আইপিএল দেখা চলছে মোবাইলে। —ফাইল চিত্র
সাল ২০০৮। রাত আটটার মধ্যে শহরের রাস্তা সুনসান। বাড়িতে বাড়িতে টিভির রিমোটের দখল নিয়েছেন ক্রিকেটপ্রেমীরা। ব্যাট হাতে ব্রেন্ডন ম্যাকালামের ১৫৮ রানের অপরাজিত ইনিংস যে সুর বেঁধে দিয়েছিল আইপিএলের, তার মুগ্ধতা চলছে ১৫ বছর ধরে। ক্রিকেটের সঙ্গে বলিউডকেও নিবিড় ভাবে জুড়ে দিয়েছে আইপিএল। শাহরুখ খান, প্রীতি জিন্টা, শিল্পা শেট্টিরা উপস্থিত থাকছেন প্রতি ম্যাচেই। ক্রিকেট-বিশ্বে সে এক বিশাল ঝাঁকুনি। সেই ঝাঁকুনিতে ঠান্ডা পানীয়ের বুদবুদের মতো বেরিয়ে আসছে অর্থ, প্রচার এবং ক্রিকেটপ্রতিভা।
সাল ২০২২। এখন মানুষ আইপিএল দেখার জন্য টেলিভিশনের অপেক্ষায় থাকছে না। অফিস থেকে ম্যাচ শুরুর আগে বাড়ি ফেরার তাড়া নেই তাদের। খেলা যে তাদের হাতের মুঠোয়। বলা ভাল মুঠোফোনে, মোবাইলে। মানুষ খেলা দেখছে সে যেখানে রয়েছে, সেখান থেকে। বাসে, ট্রেনে, ট্রামে কিংবা গাড়িতে। মানুষ চলছে, সেই সঙ্গে চলছে মোবাইলে খেলা দেখা। সেই কারণেই আইপিএলের ভারতে সম্প্রচারের টিভি স্বত্ব বিক্রি হচ্ছে ২৩,৫৭৫ কোটি টাকায় এবং ডিজিটাল স্বত্ব বিক্রি হচ্ছে ২০,৫০০ কোটি টাকায়। সেই সঙ্গে স্পেশাল কিছু ম্যাচের ডিজিটাল স্বত্বের দাম ৩,২৫৮ কোটি টাকা। যোগ করলে দাঁড়ায় ২৩,৭৫৮ কোটি টাকা। অর্থাৎ টিভি স্বত্বের থেকে ডিজিটাল স্বত্বের দাম বেশি।
ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড ২০০৮ সালে নিজেরাও বুঝতে পারেনি আইপিএল নামক ব্রহ্মাস্ত্র তৈরি করে ফেলেছে তারা। সোনি ৮২০০ কোটি টাকায় ১০ বছরের জন্য কিনে নিয়েছিল সম্প্রচার স্বত্ব। ১০ বছর পর তা বেড়ে যায় দ্বিগুণ। ডিজনি স্টার সেই স্বত্ব কেনে ১৬,৩৪৮ কোটি টাকায়। তত দিনে ভারতে এসে গিয়েছে ওটিটি প্ল্যাটফর্ম। ক্রিকেটভক্ত মানুষ মোবাইলেও খেলা দেখতে পাচ্ছে। শুরুতে সেই সংখ্যা কম থাকলেও ধীরে ধীরে বেড়েছে। সেই সংখ্যা গতি পায় কোভিডে। নিশ্চুপে।
করোনা অতিমারির কারণে মানুষ গৃহবন্দি। এই সময় বাড়তে শুরু করল ওটিটি-র রমরমা। মানুষ সিনেমা হলে যেতে পারছে না বলে বিভিন্ন প্রযোজক সংস্থা সিনেমাকেই তাদের কাছে নিয়ে এল। হাতে স্মার্টফোন, তাতে ইন্টারনেট এবং চাইলেই পছন্দের ওটিটি প্ল্যাটফর্মে সিনেমা, সিরিজ। বাদ থাকল না খেলাও। তথ্য বলছে ২০২০ এবং ২০২১ সালে আইপিএলের টিআরপি কমেনি। বাড়িতে আটকে থাকা মানুষ টিভিতেই আইপিএল দেখেছে।
