পরীক্ষা: পিচ কেমন হল? দ্বৈরথের আগে ওয়াংখেড়েতে রোহিত। ছবি: পিটিআই।
সচিন তেন্ডুলকরের মূর্তি নিয়ে যে রকম কাজিয়া শুরু হয়েছে, অভাবনীয়। মঙ্গলবার ওয়াংখেড়েতে দেখা গেল, অনেকেই আবার সেই মূর্তি দেখতে ছুটছেন। সমাজমাধ্যমে ঝড় উঠেছে, সচিন কোথায় এ তো স্টিভ স্মিথের মতো দেখাচ্ছে? শটটাই বা কী? কিছুই নাকি বোঝা যাচ্ছে না। রবি শাস্ত্রী পর্যন্ত মন্তব্য করেছেন, সচিনের সঙ্গে দেখা হলে জিজ্ঞেস করবেন। আর সচিনের মুখ দেখলেই তিনি বুঝে যাবেন, তাঁর নিজের কী মনে হচ্ছে মূর্তিটা নিয়ে।
বুধবারের ওয়াংখেড়েতে অবশ্য এমন এক যুগলবন্দি তৈরি হতে যাচ্ছে যা সচিনের মূর্তি নিয়ে আলোচনাকে পিছনের সারিতে পাঠিয়ে দিতে পারে। ডেভিড বেকহ্যাম এবং সচিন পাশাপাশি হেঁটে যাবেন মাঠের মধ্যে বিশ্বকাপ ট্রফি নিয়ে। বেকহ্যাম আসছেন ইউনিসেফের দূত হিসেবে। সচিনও একই সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত। বিশ্বকাপ ২০২৩-এ এখনও পর্যন্ত এটাই সেরা চমক। বিস্তর চর্চা চলছে যে, সচিন কি বেকহ্যামকে ক্রিকেট বোঝাবেন? নাকি বেক্স ফুটবলের পাঠ দেবেন ক্রিকেটের মাস্টারকে? ফুটবলে যেমন ‘বেন্ড ইট লাইক বেকহ্যাম’ ক্রিকেটে কি তেমনই বলা যাবে ‘বেন্ড ইট লাইক শামি’? ওয়াংখেড়েতে কি আরও একটা দুর্ধর্ষ স্পেল বেরোবে ভারতীয় পেসারদের হাত থেকে?
সচিন-বেকহ্যাম যুগলবন্দি দেখা যাবে বুধবার। তার আগের দিন ওয়াংখেড়েতে দেখা বিভিন্ন মুহূর্তগুলোর মধ্যে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ কোনটা? পর-পর সাজিয়ে বাছার চেষ্টা করা যাক।
দৃশ্য এক: কেন উইলিয়ামসনের সাংবাদিক সম্মেলন। প্রথম প্রশ্নকর্তা শুরু করলেন, ‘‘আপনাকে সত্তর বছর পিছিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। ১৯৫৩... নিউ জ়িল্যান্ড অধিনায়ক থামিয়ে দিলেন, ‘‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, মনে আছে। আমার সব মনে আছে।’’ সেমিফাইনালের আগের দিন এমন মজা যিনি করতে পারেন, তাঁর ঘুমের ট্যাবলেট অন্তত লাগবে না। রক্তচাপ কমানোর ওষুধও খুঁজতে হচ্ছে না। মুহূর্তটা খুব গুরুত্বপূর্ণ কারণ পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে, উইলিয়ামসন আর যাই হোক, প্রতিযোগিতার সেরা দলকে খেলতে হবে বলে চাপে ডুবে নেই। বেশ
ফুরফুরে আছেন।
দৃশ্য দুই: নিউ জ়িল্যান্ডের অনুশীলন। নেটে ক্রমাগত দুই বাঁ হাতি বল করে যাচ্ছেন। এঁরা কেন উইলিয়ামসনদের দলের সদস্য নন। স্থানীয় মুম্বই ক্রিকেট মহল থেকে জোগাড় করা হয়েছে। এক জন সনাতনী বাঁ হাতি স্পিনার। অন্য জন চায়নাম্যান বোলার। অর্থাৎ জাডেজা-কুলদীপের ডামি আনিয়ে সেমিফাইনালের জন্য তৈরি হওয়ার চেষ্টা। স্থানীয় নেট বোলার আর ভারতের দুই স্পিনারের মধ্যে নিশ্চয়ই লন্ডন আর লিলুয়ার তফাত। তবু নিউ জ়িল্যান্ডের ব্যাটসম্যানদের এই নকল জাডেজা-কুলদীপদের বিরুদ্ধে মহড়া দেখে মনে