ইংল্যান্ডের কোচ ব্রেন্ডন ম্যাকালাম। তাঁর ডাকনাম বাজ়। ছবি: রয়টার্স।
ম্যাচটা তিন দিনের নাকি? ইংল্যান্ড দলের তাড়াহুড়ো দেখে এমন প্রশ্ন মনে আসতেই পারে। টেস্টের প্রথম দিনে একটা দল ৭৮ ওভারে ৮ উইকেটে ৩৯৩ রান তুলল। ওভারপিছু রান পাঁচের উপর। শুধু তা-ই নয়, ইনিংস ডিক্লেয়ারও করে দিল। শেষ বেলায় বিপক্ষকে ব্যাট করতে পাঠাল ৪ ওভারের জন্য। এ যেন এক অন্য ধরনের টেস্ট ক্রিকেট। উইকেট পড়লে পড়ুক, রান তুলতেই হবে। ইংল্যান্ড দলের এখন টেস্ট খেলার এটাই নীতি। এটাই ‘বাজ়বল’।
গত বছরের মে মাসে ইংল্যান্ড দলের কোচ হিসাবে দায়িত্ব নেন ব্রেন্ডন ম্যাকালাম। তাঁর ডাকনাম ‘বাজ়’। আবার ইংরাজি শব্দ ‘বাজ়’-এর অর্থ চাঞ্চল্য বা সাড়া ফেলে দেওয়া। সেই কাজটা ইংল্যান্ড করে ফেলেছে। গত এক বছরে বেন স্টোকসেরা যে ভাবে টেস্ট ক্রিকেটটা খেলছেন, সেটা গোটা বিশ্বকে ভাবাচ্ছে। অন্য দল এই ভাবে ক্রিকেট খেলার চেষ্টা করবে কি না সেটা ভেবে উঠতে পারছে না। ইংল্যান্ড টস জিতে ব্যাট করতে নামলে প্রথম দিনে ৪০০ রানের বোঝা চাপিয়ে দিচ্ছে বিপক্ষের ঘাড়ে। চতুর্থ ইনিংসে ব্যাট করতে হলেও ওই রান তুলে দিচ্ছে। কিন্তু এই ভাবে টেস্ট ক্রিকেট খেলা কি ঠিক? রয়েছে দু’রকম মতই।
কেউ কেউ মনে করছেন, এত আক্রমণাত্মক ক্রিকেট বুমেরাং হয়ে যেতে পারে। যেমন ইংল্যান্ডের প্রাক্তন অধিনায়ক কেভিন পিটারসেন। তিনি খুশি নন। মেনে নিতে পারছেন না প্রথম দিনেই স্টোকসের ইনিংস ডিক্লেয়ার করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত। পিটারসেন বলেন, “স্টোকসের অধিনায়কের ধরন এটা নয়। এই টেস্টে সবে এটা প্রথম দিন। ফলে এখনও খুব বেশি নেতৃত্ব দেখার সুযোগ হয়নি। আমার মনে হয় দ্বিতীয় দিন এই পিচে ব্যাট করা আরও সহজ হয়ে যাবে। শনিবার খুব সুন্দর একটা দিন হবে খেলার জন্য। সেই কারণেই আমার মনে হয় ডিক্লেয়ার করে দেওয়া উচিত হয়নি। পরে বোঝা যাবে সিদ্ধান্তটা ঠিক না ভুল। আমাকে খেলার সময় বলা হত টেস্টের প্রথম ইনিংসে ৪০০ রান তোলো। ৪০০ হলে ৪৫০ তোলো। এটা বিপক্ষের উপর চাপ তৈরি করে। আমি হয়তো বেশিই সমালোচনা করছি। দেখা যাক কী হয়।”
অনেকে আবার এই রকম আক্রমণাত্মক ক্রিকেট খেলারই পক্ষে। ম্যাচ জেতার জন্য এটাই যদি অস্ত্র হয়, তা হলে তা প্রয়োগ করতে আপত্তি কোথায়, প্রশ্ন তাঁদের। অস্ট্রেলিয়ার প্রাক্তন অধিনায়ক রিকি পন্টিং এই দলে। তিনি মনে করেন দুর্দান্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছেন স্টোকস। বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়ক বলেন, “এমন কিছু হতে পারে আমরা কিন্তু আশা করেছিলাম। প্রচণ্ড গতিতে রান তুলছিল ইংল্যান্ড। শেষ ১৫-২০ মিনিটে অস্ট্রেলিয়ার উইকেট ফেলার সুযোগটা নিতে চেয়েছিল ওরা। সত্যি বলতে, আমার ভাল লেগেছে। এটাই তো স্টোকস এবং ম্যাকালামের ধরন। এখন তো ওরা এই ভাবেই খেলছে। ম্যাচ জেতার জন্য সব কিছু করছে ওরা। যে কোনও ধরনের সুযোগ পেলেই ঝাঁপিয়ে পড়ছে ইংল্যান্ড।” পন্টিংয়ের সঙ্গে একমত নাসের হুসেনও। তিনি মনে করেন ইংল্যান্ড চেষ্টা করেছিল দিনের শেষ বেলায় ডেভিড ওয়ার্নারদের উইকেট তুলে নেওয়ার।
