বেঙ্গালুরুতে অনুশীলনের মাঝে ইনহেলার নিচ্ছেন ইংল্যান্ডের বেন স্টোকস। —ফাইল চিত্র।
কখনও বেন স্টোকস ইনহেলার নিচ্ছেন, কখনও আবার গোটা দল অনুশীলন বাতিল করে দিচ্ছে। বিশ্বকাপের মাঝে এমন কাণ্ড ঘটছে ভারতের বায়ুদূষণের কারণে। দেশের গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলিতে মাত্রাতিরিক্ত দূষণ চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এ বারের ক্রিকেট বিশ্বকাপ না হয় কোনও মতে হয়ে গেল। আগামী দিনে অলিম্পিক্সের মতো বড় কোনও প্রতিযোগিতার আয়োজনের অনুমতি পাবে তো ভারত?
নভেম্বর-ডিসেম্বরে প্রতি বার দূষণের মাত্রা বৃদ্ধি পায় ভারতে। এই নিয়ে একাধিক বার সোচ্চার হয়েছেন পরিবেশবিদেরা। কিন্তু সমস্যার সমাধান এখনও দেখা যায়নি। এ বারের বিশ্বকাপে বেন স্টোকসের মতো ক্রিকেটার ইনহেলার নিচ্ছেন, এই ছবি চমকে দিয়েছে সকলকে। ইংল্যান্ডের এক সংবাদমাধ্যম সূত্রে জানা গিয়েছে, দীপাবলির আগে যে হেতু ভারতে দূষণ বৃদ্ধি হয়, সেই কারণে খেলোয়াড়দের সাবধানে থাকতে বলা হয়েছে। ক্রিকেটারদের ইনহেলার নিতে বলা হয়েছে। হৃদ্যন্ত্রে যাতে সমস্যা না হয় সেই কারণেই এই ব্যবস্থা বলে জানা গিয়েছে। বেঙ্গালুরুতে অনুশীলনের সময় ইনহেলার নিতে দেখা গিয়েছিল স্টোকসকে।
দিল্লিতে দূষণ আরও বেশি। সেখানে বিশ্বকাপে শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে গত মঙ্গলবার ম্যাচ ছিল বাংলাদেশের। রবিবার দূষণের ভয়ে অনুশীলন করেননি শাকিব আল হাসানেরা। সোমবার বাংলাদেশের পাশাপাশি শ্রীলঙ্কাও অনুশীলন করেনি। পরিবেশবিদেরা যে পরিস্থিতির কথা বার বার বলে আসছিলেন, বিদেশি ক্রিকেটারদের অনুশীলন করতে না পারা সেটাকেই আরও জোরালো ভাবে প্রতিষ্ঠা করল। শ্রীলঙ্কা দলের পক্ষ থেকে বলা হয়, “চিকিৎসকেরা নজর রাখছেন ক্রিকেটারদের স্বাস্থ্যের দিকে। কয়েক জন ক্রিকেটার অনুশীলনে আসতে পারেননি, তাঁদের শ্বাসকষ্টের সমস্যা থাকায়। বাইরে বার হতে চাইছেন না তাঁরা। অনুশীলনে বোলিং আর ব্যাটিং করা ছাড়া বাইরে থাকা যাচ্ছে না। যেটুকু অনুশীলন না করলেই নয়, সেটুকুই করা হচ্ছে।”
দিল্লিতে দূষণের কারণে মাস্ক পরে অনুশীলনে শ্রীলঙ্কা দল। ছবি: পিটিআই।
দূষণের দিকে নজর রেখেছিল আইসিসি-ও। মঙ্গলবার ম্যাচ হবে কি না তা নিয়েই প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছিল। এমন পরিস্থিতিতে দূষণের কারণে যেমন মাস্কে মুখ ঢাকতে হচ্ছে, তেমনই গোটা বিশ্বের সামনে লজ্জায় মুখ ঢাকতে হচ্ছে ভারতকে।
বিশ্বকাপের কারণে দূষণ আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে মনে করছেন পরিবেশবিদ সুভাষ দত্ত। তিনি বললেন, “বিশ্বকাপ আয়োজনে দেশের বায়ুদূষণ কিন্তু আরও বাড়ছে। প্রতিটা ম্যাচ শেষে বাজি ফাটানো চলছে। কেউ ভাল খেললে বাজি ফাটানো হচ্ছে। পরিবেশ নিয়ে চিন্তা আরও বাড়িয়ে দিতে পারে বিশ্বকাপ। ক্রিকেট এমন একটা খেলা যেটা কিন্তু সকালেও খেলা সম্ভব। কিন্তু শুধুমাত্র আনন্দ, উদ্যাপনের কারণে রাতে বিশাল আলো জ্বালিয়ে খেলা চলছে। তাতে মানুষের বিনোদন হলেও পরিবেশের কোনও উন্নতি হচ্ছে না।”
কিছু দিন আগেই ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী জানিয়েছিলেন ২০৩৬ সালের অলিম্পিক্স আয়োজন করার চেষ্টা করবে ভারত। আমদাবাদে সেই প্রতিযোগিতা আয়োজনের চেষ্টা করা হতে পারে। কিন্তু বায়ুদূষণে খেলোয়াড়দের স্বাস্থ্যে প্রভাব ফেললে অলিম্পিক্স আয়োজনের অনুমতি পাওয়াই কঠিন হয়ে যাবে। হাতে ১৩ বছর রয়েছে। এর মধ্যে বায়ুদূষণ কমিয়ে ফেলা কি সম্ভব? আশা দেখছেন না সুভাষ। ৩০ বছরের বেশি সময় ধরে পরিবেশের উন্নতির জন্য কাজ করছেন তিনি। সুভাষ বললেন, “১৩ বছর পর কী হবে সেটা এখনই বলা সম্ভব নয়। কিন্তু উন্নতি করতে গেলে তো সেই অনুযায়ী কাজ করতে হবে। সেটাই তো দেখা যাচ্ছে না। এর জন্য শুধু সরকারকে দায়ী করলে চলবে না। নিজেদের সচেতন হতে হবে। বিশ্বভারতীর প্রফেসর অরণি চক্রবর্তী ৬-৭ কিলোমিটার দূরে যাওয়ার জন্য সাইকেল ব্যবহার করেন। তিনি বাড়িতে সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহার করেন। এমন ঘটনা একেবারেই ব্যতিক্রমী। শুধুমাত্র সাময়িক স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য শীতাতপ যন্ত্র, গাড়ি ব্যবহার করি। মানুষকে সচেতন হতে হবে। তবেই বায়ুদূষণ কমবে। তাতে ১৩ বছরে যদি বাতাসের উন্নতি না-ও হয়, অন্তত উন্নতি করার দিকে এগোতে পারব আমরা।”
বিশ্বকাপের ম্যাচ শেষে মাঠেই ফাটছে বাজি। —ফাইল চিত্র।
দিল্লিতে বাতাসের গুণগত মান (একিউআই) বুধবার সকালে ৫১২। যে শহরগুলিতে বিশ্বকাপের ম্যাচ হয়েছে, সেগুলির মধ্যে সব থেকে খারাপ অবস্থা দিল্লির। দ্বিতীয় স্থানে লখনউ। সেখানে একিউআই ২৭৪। তৃতীয় স্থানে কলকাতা। এই শহরের বাতাসের গুণগত মান বুধবার সকালে ২০৫। চতুর্থ স্থানে আমদাবাদ। সেখানে একিউআই ১৬৮। এখানেই অলিম্পিক্স আয়োজনের ভাবনা রয়েছে মোদী সরকারের। অবস্থা ভাল নয় মুম্বইয়েও। সেখানে বাতাসের গুণগত মান বুধবার সকালে ১৫১। মন্দের ভাল পুণে (৭৮), হায়দরাবাদ (৬০), ধর্মশালা (৬৩) এবং চেন্নাইয়ে (৫৪)। পরিবেশবিদদের মতে বাতাসের গুণগত মান থাকা উচিত ৫০-এর মধ্যে। বিশ্বকাপের ম্যাচ হওয়া ১০টি শহরের মধ্যে বেঙ্গালুরু (৩৫) ছাড়া আর কোথাও ৫০-এর নীচে একিউআই নয়।
দিল্লির অবস্থা এতটাই খারাপ যে, সে রাজ্যের পরিবেশমন্ত্রী গোপাল রায় জানিয়েছেন, চলতি সপ্তাহে দিল্লির সব স্কুল বন্ধ থাকবে। শুধু দশম এবং দ্বাদশ শ্রেণির ক্লাস হবে। ইতিমধ্যে গ্রেডেড রেসপন্স অ্যাকশন প্ল্যান (জিএআরপি)-এর চতুর্থ পর্যায়ের অধীনে দিল্লিতে ডিজেল ট্রাক চলাচল এবং নির্মাণকাজ বন্ধ করার নির্দেশ দিয়েছে কেন্দ্র। দিল্লির পরিবেশমন্ত্রী জানিয়েছেন, বিএস৩ পেট্রোল এবং বিএস৪ ডিজেল চালিত ট্রাক চলাচলেও নিষেধাজ্ঞা থাকছে। দীপাবলিতে বাজি এবং ধোঁয়া ছাড়ার বন্দুক (স্মগ গান)-ও বাতিল হয়েছে। পাশাপাশি, গাড়ি চলাচলের ক্ষেত্রে ফের জোড়-বিজোড় নীতি চালু করা হয়েছে। গত কয়েক বছর ধরেই দিল্লিতে দূষণ নিয়ন্ত্রণের জন্য এই নীতি চালু করা হয়। জোড় তারিখের দিনে দিল্লিতে চলবে শুধু সেই সব গাড়ি, যার নম্বরের শেষ অঙ্ক জোড়। বিজোড় তারিখে চলবে সে সব গাড়ি, যার নম্বরের শেষ অঙ্ক বিজোড়। আপাতত ২০ তারিখ পর্যন্ত জারি থাকবে এই নিয়ম। তার পর প্রয়োজন হবে কি না, বিবেচনা করে দেখবে প্রশাসন।
দূষণে ঢেকেছে দিল্লির ইন্ডিয়া গেট। ছবি: পিটিআই।
পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, শ্বাসকষ্ট, চোখ জ্বালার মতো উপসর্গ দেখা দিচ্ছে দিল্লিবাসীদের। পরিবেশবিদেরা বলছেন, দিল্লিতে যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, তাতে শুধু মানুষের উপরই প্রভাব পড়ছে না, পশুপাখিদের উপর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। শহরের এক পশু চিকিৎসক জানিয়েছেন, শ্বাসকষ্টের উপসর্গ ধরা পড়েছে এমন ১০টি পাখির চিকিৎসা করেছেন তিনি। দিল্লি পুরনিগম জানিয়েছে, দূষণ পরিস্থিতি সামলাতে ৫১৭টি নজরদারি দল গঠন করা হয়েছে। ১,১১৯ জন আধিকারিককে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় মোতায়েন করা হয়েছে। রাস্তায় জল ছেটানো হচ্ছে। স্মগ গান দিয়ে ধোঁয়াশা কাটানোর ব্যবস্থা করা হচ্ছে। দূষণ চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে এমন এলাকাগুলিতে জল ছেটানো হচ্ছে। কিন্তু তার পরেও পরিস্থিতি খারাপ থেকে আরও খারাপ পর্যায় এমনকি অত্যন্ত ভয়ানক পর্যায় গিয়ে ঠেকেছে। যা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরাও।
দিল্লির পরিবেশমন্ত্রী গোপাল রাই জানিয়েছেন, গোটা উত্তর ভারত বায়ুদূষণের সমস্যায় ভুগছে। দিল্লির বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে যথাযথ পদক্ষেপ করার জন্য কেন্দ্রীয় পরিবেশমন্ত্রী ভূপেন্দ্র যাদবের কাছে আর্জিও জানিয়েছেন তিনি। সেন্টার ফর সায়েন্স অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট-এর তথ্য তুলে ধরে মন্ত্রী গোপাল রাই দাবি করেছেন, দিল্লির দূষণের জন্য ৬৯ শতাংশ দায়ী প্রতিবেশী রাজ্যগুলি। তাঁর কথায়, “এই সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য আমরা সব রকম পদক্ষেপ করছি। কিন্তু উত্তরপ্রদেশ এবং হরিয়ানার পরিবেশমন্ত্রীরা এ বিষয়ে কী পদক্ষেপ করছেন, সে বিষয়ে কেউ কিছুই জানেন না।”
পরিবেশবিদেরা বহু দিন ধরেই বায়ুদূষণ নিয়ে সোচ্চার। কিন্তু বিশ্বকাপ সেই সব কিছুকে আরও বড় করে সামনে এনে দিল। আগামী দিনে কি পরিস্থিতি পাল্টাবে? সুভাষ বললেন, “আমরা বৈদ্য্যুতিক গাড়ি ব্যবহার করার কথা বলছি আবার সেই বিদ্যুৎ তৈরি করার জন্য কয়লা পুড়িয়ে দূষণ বৃদ্ধি করছি। দুটো একসঙ্গে হতে পারে না। চিন্তাধারার বদল প্রয়োজন।”
২০৩৬ সালে ভারত আদৌ অলিম্পিক্স আয়োজন করতে পারবে কি না তা সময় বলবে। কিন্তু সে দিকে নজর রেখে পরিবেশের উন্নতি করা হলে তাতে ভারতেরই লাভ হবে বলে মনে করছেন পরিবেশবিদেরা।