হল, বুধবার ভারতীয় স্পিনারদের তাঁরা আক্রমণ করার রণনীতি নিতে পারেন। ধর্মশালায় প্রথমে কুলদীপকে তাঁরা আক্রমণ করেছিলেন। প্রথম স্পেলে অনেক রান দিয়ে ফেলেন কুলদীপ। পরে এসে ধাক্কা দেন। জাডেজা-কুলদীপের রহস্য থামাতে গেলে যে, তাঁদের পাল্টা আক্রমণ করতে হবে এই মন্ত্র মনে হচ্ছে উইলিয়ামসনের দল বুঝতে পেরেছে। ওয়াংখেড়েতে বুধবার ম্যাচের পার্থক্য গড়ে দিয়ে যেতে পারে এই দ্বৈরথ। নিউ জ়িল্যান্ড ব্যাটিং বনাম ভারতীয়
স্পিন জুটি।
দৃশ্য তিন: রোহিত শর্মার সাংবাদিক সম্মেলন। বিশ্বকাপের সাফল্যের কারণ কী জানতে চাওয়ায় বললেন, ‘‘ক্রিকেটারদের পরিষ্কার জানিয়ে দেওয়া হচ্ছে, কী চাওয়া হচ্ছে। সেই ভূমিকা পালন করতে গিয়ে যদি সব সময় সফল না-ও হয়, তা হলেও আমরা পাশে দাঁড়াই। তাকে অভয় দেওয়ার চেষ্টা করি। এর জন্য রাহুল ভাইকেও (কোচ রাহুল দ্রাবিড়) কৃতিত্ব দিতে চাই।’’ শর্মাজির নেতৃত্ব এই বিশ্বকাপে সুপারহিট। তেমনই ধন্য ধন্য হচ্ছে দ্রাবিড়কে নিয়ে। কে বলবে মাত্র ক’মাস আগে এই জুটিকেই তুলোধনা করা হচ্ছিল, টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে হারার জন্য। টসে জিতে ফিল্ডিং নেওয়ার জন্য। জীবন যে কত দ্রুত বদলে যেতে পারে কখনও তা নিয়ে পরামর্শের দরকার হলে রোহিত এক জনের ফোন ডায়াল করতে পারেন। যদিও তিনি ধরবেন কি না জানা নেই। মহেন্দ্র সিংহ ধোনি। ২০০৭-এ ওয়েস্ট ইন্ডিজে বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্ব থেকে বিদায় নেয় দ্রাবিড়, গ্রেগ চ্যাপেলের ভারত। রাঁচীতে ধোনির নির্মীয়মান বাড়িতে পাথর ছোড়ে ক্ষিপ্ত জনতা। জনরোষে এমনই আক্রান্ত হয়েছিলেন ধোনি যে, কলকাতায় এসে অজ্ঞাতবাসে থাকতে হয়েছিল। চার বছর পরে ২০১১-তে সেই লোকটার হাতেই বিশ্বকাপ ওঠে। রোহিত তেমনই ২০১১ দেশের মাঠে শেষ পঞ্চাশ ওভারের বিশ্বকাপে ছিলেন না। জাতীয় নির্বাচকেরা দলেই নেননি। ১২ বছর পরে যদি কাপ ওঠে তাঁর হাতে, ধোনির মতোই দুর্ধর্ষ প্রত্যাবর্তন কাহিনি লেখা হবে তাঁর নামের পাশে। মঙ্গলবার এই মন্তব্য থেকে বুঝিয়ে দিয়ে গেলেন, সতীর্থদের চোখে দরদী জেনারেল হয়ে উঠতে চেয়েছেন। তাই সৈন্যরাও এমন জান লড়িয়ে দিচ্ছে।
দৃশ্য চার: পিচের সামনে দাঁড়িয়ে ভারতীয় দল পরিচালন সমিতির দীর্ঘ আলোচনা। রোহিত আছেন, দ্রাবিড় আছেন। ব্যাটিং কোচ বিক্রম রাঠৌর যোগ দিলেন। ওয়াংখেড়ের বাইশ গজ নিঃসন্দেহে সকলের নজরে। এমনিতে এখানে বাউন্স বেশি থাকে। পেসাররা বাড়তি সাহায্য পান। গ্রুপ পর্বে শ্রীলঙ্কাকে উড়িয়ে দিয়েছিলেন বুমরা, শামি, সিরাজরা। নিউ জ়িল্যান্ড অবশ্যই শ্রীলঙ্কা নয়। তাঁদের হাতেও ভাল পেস ব্যাটারি রয়েছে। ট্রেন্ট বোল্ট, টিম সাউদির সঙ্গে দীর্ঘদেহী কাইল জেমিসনকে খেলানো হতে পারে। তাই কি রোহিত, দ্রাবিড়দের কপালে চিন্তার রেখা? তাই কি এই দীর্ঘ বৈঠক? দেখে নেওয়ার চেষ্টা, ওয়াংখেড়েতে বল ঘুরবে কি না?