অ্যাশেজ শুরুর প্রথম বলেই অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়ক প্যাট কামিন্সকে কভার দিয়ে সপাটে বাউন্ডারিতে পাঠিয়েছিলেন জ্যাক ক্রলি। ওই বলেই লেখা ছিল ইংল্যান্ড কী ভাবে এই অ্যাশেজ খেলবে। মারার বল পেলে ইংল্যান্ডের ব্যাটারেরা মারবেন। সেটা টেস্টের যে কোনও সময়, যে কোনও পরিস্থিতি হোক না কেন। কেউ মনে করবেন এটা পাগলামি, কেউ পছন্দ করবেন এই ধরনের ক্রিকেট। তাতে ম্যাকালামদের যে খুব বেশি কিছু যায়-আসবে, এমন নয়।
যাঁর হাত ধরে বাজ়বল ক্রিকেটের জন্ম, সেই ম্যাকালাম নিজেই এই তত্ত্ব মানতে রাজি নন। ইংল্যান্ডের আগ্রাসী ক্রিকেটকে যখন বাজ়বল বলা শুরু হল, তখন ম্যাকালাম বলেছিলেন, “অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে খেলা মানে সেটা সব সময় অন্য রকমের পরীক্ষা। অ্যাশেজের ইতিহাস রয়েছে। প্রতিদ্বন্দ্বিতা রয়েছে। আমি বিশ্বাস করি ছেলেরা চেষ্টা করবে এবং ইতিবাচক খেলবে। ছেলেদের খেলা যদি দেখি, তা হলে বোঝা যাবে এটা শুধু এলাম আর মারলাম তা নয়। সেই জন্যই আমার মনে হয় এ রকম বোকা বোকা নাম দেওয়া উচিত নয় এটাকে। কিছু কিছু সময় আছে যখন চাপ শুষে নিয়েছে ছেলেরা। কার বিরুদ্ধে কী ভাবে খেলব সেটা বুঝেই কিন্তু খেলেছে ছেলেরা।”
অ্যাশেজের প্রথম দিনে জো রুটের রিভার্স সুইপ। ছবি: রয়টার্স।
ম্যাকালাম এবং স্টোকসের জুটি এখনও পর্যন্ত ১৩টি টেস্ট খেলেছে। এর মধ্যে মাত্র দু’টি টেস্টে হেরেছে তারা। এর মধ্যে দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে দুরমুশ হয়েছিল। ইনিংস এবং ১২ রানে হেরেছিলেন স্টোকসরা। নিউ জ়িল্যান্ডের বিরুদ্ধে যে ম্যাচ ইংল্যান্ড হেরেছিল, সেটা এই টি-টোয়েন্টি যুগে টেস্ট ক্রিকেটের অন্যতম সেরা বিজ্ঞাপন হয়ে থাকবে। দুই দল একে অপরকে এক ইঞ্চি জমি ছাড়েনি। ফলো-অন হওয়ার পরেও ম্যাচ জিতেছিল কিউইরা। এক রানে ম্যাচ জিতেছিল তারা। কিন্তু এই হার ইংল্যান্ডকে ভাঙতে পারেনি। দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে হারের পর ইংল্যান্ডের কোচ বলেছিলেন, “প্রথম টেস্টে হারের পর আমরা নিজেদেরই জিজ্ঞাসা করতে চাই, ‘বিপক্ষের উপর যথেষ্ট দাপট কি দেখাতে পেরেছি?’ আরও আক্রমণাত্মক খেলা উচিত ছিল আমাদের। বিপক্ষকে চাপে রাখা দরকার ছিল। সেটা আমরা পারিনি। ওরা আমাদের চাপে রাখার সময় আরও বেশি সাহসী হওয়ার দরকার ছিল। পাল্টা বিপক্ষকে চাপ দিতে হত।”
