ওয়ার্নার এমন এক জন ক্রিকেটার, যিনি প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে না খেলেই আন্তর্জাতিক দলে সুযোগ পেয়েছিলেন। ছবি: টুইটার
সাল ২০১৮। বল বিকৃত করার অভিযোগ ওঠে স্টিভ স্মিথ, ডেভিড ওয়ার্নার এবং ক্যামেরন ব্যানক্রফটের বিরুদ্ধে। ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার তরফে তিন জনকেই নির্বাসিত করা হয়। স্মিথ এবং ব্যানক্রফট শাস্তি মেনে নিলেও ওয়ার্নার ভেবেছিলেন তিনি বোর্ডের কাছে শাস্তি কমানোর আবেদন করবেন। যদিও শেষ পর্যন্ত শাস্তি মেনে নেন তিনি। দোষ স্বীকার করতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন। শাস্তি হিসাবে ওয়ার্নারকে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে এক বছরের জন্য নির্বাসিত করা হয়েছিল। সেই সঙ্গে তিনি আর কখনও অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়ক হতে পারবেন না বলেও জানিয়ে দিয়েছিল বোর্ড।
সাল ২০২২। ওয়ার্নার চাইছেন অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়ক হতে। বোর্ডের কাছে আবেদন জানিয়েছেন তাঁর শাস্তি ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য। সতীর্থ স্মিথ যদিও প্যাট কামিন্সের অবর্তমানে অস্ট্রেলিয়াকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। কিন্তু ওয়ার্নারের উপর এখনও নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। চার বছরে সব ধরনের ক্রিকেটে ফিরে রান করলেও নেতৃত্ব নিয়ে এখনও ওয়ার্নারের উপর বোর্ডের নিষেধাজ্ঞা রয়েই গিয়েছে।
ওয়ার্নার এমন এক জন ক্রিকেটার, যিনি প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে না খেলেই আন্তর্জাতিক দলে সুযোগ পেয়েছিলেন। অস্ট্রেলিয়ার ১৩২ বছরের ক্রিকেট ইতিহাসে যা কখনও হয়নি। বাঁহাতি ওপেনারের অভিষেক হয় ২০০৯ সালে। সাদা বলের ক্রিকেটে তাঁর দাপট দেখা গিয়েছে। ১৪১টি এক দিনের ম্যাচে ৬০০৭ রান তুলেছেন তিনি। ৯৯টি টি-টোয়েন্টি ম্যাচে সংগ্রহ ২৮৯৪ রান। মঙ্গলবার শততম টেস্টে দ্বিশতরান করেন ওয়ার্নার। ১০০টি টেস্টে ৮১৪৪ রান করে ফেলেছেন তিনি। তিন ধরনের ক্রিকেটেই শতরান রয়েছে তাঁর। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ৪৫টি শতরান হয়ে গিয়েছে তাঁর।
দোষ স্বীকার করতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন ডেভিড ওয়ার্নার। —ফাইল চিত্র
এমন এক জন ক্রিকেটার শুধু মাঠেই দর্শকদের আনন্দ দেন এমন নয়। ওয়ার্নারের ইনস্টাগ্রাম খুললেই দেখা যায় ভারতের বিভিন্ন সিনেমার গানে নাচছেন তিনি। প্রযুক্তির কারসাজিতে ওয়ার্নার কখনও অল্লু অর্জুন, কখনও সলমন খান, কখনও অজয় দেবগন হয়ে উঠছেন। তাঁর নাচ ভারতীয় সমর্থকদেরও মন জয় করে নিয়েছে। শুধু ওয়ার্নার নন, তাঁর গোটা পরিবারকেই দেখা যায় ইনস্টাগ্রামে বিভিন্ন কার্যকলাপ করতে।
ওয়ার্নার নেটমাধ্যমে যতই হাসিখুশি ছবি পোস্ট করুন, তাঁর ব্যক্তিগত জীবন যে ততটা সুখের নয়, তা বোঝা গিয়েছিল কিছু দিন আগে তাঁর কথাতেই। মানসিক ভাবে ভেঙে পড়েছিলেন তিনি। দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে নামার আগে ওয়ার্নার বলেছিলেন, “পার্থ টেস্টের আগে আমার মানসিক স্বাস্থ্য ১০০ শতাংশ ঠিক ছিল না। এ ভাবে খেললে ভাল পারফরম্যান্স করা কঠিন। অস্থিরতার মধ্যেই ভাল পারফর্ম করতে চাই। এটাই এখন আমার কাছে চ্যালেঞ্জ।”
