ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে টি-টোয়েন্টি সিরিজ জয়ের পর ভারত। ছবি: রয়টার্স
সাল ১৯৭১। বাংলাদেশ যে বছর মুক্তি পেয়েছিল, সেই বছর ক্রিকেটও মুক্তি পেয়েছিল টেস্ট ক্রিকেটের ‘একঘেয়েমি’ থেকে। সাদা জামা, লাল বল, পাঁচ দিন ধরে খেলা— একঘেয়েমিতে পৌঁছে যাওয়া ক্রিকেটে লেগেছিল একটু মশলার ছিটে। জন্ম হয়েছিল এক দিনের ক্রিকেটের। ক্রমে সেই মশলাই হয়ে উঠেছিল প্রধান উপাদান। সমর্থকদের মন জয় করেছিল এক দিনের ক্রিকেট। ধীরে ধীরে ৫০ ওভার ক্রিকেট আরও ছোট হয়ে জন্ম হয় টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের। তার এখন এমনই রমরমা, সেটিই এখন ‘মেন কোর্স’, সেটিই এখন ‘সাইড ডিশ’। এক দিনের ক্রিকেটের পঞ্চাশ বছরের ইতিহাসের ভবিষ্যৎ নিয়েই এখন উঠে গিয়েছে প্রশ্ন।
মঙ্গলবার এক দিনের ক্রিকেট থেকে অবসর নিয়েছেন বেন স্টোকস। টেস্ট এবং টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট খেললেও ৫০ ওভারের ম্যাচ খেলতে অনীহা তাঁর। ইংল্যান্ডের অলরাউন্ডার অবসর নেওয়ার দিনে বলেন, “দেশের হয়ে ১৪০-১৫০টা টেস্ট খেলতে চাই আমি। সেই কারণে সাদা বলে যে কোনও এক ধরনের ক্রিকেট ছাড়তে হত, আমি এক দিনের ক্রিকেটটাই ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। কারণ টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে আমাকে মাত্র ২-৩ ওভার বল করতে হয়।”
স্টোকস ইংল্যান্ডের টেস্ট দলের অধিনায়ক। তিনি নয় বেশি টেস্ট খেলার কথা ভেবে এক দিনের ক্রিকেট ছেড়েছেন। কিন্তু রবিচন্দ্রন অশ্বিন তো এক দিনের ক্রিকেট দেখার আগ্রহটাই হারিয়ে ফেলেছেন বলে জানিয়েছেন। অশ্বিন বলেছেন, “এক দিনের ক্রিকেটে না আছে সেই সৌন্দর্য, না আছে সেই উত্তেজনা। আগে ক্রিজে এসে ব্যাটাররা সময় নিত। ম্যাচটাকে আরও উত্তেজক জায়গায় নিয়ে যেতে চাইত। তার পর বল রিভার্স সুইং করা শুরু করত। এক সময় ব্যাটিং করা দলের ৬০ বলে ৬০ রান দরকার এবং হাতে সাত উইকেট থাকা সত্ত্বেও বোলিং করা দলকেই এগিয়ে রাখা হত। সে জিনিস আর নেই। এখন ওই রান চোখের পলকে উঠে যাবে।” সেই কারণে নাকি টিভি বন্ধ করে দেন অশ্বিন। ভারতীয় স্পিনার বলেন, “ক্রিকেট দেখতে আমি খুবই ভালবাসি। পাগলও বলতে পারেন। তবে এক দিনের ক্রিকেট দেখতে বসলে একটা সময়ের পর টিভির সুইচ বন্ধ করে দিই। আমার তো খেলাটা দেখলেই এখন বেশ ভয় লাগে। ম্যাচের মধ্যে সেই ওঠানামা ব্যাপারটা হারিয়ে গিয়েছে। আগের সেই উত্তেজনা এখন টের পাই না। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের বৃহত্তর সংস্করণ হয়ে দাঁড়িয়েছে এক দিনের ক্রিকেট।”
