আলোচনায় রোহিত শর্মা এবং বিরাট কোহলি। ছবি: এএফপি।
সামনেই নিউ জ়িল্যান্ড এবং অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ভারতের টেস্ট সিরিজ়। এই দুই দলের তুলনায় বাংলাদেশ নেহাতই সহজ প্রতিপক্ষ। সেই দলে শাকিব আল হাসান, মুশফিকুর রহিম, মোমিনুল হকের মতো অভিজ্ঞ ক্রিকেটার থাকলেও তাঁদের ধারাবাহিকতার অভাব রয়েছে। পাকিস্তান বা ভারতের বিরুদ্ধে শাকিবের কোনও অর্ধশতরান নেই। মুশফিকুর পাকিস্তানের বিরুদ্ধে একটি ম্যাচে ১৯১ রান করলেও তার পর থেকে তাঁর ব্যাটে রান নেই। মোমিনুল পাকিস্তানের বিরুদ্ধে প্রথম টেস্টে অর্ধশতরান করেছিলেন। তার পর কখনও ০, কখনও ১ রান করেন। ভারতের বিরুদ্ধে শেষ টেস্টে শতরান করলেও ম্যাচ জেতাতে পারেননি। এ হেন বাংলাদেশের বিরুদ্ধে কার্যত দু’দিনে ভারতের টেস্ট জয়ের তাৎপর্য কতটা?
কোথায় পিছিয়ে বাংলাদেশ?
টেস্টে সফল হতে গেলে ধারাবাহিকতা প্রয়োজন। যেমন ভারতের যশস্বী জয়সওয়াল বাংলাদেশের বিরুদ্ধে চারটি ইনিংসের তিনটিতে অর্ধশতরান করেছেন। টেস্টে সফল হতে গেলে প্রয়োজন গুরুত্বপূর্ণ সময়ে দলকে জেতানো। যেমন প্রথম টেস্টে চেন্নাইয়ে ভারতের প্রথম দিকের ব্যাটারেরা রান না পেলেও রবিচন্দ্রন অশ্বিন শতরান করেন। সেই সঙ্গে রবীন্দ্র জাডেজা করেন ৮৬ রান। গোটা সিরিজ়ে ১১টি উইকেট নেওয়া যশপ্রীত বুমরা দলের প্রয়োজনে নতুন বলে হোক বা পুরনো বলে, ঠিক সময়ে উইকেট নিয়েছেন। এটারই অভাব ছিল বাংলাদেশ দলে। শুরুর দিকে ব্যাটারেরা রান না পেলে লোয়ার অর্ডার কোনও ভরসা দিতে পারেনি। পেসারেরা উইকেট না পেলে, স্পিনারেরা দলকে সাহায্য করতে পারেনি। ভারত ব্যাট বা বল হাতে সামান্য চাপ দিলেই বার বার ভেঙে পড়ছে বাংলাদেশ। কিন্তু আগামী দু’টি সিরিজ়ে ভারতের কাজটা এত সহজ হবে না।
বাংলাদেশের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি রান যশস্বী জয়সওয়াল। ছবি: এএফপি।
নিউ জ়িল্যান্ড কেন তুলনামূলক ভাবে সহজ?
আশা করা যায় ঘরের মাঠে নিউ জ়িল্যান্ড সিরিজ় অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে প্যাট কামিন্সদের সামলানোর তুলনায় সহজ হবে ভারতের কাছে। শ্রীলঙ্কায় গিয়ে সদ্য সিরিজ় হেরেছে কিউইরা। দ্বীপরাষ্ট্রের স্পিন আক্রমণ সামলাতে পারেননি কেন উইলিয়ামসনেরা, সেখানে অশ্বিন-জাডেজা জুটি বেশ কঠিন পরীক্ষা নেবে তাদের। নিউ জ়িল্যান্ডের ব্যাটারদের যেমন ভারতের পিচে পরীক্ষার মুখে পড়তে হবে, তেমনই কঠিন হবে পেসারদের কাজও। ঘরের মাটিতে পাটা উইকেট হোক বা কালো মাটির স্পিন সহায়ক পিচ, বুমরা সব পিচেই উইকেট নিতে অভ্যস্ত। কিন্তু টিম সাউদিদের কাছে কাজটা অতটা সহজ হবে না। পিচ থেকে সাহায্য না পেলে কিউইরা কী ভাবে খেলেন সেটার উপর নির্ভর করবে সিরিজ়ের ভাগ্য। তবে বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের থেকে টেস্ট খেলতে অনেকটাই স্বচ্ছন্দ নিউ জ়িল্যান্ড। ফলে বাংলাদেশের ব্যাটারেরা সকলে একসঙ্গে ব্যর্থ হলেও কিউইদের ক্ষেত্রে হয়তো সেটা হবে না। উইলিয়ামসনের মতো ব্যাটার রয়েছেন, যিনি সব ধরনের পিচে খেলতে অভ্যস্ত। বিশ্বের অন্যতম সেরা ব্যাটা মনে করা হয় তাঁকে। সঙ্গে থাকবেন রাচিন রবীন্দ্র, গ্লেন ফিলিপ্সের মতো আইপিএল খেলা ক্রিকেটারেরা। তাঁরা ভারতীয় পিচের সঙ্গে পরিচিত। ফলে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যতটা সহজে ভারত জিতেছে, নিউ জ়িল্যান্ড সিরিজ় ততটা সহজ হবে না বলেই মনে হচ্ছে। যদিও ভারতীয় দল ফর্মে রয়েছে, কিউইরা স্পিন খেলতে না পারলে তাদেরও হেলায় হারিয়ে দেবে ভারত। তবে রোহিতদের আসল পরীক্ষা বছর শেষের অস্ট্রেলিয়া সিরিজ়। বাংলার রঞ্জিজয়ী অধিনায়ক সম্বরণ বন্দ্যোপাধ্যায় আনন্দবাজার অনলাইনকে বললেন, “নিউ জ়িল্যান্ড সদ্য শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে হেরে এসেছে। ওদের পক্ষে ভারতের মাটিতে ভারতকে হারানোটা সহজ হবে না। স্পিন খেলতে সমস্যায় পড়ছে ওরা। কিউই ব্যাটারদের টেকনিক ঠিক নেই। ওরা স্পিনের বিরুদ্ধে সাবলীল নয়। তাই রোহিতেরা এগিয়েই থাকবে এই সিরিজ়ে।”
অস্ট্রেলিয়া কেন কঠিন?
ভারত শেষ দু’বার অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে গিয়ে সিরিজ় জিতে ফিরেছে। কিন্তু তা-ও কঠিন হবে অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে টেস্ট জয়। প্রথমত অস্ট্রেলিয়ার পিচের চরিত্র ভারতের থেকে আলাদা। সেখানে বাউন্স বেশি। সেই সঙ্গে থাকবে সুইং। ভারতের পিচে সাহায্য পান স্পিনারেরা, অস্ট্রেলিয়ায় সেটা হবে না। তাই ভারতীয় ব্যাটারদের যেমন অস্ট্রেলিয়ায় গিয়ে পরীক্ষার মুখে পড়তে হবে, তেমনই কিছুটা বদল হবে বোলিং আক্রমণেও। অস্ট্রেলিয়া দলে স্টিভ স্মিথ, মার্নাস লাবুশেন, ট্রেভিস হেডের মতো ব্যাটারেরা রয়েছেন। সেই সঙ্গে প্যাট কামিন্স, মিচেল স্টার্ক এবং জস হেজ়লউডের মতো পেসারেরা রয়েছেন। ভারতীয় ব্যাটারদের সেই ত্রিফলা আক্রমণ সামলাতে হবে। সেই সঙ্গে বুমরাদের দ্রুত উইকেট তুলতে হবে। বাংলাদেশের ধারাবাহিকতার অভাব ছিল, বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ জেতা অস্ট্রেলিয়ার কিন্তু প্রতিটি বিভাগেই একাধিক ম্যাচ জেতানো ক্রিকেটার রয়েছেন। ভারতের প্রাক্তন অধিনায়ক মহম্মদ আজহারউদ্দিন আনন্দবাজার অনলাইনকে বললেন, “বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ভারত যথেষ্ট দাপট দেখিয়ে জিতেছে। ব্যাটিং, বোলিং সব কিছুই ফর্মে রয়েছে। অস্ট্রেলিয়ায় পিচ পাল্টাবে, পরিবেশ পাল্টাবে কিন্তু ভারত জানে কী ভাবে খেলতে হবে। তাই আমার মনে হয় কাজটা কঠিন হলেও রোহিতেরা ওখানেও দাপট দেখাতে পারবে।”
ভারতের চিন্তা কোথায়?
