Sachin Tendulkar

Sachin -Sourav: নাগপুরের সেই বিদায়ী টেস্টই ছিল সবচেয়ে আবেগের মুহূর্ত

ইডেনে স্টিভ ওয়ের অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে জয় রয়েছে। এর পরে চেন্নাইয়ে জিতে সেই সিরিজ় জয় সম্পূর্ণ হবে।

Advertisement

সুমিত ঘোষ

কলকাতা শেষ আপডেট: ১০ জুলাই ২০২২ ০৮:২৬
Share:

কিশোর বয়স থেকে আলাপ। বিরানব্বইয়ে অস্ট্রেলিয়া সফর থেকে ছিয়ানব্বইয়ের লর্ডস, সব কিছুর তিনি সাক্ষী। বাইশ গজে প্রিয় পার্টনার। লন্ডনে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের পঞ্চাশতম জন্মদিনের উৎসবে যোগ দেওয়ার মধ্যেই দাদাকে নিয়ে আনন্দবাজারের সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় সচিন তেন্ডুলকর। আজ শেষ পর্ব।

Advertisement

প্র: আপনি সৌরভের নাম সুপারিশ করেছিলেন সহ-অধিনায়ক হিসেবে। পরবর্তীকালে ধোনির নাম জানিয়েছিলেন অধিনায়ক হিসেবে যখন নির্বাচকেরা আপনার কাছে নেতৃত্বের প্রস্তাব নিয়ে এসেছিল। কী দেখে মনে হয়েছিল, ভবিষ্যতের দারুণ নেতার মশলা রয়েছে তাঁদের মধ্যে?

সচিন: আমি সৌরভের সঙ্গে অনেক ক্রিকেট খেলেছি। সেই তেরো বছর বয়স থেকে আমরা একসঙ্গে খেলছি। একে অন্যকে জানি। তাই ওর সঙ্গে ক্রিকেট নিয়ে প্রচুর কথাবার্তা হয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা, মাঠে অনেক সময় কাটিয়েছি ওর সঙ্গে, ক্রিজ়ে একসঙ্গে ব্যাট করেছি। তখন কথোপকথনের সময় একটা জিনিস দেখতাম, সৌরভের গেম রিডিং দারুণ। কোন সময়ে কী করতে হবে, খুব ভাল বুঝতে পারত। প্রতিপক্ষ কী ভাবছে, কী করে তাদের পরিকল্পনা ভোঁতা করা যায়, কী করে নিজেদের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য হাসিল করা যায়, এ সব নিয়ে খুব পরিষ্কার ভাবনা দেখতে পেতাম সৌরভের মধ্যে। একই জিনিস লক্ষ্য করতাম মহেন্দ্র সিংহ ধোনির মধ্যেও। সে সব দেখেই ওরা ভাল ক্যাপ্টেন হবে বলে আমার মনে হয়েছিল। তাই ওদের নাম সুপারিশ করেছিলাম।

Advertisement

প্র: সৌরভকে ওপেনে নিয়ে আসার নেপথ্যেও আপনার ভূমিকা ছিল?

সচিন: আমি দেখতাম, সৌরভ খুব ভাল বাউন্ডারি মারতে পারে। এত সুন্দর ওর টাইমিং, মুগ্ধ হয়ে থাকতে হয়। স্পিনার বল করতে এলে তাদের অবলীলায় উড়িয়ে দিতে পারে। আমার মনে হয়েছিল, সৌরভ ওপেন করলে আমার সঙ্গে ডান হাতি-বাঁ হাতি কম্বিনেশনও তৈরি হবে। সেটা খুব ভাল কাজে আসতে পারে। সেই কারণেই আমাদের দু’জনের ওপেনিং জুটি তৈরি হয়।

প্র: তেরো বছর বয়স থেকে আপনাদের সম্পর্ক, বন্ধুত্ব। দাদার সঙ্গে সবচেয়ে স্মরণীয় মুহূর্ত কী?

