আস্থা: বিশ্বকাপে হার্দিককে তুরুপের তাস ধরছেন কপিল। ফাইল চিত্র।
অলরাউন্ডার বলতেই আজও মনে পড়ে যায় হরিয়ানার সেই দামাল ছেলের মুখ। তিরাশি বিশ্বকাপ জিতিয়ে যিনি আন্ডারডগদের স্বপ্ন দেখতে শিখিয়েছিলেন। যিনি শিখিয়েছিলেন, আশার কাছে হার মানতে পারে নিশ্চয়তা।
তিনি কপিল দেব— আরও অনেক ভারতীয় ক্রীড়াপ্রেমীর মতো কি খুঁজে চলেছেন তাঁর উত্তরসূরিকে? পরবর্তী যোগ্য অলরাউন্ডারকে? মঙ্গলবার সকালে এই প্রশ্ন শেষ করার আগেই অবশ্য থামিয়ে দিলেন কিংবদন্তি। বিদেশের উড়ান ধরার ব্যস্ততার মধ্যেও আনন্দবাজারের সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় বলে দিলেন, ‘‘আর খুঁজতে হবে কেন? হার্দিক পাণ্ড্য ফিরে এসেছে। দুর্ধর্ষ ক্রিকেটার। দারুণ ম্যাচউইনার। পাকিস্তান ম্যাচেও সেটা প্রমাণ করে দিল। হার্দিক যথেষ্ট যোগ্য অলরাউন্ডার। কী রকম দুর্দান্ত ম্যাচ জেতাল দেখুন। তা-ও কি না পাকিস্তান ম্যাচ!’’
হার্দিক কয়েকটা আইপিএলে ভাল খেলার পরে এবং ভারতের হয়ে শুরুর দিকে চমক দেখাতেই লোকে তুলনা টানতে শুরু করে দিয়েছিল কপিল দেবের সঙ্গে। যা নিয়ে কম কথা শুনতে হয়নি, কম হাসাহাসির পাত্র হতে হয়নি বডোদরার তরুণকে। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সদ্য ম্যাচ জেতানো তারকার শুনলে ভাল লাগবে যে, স্বয়ং কপিল পরম আদরের সঙ্গে বলছেন, ‘‘হার্দিক খুব বড় ম্যাচউইনার। দারুণ খেলছে, আরও ভাল খেলবে। আমার আন্তরিক ভালবাসা, স্নেহ সব রইল ওর জন্য।’’
কপিল দেব সহজে কারও প্রশংসা করেন না। দীর্ঘমেয়াদি ভাবে দেখে নিয়ে মন্তব্য করায় বিশ্বাসী। কিন্তু চোট সারিয়ে ফেরা এই হার্দিক পাণ্ড্য-২ নিয়ে দেখা গেল তিনিও উচ্ছ্বসিত। ‘‘বড় চোট সারিয়ে মাঠে ফিরে দলকে জেতানো সহজ ব্যাপার নয়। হার্দিক সফল ভাবে তা করে দেখাচ্ছে। আইপিএলে দারুণ খেলেছে, পাকিস্তান ম্যাচ দারুণ খেলে জেতাল।’’
সত্যিই কি তিনি নিশ্চিত অলরাউন্ডার নিয়ে ভারতীয় ক্রিকেটপ্রেমীদের খোঁজ শেষ হল? হার্দিক যে আগেও প্রতিশ্রুতির রংমশাল জ্বালিয়ে নিভে গিয়েছেন। অভিষেক টেস্টে সাদিক মহম্মদকে হেলমেট পরতে বাধ্য করা ‘হরিয়ানা হারিকেন’ শুধু একটা বিষয়েই সতর্ক থাকতে বলছেন। ‘‘চোট-আঘাত থেকে দূরে থাকতে হবে। আমি আশা করব, হার্দিক অতীত থেকে শিক্ষা নিয়েছে এবং নিজেকে ফিট রাখতে পারবে।’’ শুধু হার্দিক নয়, কপিল বলছেন, ‘‘আমি রবীন্দ্র জাডেজার কথাও বলতে চাই। হার্দিক আর জাডেজা দু’জনেই কিন্তু এই মুহূর্তে প্রতিষ্ঠিত অলরাউন্ডার। দলের শক্তি বাড়িয়ে দিচ্ছে ওদের সাফল্য।’’ আর দু’মাসের মধ্যে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ অস্ট্রেলিয়ায়। সেখানে হার্দিক, জাডেজা যে তুরুপের তাস হতে চলেছে রোহিত শর্মার দলের, তা নিয়ে সন্দেহ নেই তাঁর।
পাকিস্তান ম্যাচে চাপের মুখে অবিচল থেকে জাডেজা-হার্দিক জুটি ভারতকে জিতিয়েছে। জেতার জন্য ১৪৮ রান তাড়া করতে নেমে ৮৯-৪ হয়ে গিয়েছিল রোহিত শর্মার দল। ফিরে গিয়েছিলেন প্রথম চার ব্যাটসম্যান— রোহিত, রাহুল, কোহলি, সূর্যকুমার। সেখান থেকে পঞ্চম উইকেটে ৫২ রান যোগ করে ম্যাচের রং পাল্টে দেন তাঁরা। জাডেজা শেষ ওভারের প্রথম বলে আউট হয়ে গেলেও হার্দিককে টলানো যায়নি। চতুর্থ বলে বাঁ হাতি স্পিনার মহম্মদ রিজ়োয়ানকে ছক্কা মেরে তাঁর আদর্শ ধোনির স্টাইলে ম্যাচ জিতিয়ে তবেই মাঠ ছাড়েন।