অ্যারন ফিঞ্চ এক দিনের ক্রিকেট থেকে অবসর নেওয়ার পর পরবর্তী অধিনায়ক নিয়ে সমস্যায় পড়ে ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া। তখন দেশকে নেতৃত্ব দেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন ওয়ার্নার। ফিঞ্চও পরবর্তী অধিনায়ক হিসাবে ওয়ার্নারকে দেখার ইচ্ছার কথা জানান। অস্ট্রেলিয়ার প্রাক্তন ক্রিকেটারদের অনেকেই সীমিত ওভারের ক্রিকেটে ওয়ার্নারকে অধিনায়ক হিসাবে দেখতে চান। ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়াও দীর্ঘ দিনের নিয়ম পরিবর্তন করায় মনে হয়েছিল ওয়ার্নারের নেতৃত্ব পাওয়া সময়ের অপেক্ষা। কিন্তু ওয়ার্নারকে অধিনায়ক করার কোনও ইঙ্গিত এখনও দেননি ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার কর্তারা।
সেটা নিয়েই মানসিক ভাবে ভেঙে পড়েন ওয়ার্নার। তিনি বলেছেন, ‘‘আমি নিজের মতো থাকতে পারলে নিজের মতো সব কিছু সাজিয়ে নিতে পারতাম। কিন্তু ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার দিক থেকে কোনও সমর্থন পাচ্ছি না। আমার সতীর্থ এবং দলের অন্যরা অসাধারণ। আমার পরিবার এবং বন্ধুদের কথাও বলব। সকলেই কঠিন সময়ে আমার পাশে রয়েছে।’’ আরও বলেছেন, ‘‘গত ফেব্রুয়ারিতেই আমরা বিষয়টা জানতে পেরেছিলাম। কিন্তু কী হচ্ছে আমরা কেউই জানি না। একমাত্র ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়াই উত্তর দিতে পারবে। জানতে চাইলেও ওরা উত্তর দেবে না। ওরা অবশ্য কাউকেই কোনও উত্তর দেয় না।’’
বর্তমান পরিস্থিতি তাঁকে প্রায় কোণঠাসা করে দিয়েছে বলেও জানিয়েছেন ওয়ার্নার। বলেছেন, ‘‘দেওয়ালে আমার পিঠ ঠেকে গিয়েছে। যদিও লড়াই আমার ডিএনএ-তে রয়েছে। হাসিমুখেই ফিরে আসব আমি। যে কোনও বিরোধিতার মুখোমুখি হতে রাজি আমি।’’ এই অনিশ্চয়তা নিয়ে চলতে চাইছেন না ওয়ার্নার। বলেছেন, ‘‘দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে সিরিজ় শেষ হলে কর্তাদের সঙ্গে কথা বলব। স্বচ্ছ ধারণা নিয়ে চলতে চাই। আপাতত মাথায় শুধু বক্সিং ডে টেস্ট রয়েছে।’’
এমন পরিস্থিতিতে ব্যাট করতে নেমেও শততম টেস্টে দ্বিশতরান করলেন ওয়ার্নার। আবেগ তাঁকে গ্রাস করেছিল। সোমবার ওয়ার্নারের মেয়েরা ছিল মাঠে। বাবার সঙ্গে দাঁড়িয়ে তারাও জাতীয় সঙ্গীত গেয়েছিল। মাঠে নামার আগে নিজের একটি ছবি ইনস্টাগ্রামে পোস্ট করেন ওয়ার্নার। তিনি লিখেছিলেন, “অস্ট্রেলিয়ার হয়ে একটি টেস্ট খেলার স্বপ্ন ছিল। ১০০টা টেস্ট হয়ে গেল। ভাষায় এই আবেগ প্রকাশ করা সম্ভব নয়।”
বোর্ডের সঙ্গে ওয়ার্নারের গণ্ডগোল, ব্যক্তিগত জীবনের আবেগ, ইনস্টাগ্রামের নাচের মাঝেও কথা বলে তাঁর ব্যাট। হাজার হাজার রান করেন তিনি। মঙ্গলবার দ্বিশতরান করে পরিচিত ঢঙে যে লাফটা দিয়েছিলেন তাতেই বিপত্তি। পা মচকে যায় তাঁর। আর ব্যাট করতে পারেননি। মাঠ ছাড়তে হয় তাঁকে। এটাই ওয়ার্নার। যিনি রান করেন, আবেগ প্রকাশ করেন উচ্চগ্রামে। তাতে কখনও কখনও বিপদও হয়। তবে ওয়ার্নার সে সবকে পাত্তা দেন বলে মনে হয় না। পরের শতরানের সময়ও হয়তো এমন ভাবেই লাফ দেবেন ওয়ার্নার।