সচিন: অনেকই স্মরণীয় মুহূর্ত আছে দাদার সঙ্গে। কোনও একটাকে বেছে নেওয়া কঠিন। হেডিংলিতে খুব স্মরণীয় টেস্ট জয়। আমি আর দাদা দু’জনেই বড় সেঞ্চুরি পেয়েছিলাম। রাহুলও সেঞ্চুরি করেছিল। ইডেনে স্টিভ ওয়ের অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে জয় রয়েছে। এর পরে চেন্নাইয়ে জিতে সেই সিরিজ় জয় সম্পূর্ণ হবে। শ্রীলঙ্কায় দাদার সঙ্গে আমার খুব ভাল একটা পার্টনারশিপ ছিল। কয়েক দিন আগেই টিভিতে দেখছিলাম। শ্রীলঙ্কায় সম্ভবত নিদাহাস কাপের ফাইনাল ছিল। আমরা শ্রীলঙ্কাকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হই। আমি আর দাদা ওপেনিং জুটিতে ২৪২ রান তুলেছিলাম। দু’জনেই সেঞ্চুরি করেছিলাম, দলের জয়ে অবদান রাখতে পেরেছিলাম (সেই ফাইনালে সচিন করেন ১২৮, সৌরভ ১০৯। ভারত ৬ রানে জিতে চ্যাম্পিয়ন হয়।) এত দিন পরে ম্যাচটা আবার দেখতে বেশ ভাল লাগছিল। অনেক পুরনো স্মৃতি ভিড় করে আসছিল।

প্র: দাদার সঙ্গে আর কোনও মুহূর্তটা মনে পড়লে আপনি এ রকম আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন?

সচিন: একটা ঘটনার কথা বলব। ২০০৮-এ অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে যখন সিরিজ় জিতলাম আমরা নাগপুরে। দাদার শেষ টেস্ট ম্যাচ। আমি খুবই আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিলাম সে দিন। দাদার সঙ্গে সেই তেরো বছর বয়স থেকে খেলছি। কত দিনের সম্পর্ক। সে দিন নাগপুরে দাঁড়িয়ে আমার মনে হয়েছিল, আমার খুব কাছের, খুব প্রিয় এক জন সঙ্গী আমাদের দুনিয়াটা ছেড়ে চলে যাচ্ছে। কাল সকাল থেকে আর আমি ওকে পাব না। তেরো বছর থেকে শুরু করলে আমার আর দাদার একসঙ্গে যাত্রা চলেছে প্রায় পঁচিশ বছর। অনেকটা সময়। এ রকম এক জন যখন বিদায় নিচ্ছে, সেই সময়টা অবশ্যই খুব আবেগপূর্ণ মুহূর্ত হবে। দাদার সঙ্গে অনেক আনন্দের মুহূর্তও আমি কাটিয়েছি কিন্তু নাগপুর স্মৃতিতে থেকে গিয়েছে এই আবেগটার জন্য। সে দিন আমরা কিন্তু শুধু দুঃখ পেয়ে কাটিয়েছিলাম, তা নয়। দারুণ একটা কেরিয়ারকে সম্মান জানাতে আমরা উৎসবও করেছিলাম।

প্র: বোলার সচিনের ম্যাজিক নিয়ে কথা হচ্ছিল। যা অনেক ম্যাচে ভারতকে জিতিয়েছে। ইডেনে হিরো কাপের সেমিফাইনাল, আবার ইডেনেই ২০০১-এ অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে সেই ঐতিহাসিক ম্যাচ...

সচিন: ইডেনের পাশাপাশি অ্যাডিলেডে যে টেস্ট আমরা জিতেছিলাম, সেখানে বোলিংয়ের কথা মনে আছে। দ্বিতীয় ইনিংসে স্টিভ ওয় আর ড্যামিয়েন মার্টিনের মধ্যে দারুণ পার্টনারশিপ হচ্ছিল। দু’জনের উইকেটই নিয়েছিলাম আমি। দু’জনেরই ক্যাচ ধরেছিল রাহুল দ্রাবিড়। বিদেশের মাঠে বিশেষ করে ওই অস্ট্রেলিয়া দলের বিরুদ্ধে অ্যাডিলেডে জিতেছিলাম বলে ওই স্পেলটা স্পেশ্যাল হয়ে থেকে গিয়েছে।

প্র: দাদাকে ‘কামব্যাক কিং’ বলা হত। ১৯৯২-এ অস্ট্রেলিয়ায় একটি ওয়ান ডে খেলার পরেই বাদ। গ্রেগ চ্যাপেলের জমানায় ব্রাত্য। আপনার কী মনে হয়, বারবার এ ভাবে প্রত্যাবর্তন ঘটাতেন কী ভাবে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়?