কিন্তু এই বছরের আইপিএলে ছবিটা কিছুটা হলেও পাল্টে গেল। এপ্রিল মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে আইপিএল নিয়ে উঠল গেল-গেল রব। যে আইপিএলকে বাকি দেশের ক্রিকেট বোর্ড ঈর্ষার চোখে দেখে। যে আইপিএল আয়োজন করে ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড নিজেদের পকেট ভারী করে বছরের পর বছর। সেই আইপিএলের টিআরপি কমে গেল! বিভিন্ন বাংলা সিরিয়ালের প্রযোজকরাও জানালেন, যতই আইপিএল চলুক তাদের সিরিয়ালের টিআরপি কমেনি। মানুষ কি আইপিএল দেখছে না? মহেন্দ্র সিংহ ধোনির বিজ্ঞাপনেই কি শুধু রাস্তায় হঠাৎ বাস থামিয়ে আইপিএল দেখা বা বাড়ির সকলে মিলে আইপিএল দেখার ছবি দেখা যায়? বাস্তবটা কি সত্যিই আলাদা? এমন হাজার প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে শুরু করে।
জবাব পেয়ে যান সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়, জয় শাহরা। বুঝতে পারেন, টেলিভিশন নয়, ডিজিটাল মাধ্যমই ভবিষ্যৎ। ২০২১ সাল পর্যন্ত ভারতে ওটিটি প্ল্যাটফর্মের আনুমানিক গ্রাহকসংখ্যা ছিল প্রায় ৯ কোটির মতো। এর মধ্যে তিন সংস্থাই দখল করে বসেছিল ৮৩ শতাংশ বাজার। শেষ হিসাব অনুযায়ী, ভারতে ভুটের মোট গ্রাহক ১০ লাখের মতো। সেখানে ওটিটি-র ‘তিন প্রধান’ হটস্টার, নেটফ্লিক্স, অ্যামাজনের এক একজনের কোটির বেশি গ্রাহক।
আইপিএলের জনপ্রিয়তা নিয়ে চিন্তা ছিল না বোর্ডের। তারা জানত আইপিএল এখনও তাদের সোনার ডিম দেওয়া হাঁস। প্রমাণ হয়ে গেল গত তিন দিনে। আইপিএলের সম্প্রচারস্বত্ব বিক্রি হল মোট ৪৪,০৭৫ কোটি টাকায়। এত লাভ আইপিএল দেখিয়ে? হ্যাঁ, এতটাই লাভ।
আইপিএল দিয়েই ওটিটি মঞ্চে বাজিমাত করতে চাইছে ভায়াকম ১৮। জানা গিয়েছে, টেলিভিশন স্বত্বের থেকেও ডিজিটাল স্বত্ব কিনতে বেশি আগ্রহী হয়ে উঠেছিল ভায়াকম। এর মূল কারণ, ভারতের ওটিটি বাজারে তাদের একেবারেই জনপ্রিয়তা না থাকা। এই মুহূর্তে ভায়াকম সংস্থার অ্যাপ এবং ওয়েবসাইট ‘ভুট’ বাজারে রয়েছে। তবে হটস্টার, নেটফ্লিক্স এবং অ্যামাজনের সঙ্গে লড়াইয়ে তারা নেহাতই কুলীন।
আইপিএল ভুটেই দেখানো হবে, নাকি অন্য কোনও অ্যাপ বাজারে আনা হবে, সে সম্পর্কে এখনও কিছু পরিষ্কার করা হয়নি ভায়াকমের পক্ষ থেকে।
একটা জিনিস শুধু পরিষ্কার। ২০২২ সালে দাঁড়িয়ে ডিজিটাল মাধ্যমকে আর ভবিষ্যতের মাধ্যম বলা যাবে না। মানুষ খেলা দেখবে হাটে-,মাঠে, বাসে-ট্রামে, অলিতে-গলিতে। নিজের সময় মতো, নিজের ইচ্ছা মতো। এখন ডিজিটালই বাস্তব।
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ।