্নের দিকেই এগোচ্ছেন সরফরাজ।