দৃশ্য পাঁচ: নেটে কোহলির ব্যাটিং। গ্লেন ম্যাক্সওয়েলের ইনিংস দেখে কি ঠিক করলেন ধ্রুপদী ব্যাটিং ভঙ্গি ছেড়ে বেরোবেন? কখনও দেখা গেল, রিভার্স সুইপ মারার চেষ্টা করছেন। কখনও বাঁ হাতে ব্যাট ধরেছেন। কী ব্যাপার? সুইচ হিট মারবেন নাকি? মনে হচ্ছে কোহলির নতুন কোনও ‘ভার্সন’-এর মহড়া চলছে। বিশ্বকাপের মধ্যেই কি ঝলক দেখা যাবে? অপেক্ষায় থাকল ক্রিকেট দুনিয়া।
দৃশ্য ছয়: রোহিত শর্মাকে সরাসরি জিজ্ঞেস করা হল, টস কতটা গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে? বললেন, একেবারেই গুরুত্বপূর্ণ হবে না। একদম ঠিক বললেন না। হয়তো টস হারলেই যাতে ম্যাচ হারার অবসাদ চলে না আসে, তাই আগাম অ্যান্টিবায়োটিক নিয়ে রাখলেন। রোহিত টস হারলে লিখে দেওয়া যায়, নিউ জ়িল্যান্ড রান তাড়া করতে পাঠাবে ভারতকে। তখন যদি ভারতীয় বোলিং তিনশোর মধ্যে উইলিয়ামসনদের বেঁধে না রাখতে পারে, উদ্বেগ তৈরি হবে। নৈশালোকে বোল্ট, সাউদিদের খেলা সহজ হবে না। একটা ধারণা হচ্ছে, প্রথম দশ ওভারে ভারতীয় ব্যাটিং কী করছে, তার উপর ম্যাচের ভাগ্য দাঁড়িয়ে। রোহিত যেমন আগ্রাসী শুরু করে দিচ্ছেন, তা যদি করতে পারেন অ্যাডভ্যান্টেজ ভারত। যদি বুধবারই তাঁর ব্রেক ফেলের দিন হয়, বিপদ আছে। যদি বাঁ হাতি বোল্ট শুরুতে রোহিত, বিরাটকে তুলে নেন, কে বাঁচাবে সেই প্রশ্ন একেবারে অমূলক নয়। শুভমন গিল পারবেন? শ্রেয়স আয়ার? তিনি কতটা বিশ্বকাপ সেমিফাইনালের মতো হাইপ্রেশার মঞ্চের জন্য তৈরি? পারলে তরুণ এবং উঠতি থেকে দু’জনেই রাতারাতি প্রতিষ্ঠিত তারকায় পরিণত হবেন। কে এল রাহুল কি সেই মাপের ম্যাচউইনার? যিনি একার হাতে ঝড়ঝাপ্টা সামলে তীরের দিকে জাহাজ নিয়ে যেতে পারেন? ওয়াংখেড়ে তখন পরীক্ষা নেবে।
দৃশ্য সাত: ঈশান কিষনকে শুরুতেই অনেকক্ষণ ব্যাট করানো হল। তা দেখে জল্পনা, ঈশান খেলবে নাকি? কার জায়গায়? এমনিতে তো প্রথম একাদশ অপরিবর্তিত থাকার কথা। এত ভাল খেলছে দল। ন’টা ম্যাচে নয় প্রতিপক্ষকে উড়িয়ে দিয়েছে। তা হলে? নাকি কারও কিছু হল? কে এল রাহুল ঠিক আছেন তো? হয়তো আছেন তবু সেমিফাইনাল তো। সাপলুডোর খেলা। জিতলে মই ধরে উঁচুতে। না হলে সাপের মুখে। অজানা আশঙ্কার স্রোত ঠেকানো যায় কী ভাবে?