চাপের খেলা খেলতে চান ম্যাকালাম। দল হারলেও সেই খেলা থেকে পিছিয়ে আসেন না। নিজে যেমন আগ্রাসী ব্যাটিং করতেন, চান তাঁর দল সেই ভাবেই টেস্ট ক্রিকেট খেলুক। এই দর্শন বদলে দিয়েছে জো রুটদেরও। ইংল্যান্ডের অন্যতম সফল ব্যাটার এক বছর আগেও দলের অধিনায়ক ছিলেন। তাঁকে সরিয়েই স্টোকসকে নেতা করা হয়। শেষ অ্যাশেজে অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে ০-৪ ব্যবধানে হেরেছিল ইংল্যান্ড। যে লজ্জার হারের পরই নেতৃত্ব হারান রুট। সেই তিনিই শুক্রবার ১৫২ বলে ১১৮ রান করে অপরাজিত রইলেন। নিজের খেলার ধরন পাল্টে ফেলেছেন রুট। কোচ ম্যাকালাম দলের ক্রিকেটারদের বলে দিয়েছেন ‘রকস্টারের’ মতো খেলতে। সেটাই করছেন রুট, জনি বেয়ারস্টোরা। রুট বলেছিলেন, “কোচ আমাদের বলেছে খেলার মাধ্যমে বিনোদন দিতে। মাঠে গিয়ে রকস্টারদের মতো খেলতে বলেছে। খেলতে খেলতে মজা করা এবং প্রতিটা সুযোগ কাজে লাগানোই এখন আমাদের উদ্দেশ্য। প্রত্যেকে খেলা দেখতে এসে যাতে আনন্দ পায় সেটাই করতে চাই।”
রুট নিজে বেশ শান্ত প্রকৃতির। অতি উচ্ছ্বাসে কোনও দিনই মাততে দেখা যায় না তাঁকে। তিনি কি আদৌ ম্যাকালামের কথা মতো রকস্টারের ভূমিকা পালন করতে পারবেন? গত বছর ভারতকে ঘরের মাঠে একটি টেস্ট হারিয়ে হাসতে হাসতে রুট বলেছিলেন, “আমার মনে হয় না কোনও দিন নিজেকে রকস্টার ভাবতে পারব। আমাকে দেখতেও তো রকস্টারের মতো নয়। তবে আজ ১০ সেকেন্ডের জন্য নিজেকে রকস্টার মনে হচ্ছিল (হাসি)। আসলে সে দিন বেন নিজে এলভিস প্রেসলির একটা সিনেমা দেখেছিল। তার পর থেকেই ও নিজেকে রকস্টার মনে করছে। তাই এই জয় ওকে উৎসর্গ করলাম।”
অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে শতরানের পর জো রুট। ছবি: রয়টার্স।
চোট সারিয়ে ফেরা বেয়ারস্টো শুক্রবার ৭৮ বলে ৭৮ রান করেন। দ্রুত রান তোলার কাজে ঘি ঢালেন তিনি। সেই বেয়ারস্টো সম্পর্কে রুট বলেছিলেন, “ক্রিজে নেমে ও কী করতে চায় সেটা এখন পরিষ্কার বুঝতে পারে। সে কারণেই সাফল্য পাচ্ছে। কী অসাধারণ ব্যাটার ও! আনন্দ দেওয়ার সব রকম উপাদান ওর মধ্যে রয়েছে।” রুট এবং বেয়ারস্টোর জুটিই এখন বিপক্ষের কাছে চিন্তার হয়ে উঠছে। এই টেস্টেও ১৭৬ রানে পাঁচ উইকেট হারানো ইংল্যান্ডকে তাঁরা দু’জন মিলে পৌঁছে দেন ২৯৭ রানে ছ’উইকেটে। ১২১ রানের জুটি গড়েন রুট এবং বেয়ারস্টো। এই রান করতে তাঁরা নেন মাত্র ২৩ ওভার।
রুটের মতো শান্ত ব্যাটার টেস্টে এক ইনিংসে চারটি ছক্কা মারছেন। পাঁচ উইকেট পড়ে গেলেও রানের গতি কমছে না দলের। চাঞ্চল্য তৈরি হয়ে যাচ্ছে বিপক্ষের মধ্যে। সাড়া ফেলে দিচ্ছেন রুট, স্টোকসরা। ‘বাজ়বল’ চলছে। যা নিয়ে স্টিভ স্মিথ বলেছিলেন, “আমি ওদের খেলা কিছুটা দেখেছি। খুব উত্তেজনাময় ক্রিকেট। অ্যালেক্স লিজের মতো ক্রিকেটারও ক্রিজ থেকে বেরিয়ে এসে মারতে যায়। দেখতে ভাল লাগে। আমি দেখতে চাই এটা কত দিন টেকে? পিচে যদি ঘাস থাকে আর সেখানে জস হ্যাজেলউড, প্যাট কামিন্স এবং মিচেল স্টার্ক একসঙ্গে আক্রমণ করে তখনও এ রকম খেলবে তো? দেখব তখন কী হয়। সেটা দেখার অপেক্ষায় আছি আমি।” স্লিপে দাঁড়িয়ে স্মিথ দেখলেন সেটা শুক্রবার। এ বার তাঁর দেখানোর পালা।