চিন্তা ১: কানপুরে বৃষ্টির কারণে আড়াই দিন খেলা হয়নি। তার পরেও ম্যাচ জিতে নিয়েছে ভারত। ওভার প্রতি ৮ রানের বেশি তুলেছে। যখন চেয়েছে ম্যাচের গতি বাড়িয়ে নিয়েছে, সময় বুঝে রাশ টেনেছে। বাংলাদেশের অনভিজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে ছড়ি ঘুরিয়েছেন রোহিতেরা। কখনও মনে হয়নি বাংলাদেশ চাপে ফেলতে পারে। সে যতই পাকিস্তানকে হারিয়ে ভারতের বিরুদ্ধে খেলতে আসুন, নাজমুল হোসেন শান্তরা রোহিতদের তুলনায় ধারেভারে অনেকটাই পিছিয়ে। ফলে চেন্নাই এবং কানপুরে ভারতীয় দলের আত্মবিশ্বাস ছিল তুঙ্গে। ঘরের মাঠে নিউ জ়িল্যান্ডের বিরুদ্ধে তা কাজে লাগবে। কিন্তু টানা ঘরের মাটিতে খেলার পর অস্ট্রেলিয়ার পিচে মানিয়ে নিতে কিছুটা সময় লাগবে রোহিতদের। সেই সময়টা তাঁরা যত কম নেবেন, ততই মঙ্গল। ভারতের প্রাক্তন নির্বাচক সম্বরণ বললেন, “অস্ট্রেলিয়া কিন্তু এ বারে সূচি সাজিয়েছে নিজেদের সুবিধার কথা ভেবে। ভারতকে প্রথম ম্যাচই খেলতে হবে পার্থে। যে পিচে গতি রয়েছে। ভারত ঘরের মাঠে স্পিনসহায়ক পিচে খেলবে। সেখান থেকে অস্ট্রেলিয়ার এই ধরনের পিচে মানিয়ে নিতে হবে। তবে এই ভারতীয় দলের অভিজ্ঞতা রয়েছে। তারা জানে এই ধরনের সমস্যার কী ভাবে মোকাবিলা করতে হবে।”
চিন্তা ২: চেন্নাই টেস্টে বিরাটকে অফ স্টাম্পের বাইরে বল করে আউট করেছিলেন হাসান মেহমুদ। অস্ট্রেলিয়ার পিচে কামিন্স, স্টার্কেরা কিন্তু বিরাটকে বার বার সেই জায়গায় বল করবেন। সেই সঙ্গে বাঁহাতি স্টার্কের বল ঢুকে আসবে পায়ের দিকে। যা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে সামলাতেই হয়নি ভারতকে। বাঁহাতি পেসারদের বিরুদ্ধে বিরাটদের সমস্যার কথা এখন বিশ্বের সব দলই জানে। অস্ট্রেলিয়ায় যাওয়ার আগে সেই সমস্যার সমাধান করতেই হবে ভারতকে। আজহারউদ্দিন বললেন, “ভারত এর আগে দু’বার সিরিজ় জিতেছে ওখানে। ওরা জানে কী ভাবে ওই পরিবেশে মানিয়ে নিতে হবে।”
বাংলাদেশের বিরুদ্ধে দাপট দেখিয়ে জয় ভারতের। ছবি: এএফপি।
কোথায় এগিয়ে ভারত?
এগিয়ে ১: লোয়ার অর্ডার রান করতে জানে। দলের প্রথম ছ’জন ব্যাটার রান না পেলেও ৩০০ রান পার করছে ভারত। কোনও ম্যাচে রোহিতেরা রান না পেলেও অশ্বিনেরা ভরসা দিচ্ছেন। ভারতের প্রথম একাদশের ন’জন ক্রিকেটার ব্যাট করে দিচ্ছেন। এটা দলের অন্যতম শক্তি। হার্দিক পাণ্ড্যের মতো অলরাউন্ডার টেস্ট খেলেন না, তার পরেও ভারতীয় দলের অসুবিধা হয় জাডেজা এবং অশ্বিন থাকায়। ব্যাট হাতে যাঁরা যে কোনও বোলারকে শাসন করার ক্ষমতা রাখেন। সম্বরণ বললেন, “ভারত এখন তিন ধরনের ক্রিকেটেই সেরা। এক দিনের বিশ্বকাপে ফাইনাল খেলেছে, টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জিতেছে এবং বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে ওঠার পথে এক বাড়িয়ে রয়েছে। সেই দল যে কোনও দলকে হারাতে পারে।”
এগিয়ে ২: ভারতীয় দলের বোলিং বৈচিত্র। দেশের মাটিতে তিন জন পেসার নিয়ে খেলছে ভারত। বুমরা, সিরাজ এবং আকাশ দীপ রয়েছেন। আশা করা যায় তাঁরা অস্ট্রেলিয়ায় যাবেন। তত দিনে সুস্থ হয়ে গেলে খেলতে পারেন মহম্মদ শামিও। স্পিনারদের মধ্যে অশ্বিন, জাডেজা ছাড়াও থাকবেন কুলদীপ যাদব এবং অক্ষর পটেল। অস্ট্রেলিয়া যেতে পারেন আরশদীপ সিংহ বা যশ দয়ালের মতো বাঁহাতি পেসারও। সে ক্ষেত্রে ভারতীয় দলে সব ধরনের বোলার থাকবেন, যা ক্রিকেটার বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে সাহায্য করবে রোহিত, গম্ভীরদের।