মরুশহরে ভারত-পাক ম্যাচে স্নায়ুর চাপ কতটা গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে, কপিল দেবের চেয়ে ভাল কে জানবে! তাঁর সময়ে শারজায় ভরা পাক গ্যালারির সামনে খেলতে হত ভারতকে। শুধু পাক পেসারদের নয়, খেলতে হত পাক আম্পায়ারদেরও। সেই সঙ্গে পাকিস্তান-ঘেঁষা সংগঠকদের। সেই অন্ধকারে খেলতে বাধ্য করানোর কেলেঙ্কারি কে ভুলতে পেরেছে! এখন দুবাইয়ের গ্যালারিতে নীল জার্সির উপস্থিতি, জনতার গর্জন সবুজের স্রোতের সঙ্গে রীতিমতো পাল্লা দিতে পারে। পাক আম্পায়ারেরা আর ভারত-পাক ম্যাচ খেলান না, থাকেন নিরপেক্ষ আম্পায়ার।
মরুশহরের ভারত-পাক মানেই যেমন চেতন শর্মাকে মারা জাভেদ মিয়াঁদাদের বিখ্যাত ছক্কা মনে পড়ে যায়, তেমনই উজ্জ্বল হয়ে রয়েছে কপিলের নেতৃত্বে পঁচাশিতে চতুর্দেশীয় রথম্যান্স কাপে পাকিস্তানকে হারানো। শারজায় ইমরান খানের বিধ্বংসী বোলিংয়ের সামনে প্রথমে ব্যাট করে মাত্র ১২৫ রানে শেষ হয়ে যায় ভারতের ইনিংস। তার পরে দুরন্ত প্রত্যাঘাতে পাকিস্তানকে সাবাড় করে দেয় ৮৫ রনে। পুরনো সে সব স্মৃতি ভিড় করে এসে দেশের প্রথম বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়ককে ক্ষণিকের জন্য হয়তো আবেগরুদ্ধ করে ফেলল। বলে ফেললেন, ‘‘ভারত-পাক ম্যাচ মানেই অন্য রকম স্নুায়ুর চাপ, জানি তো! হার্দিক-জাডেজা জুটি সেই চাপটা কী দারুণ সামলেছে!’’
কেমন লাগল গত রবিবারের ভারত-পাক দ্বৈরথ? কপিল বলে দিলেন, ‘‘দারুণ উপভোগ করেছি, খুব হাড্ডাহাড্ডি ম্যাচ হল আর তার পরে শেষে গিয়ে দারুণ ভাবে ম্যাচটা আমরা জিতলাম। ভারত নয়, পাকিস্তান নয়, সে দিন ক্রিকেট জিতেছে।’’ দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীর দ্বৈরথের রেষ যেন কাটতেই চাইছে না। বলে উঠলেন, ‘‘দারুণ লড়াই হয়েছে, কে জিতবে বোঝাই যাচ্ছিল না। দর্শক হিসেবে আমি এমন রুদ্ধশ্বাস ম্যাচই চাই।’’ দ্রুত যোগ করলেন, ‘‘আর ক্রিকেটার হিসেবে সব সময় চেয়েছি যেন একপেশে ভাবে আমরা ম্যাচটা জিতি।’’ যে খেলোয়াড়ি মনোভাব তিনি দু’দলের ক্রিকেটারদের মধ্যে দেখেছেন, তারও উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করলেন কপিল।
পাকিস্তানকে হারানোর এই উৎসবের মধ্যেও কি কোথাও উদ্বেগের কালো মেঘ থেকে গেল? চিন্তা রইল ভারতের প্রথম তিন ব্যাটসম্যানকে নিয়ে? কপিল বললেন, ‘‘দলের জন্য প্রথম তিন ব্যাটসম্যানের ফর্মে থাকা অবশ্যই জরুরি। তবে আমার সম্পূর্ণ আস্থা রয়েছে ওদের উপরে যে, ওরা রান পাবেও।’’ ব্যাখ্যা করলেন, ‘‘১৫০ রান এখনকার দিনে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে খুব বড় রান নয়। ১৭০-১৭৫ হলে বলা যেতে পারে জেতার মতো স্কোর বা লড়াকু স্কোর। এই ১৭০-১৭৫ রানটা পেতে গেলে কিন্তু উপরের দিকের ব্যাটসম্যানদের থেকে রান দরকার হবে।’’
বিরাট কোহলি ফর্মে না থাকলে বাদ দিয়ে দেওয়া যেতেই পারে, এমন মন্তব্য করে কয়েক দিন আগে বিতর্কের ঝড় তুলেছিলেন কপিল। এ দিন অবশ্য বিরাটের প্রতি অনেকটাই স্নেহশীল শোনাল তাঁকে। বললেন, ‘‘কোহলি খুব বড় ক্রিকেটার। তাই ওর মতো ক্রিকেটার তিন বছর ধরে সেঞ্চুরি না পেলে তো অবাকই হতে হয়।’’ কোহলির নির্দিষ্ট কোনও খুঁত কি তাঁর চোখে ধরা পড়ল? কপিলের জবাব, ‘‘ওর দক্ষতায় কোনও খামতি নেই। জানপ্রাণ দিয়ে খেলে। ক্রিকেটে আমরা বলি, বড় ব্যাটসম্যানের ফর্মে ফিরতে একটাই ভাল ইনিংস দরকার। কোহলিও হয়তো পুরনো সেই শাসকের মেজাজে ফেরা থেকে একটা ইনিংস দূরে।’’
দেশের ক্রিকেটভক্তরাও চাইবেন, কপিলের মন্তব্যকে সঠিক প্রমাণ করে রাজকীয় মেজাজে ফিরুন বিরাট!