১৯৮৩ সালে বিশ্বকাপ হাতে কপিল দেব। পাশে মহিন্দর অমরনাথ। —ফাইল চিত্র
এক দিনের ক্রিকেট শুরু হয়েছিল হঠাৎ করেই। ১৯৭১ সালে মেলবোর্নে বৃষ্টির কারণে অস্ট্রেলিয়া বনাম ইংল্যান্ড টেস্টের প্রথম তিন দিন নষ্ট হয়। এর পরেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় ৪০ ওভারের ম্যাচ খেলার। দর্শকদের কথা ভেবে খেলা হয়েছিল সেই ম্যাচ। এর পর ধীরে ধীরে পাল্টাতে থাকে নানা নিয়ম। কখনও ৬০ ওভার, কখনও ৪৫ ওভারে খেলা হয়। শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় এক দিনের ম্যাচ হবে ৫০ ওভারে। ১৯৮৩ সালে ভারত যখন এক দিনের বিশ্বকাপ জেতে, সেই সময় সাদা জার্সি পরে খেলেছিলেন কপিল দেবরা। ১৯৯২ সালে এক দিনের বিশ্বকাপ খেলা দলগুলি প্রথম বার রঙিন জার্সি পরে। টেস্ট ক্রিকেট নয়, মানুষ অপেক্ষা করে থাকতেন এক দিনের ম্যাচের জন্য, চার বছর অন্তর বিশ্বকাপের জন্য।
সেই এক দিনের ক্রিকেটই এখন ব্যাকফুটে। প্রাক্তন ক্রিকেটার অরুণ লাল বললেন, “টি-টোয়েন্টি আসার পর এক দিনের ক্রিকেটের আকর্ষণ কমে গিয়েছে। আইপিএলের মতো প্রতিযোগিতায় টাকা রয়েছে। সেই আইপিএলে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট খেলা হয়। সকলেই চাইবে তাই টি-টোয়েন্টি খেলতে। ৫০ ওভারের ক্রিকেটে আইপিএল হলে হয়তো সকলে এক দিনের ক্রিকেটই খেলতে চাইত।”
সারা বিশ্বে বিভিন্ন দেশে শুরু হয়েছে ক্রিকেট লিগ। সেখানে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটই খেলা হয়। সারা বছর বিভিন্ন টি-টোয়েন্টি লিগেই খেলা পছন্দ করেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের ক্রিকেটাররা। সুনীল নারাইন, কায়রন পোলার্ড, ক্রিস গেলরা বিভিন্ন দেশে টি-টোয়েন্টি লিগ খেলার জন্য একটা সময় দেশের হয়ে খেলতে চাইতেন না। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের এই রমরমাই ধীরে ধীরে পিছনে ঠেলে দিচ্ছে এক দিনের ক্রিকেটকে?
মানতে নারাজ কিরণ মোরে। ৯৪টি এক দিনের ম্যাচ খেলা ভারতের এই প্রাক্তন উইকেটরক্ষক মনে করেন না এক দিনের ক্রিকেটের আকর্ষণ কোনও অংশে কমছে। আনন্দবাজার অনলাইনকে তিনি বললেন, “ক’টা দেশ ক্রিকেট খেলে? ফুটবলের মতো সারা বিশ্ব যখন ক্রিকেট খেলবে, তখন বোঝা যাবে কোন ধরনের ক্রিকেটের আকর্ষণ রয়েছে, কোনটার নেই। কোন ক্রিকেটার কোন ধরনের ক্রিকেটে খেলবেন বা খেলবেন না, সেটা সম্পূর্ণ তাঁর ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত। আমার মনে হয় না এক দিনের ক্রিকেটের জৌলুস কমেছে। প্রত্যেক ধরনের ক্রিকেটের নিজস্ব আকর্ষণ রয়েছে।”
অরুণলাল ঠিক, না মোরে, সেটা সময়ই বলবে।