সচিন: ক্রিকেটের প্রতি গভীর ভালবাসা আর আবেগ ছিল দাদার। যে কোনও জগতেই কেউ হয়তো একটা দূর পর্যন্ত যায়, আবার অন্য কেউ নিজেকে আরও দূর ঠেলতে পারে। এই আরও কয়েক গজ নিজেকে ঠেলতে পারাটাই আসল। তাদের দমিয়ে রাখা কঠিন হয়। তারাই চ্যাম্পিয়ন হিসেবে উঠে আসে। দাদা এটা পারত। কঠিন পথ ধরে পরিশ্রম করে ওকে ফিরে আসতে হয়েছিল এবং দাদা সেটা করে দেখিয়েছিল। আর জীবনের সবচেয়ে ভাল ব্যাটিংটা করেছিল পরে ফিরে এসে। দক্ষিণ আফ্রিকায় প্রত্যাবর্তন সফরেই দারুণ ভাবে ফিরে এল। আমি কিন্তু যখন রান পাচ্ছিল না, তখনই বলেছিলাম, তুমি দারুণ ব্যাট করছ। এত ভাল ব্যাটিং করতে কখনও দেখিনি তোমাকে। দেখবে খুব শিগগির বড় রান করবে।

প্র: কী দেখে মনে হয়েছিল যে, দাদার ভাল সময় ফুরিয়ে যায়নি?

সৌরভ: ব্যাটসম্যান হিসেবে ওর পোজিশন নেওয়া, ভারসাম্য, কোন বলটায় ফরোয়ার্ড যাব কোনটায় ব্যাকফুট, সব কিছু একদম নিখুঁত করছিল দাদা। আমি অনেক ছোটবেলা থেকে ওকে ব্যাট করতে দেখছি, কিন্তু এখানে দেখেই পরিবর্তনটা বুঝতে পারছিলাম। আমি তাই দাদাকে বলেছিলাম, আমি স্কোরবোর্ড দেখছি না, তোমাকে দেখছি। তোমার পোজিশন দেখছি, তোমার ব্যালান্স দেখছি। সব একদম ঠিক আছে। রান আসবেই। আর একটা কথা বলতে চাই। সৌরভের ভাল করার ইচ্ছা আর মানসিক শক্তি যে, আমি পারবই। আমাকে পারতেই হবে। এই দু’টো ব্যাপারও ওকে দিয়ে বারবার এমন সব অসাধারণ কামব্যাক ঘটিয়েছে।

প্র: এই দীর্ঘ, গভীর বন্ধুত্বের দিকে ফিরে তাকিয়ে কী মনে হয়?

সচিন: এটাই দেখে ভাল লাগে যে, ক্রিকেটের সূত্র ধরে আমাদের আলাপ হলেও সম্পর্কটা কেমন বাইশ গজ ছাপিয়ে সারা জীবনের অঙ্গ হয়ে উঠল। এই তো দাদার পঞ্চাশতম বার্থডে সেলিব্রেশনে গেলাম। ডোনার সঙ্গে দেখা হল, ওর মেয়ে সানার সঙ্গে কথা হল। আমার সঙ্গে অঞ্জলি ছিল, তাই অনেকটা ফ্যামিলি গেট টুগেদারের মতো মনে হচ্ছিল। ক্রিকেটের বাইরে আরও অনেক কিছু আড্ডা দিলাম। আমরা দু’জনেই এখন লন্ডনে আছি, তাই আবার হয়তো দেখা হবে। চলার পথে আমরা রান করেছি, ম্যাচ জিতেছি, একসঙ্গে আনন্দ করেছি, আবার দুঃখ ভাগ করে নিয়েছি। কিন্তু সবচেয়ে তৃপ্তিদায়ক হচ্ছে খেলা ছাড়ার পরেও সেই সুসম্পর্কটা রাখতে পারা। তেরো থেকে পঞ্চাশ, দাদা সেই প্রিয় বন্ধুই থেকে গিয়েছে আমার! (শেষ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement