মানবিক: করোনা-যুদ্ধে নারীশক্তিকে কুর্নিশ সচিনের। ফাইল চিত্র
কেউ কেরলের ওয়েনাড জেলার ডিস্ট্রিক্ট কালেক্টর। করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে রাজ্যের অন্যতম প্রধান মুখ। কেউ কর্মরত নার্স। সন্তানদের থেকেও দূরে থাকতে হচ্ছে। মৃত্যুভয় তুচ্ছ করে সেবা করে যাচ্ছেন মানুষের। কেউ আবার সুদূর বার্মিংহামে করোনার বিরুদ্ধে লড়াই করে ফিরে এসেছেন। কেউ কোচির ডেপুটি পুলিশ কমিশনার, লকডাউনে নজরদারির দায়িত্বে। আবার কেউ লড়ছেন ইজরায়েলে। অতিমারির এই সময়ে দিনরাত এক করে কর্তব্য পালন করে যাচ্ছেন ওঁরা। আজ রবিবার মাতৃদিবস। সেই উপলক্ষে করোনা বীরাঙ্গনাদের সঙ্গে আলাপচারিতায় সচিন তেন্ডুলকর। বরাবর তাঁকে প্রশ্ন করেছেন সাংবাদিকেরা। কিন্তু শনিবার তিনি নিজেও প্রশ্নকর্তার ভূমিকায়। অভিনব সেই কথোপকথন বাংলা এবং পূর্বাঞ্চলে একমাত্র আনন্দবাজারের সংগ্রহে...
সচিন তেন্ডুলকর: (ওয়েনাড জেলার কোভিড সেলের দায়িত্বে থাকা আইএএস, আদিলা আবদুল্লাকে): কী ভাবে সব দিক সামলাচ্ছেন জানতে চাইব...
আদিলা: আমার তিনটি সন্তান। শুরুতে সত্যিই খুব কষ্ট হচ্ছিল। রাতে ফিরতাম। বাচ্চারা পেতই না। ওরা প্রথমে ভেবেছিল, স্পাইডারম্যানের মতো ওদের মা বোধ হয় অতিমানবীয় কোনও কাজে ব্যস্ত। এখন বুঝতে পেরেছে, মা করোনার বিরুদ্ধে লড়ছে। তাই বলছে, করোনা দ্রুত বিদায় নিক। যাতে আগের মতো মা-কে পায়।
সচিন (ইংল্যান্ডের আইনজ্ঞকে প্রশ্ন, যিনি করোনা পরীক্ষার জন্য বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছেন): আপনার নিজের করোনা হয়েছিল। শুধু করোনাকে হারিয়ে ফিরেই আসেননি, অন্যদের সাহায্য করতেও এগিয়ে এসেছেন। আপনার কথা শুনি...
অম্রুতা জয়কৃষ্ণ: নমস্তে স্যর। আমার স্বামী ডাক্তার। আমাদের উপসর্গ দেখা দিয়েছিল। ভাগ্য ভাল যে, খুব বাড়াবাড়ি হয়নি। তবে ইংল্যান্ডে একটা জিনিস দেখছিলাম যে, যথেষ্ট পরীক্ষা হচ্ছে না। তাই কতগুলো ল্যাবরেটরির সঙ্গে কথা বলে অর্থ সংগ্রহ করে আমরা পরীক্ষার ব্যবস্থা করি। সমাজের প্রতি কিছু অবদান যদি রাখা যায়...
সচিন: আপনাকে একটা কথা বলি। কোনও অবদানই ছোট হয় না। আসল হচ্ছে, মনের অভিপ্রায়। আর মনে রাখবেন, সকলে মিলে আমাদের এই ‘ম্যাচটা’ জিততে হবে।
আরও পড়ুন: ১৬ বছর আগে ধোনির ডেবিউ ম্যাচের সেই সতীর্থরা আজ কে কোথায়
(এ বার সচিনকে প্রশ্ন করা শুরু)
প্রশ্ন: আপনার মতো ব্যস্ত সেলেব্রিটিদের কাছে কি শাপে বর হওয়ার মতো এই লকডাউন? পরিবারের সঙ্গে এ ভাবে তো থাকা হয় না। কী ভাবে সময় কাটাচ্ছেন?
সচিন তেন্ডুলকর: শাপে বর হল বলব না। চাই না, এ রকম সময় আমাদের জীবনে আসুক। কঠিন চ্যালেঞ্জের মধ্যে দিয়ে যেতে হচ্ছে সকলকে। তিন মাস আগেও কেউ ভাবতে পারিনি এ রকম একটা সময়ের মধ্যে দিয়ে যেতে হতে পারে। এখন গোটা বিশ্বের ভাবনাটাই পাল্টে গিয়েছে। আমি নিশ্চয়ই এখন বাড়িতে থাকছি বলে পরিবারের সঙ্গে বেশি সময় কাটাতে পারছি। ১৫ মার্চের পরে আমি বাড়ি থেকে বেরোইনি, এমনকি কোনও বন্ধুর সঙ্গেও দেখা করিনি। সকলকে তাই বলে চলেছি, তোমরাও বাড়িতে থাকো। সরকারের বার্তা অনুযায়ী লকডাউন মেনে চলো।
প্র: লকডাউনে বাড়িতে আটকে থাকতে থাকতে কী করছেন?
সচিন: আমি মায়ের সঙ্গে অনেক গল্প করেছি। তাঁর থেকে অনেক কিছু আবার নতুন করে শিখেছি। পুরনো দিনের অনেক কথা, অনেক ঘটনা নতুন করে যেন প্রত্যক্ষ করলাম। স্ত্রী অঞ্জলি, পুত্র অর্জুন বা কন্যা সারার সঙ্গেও ভাল সময় কাটছে। আমরা একসঙ্গে ক্রিকেট খেলছি, গল্প করছি, সিনেমা দেখছি। শুনলে অবাক হয়ে যাবেন, আমরা সকলে মিলে রান্নাও করছি। তা ছাড়া নিজের হাতে একটা সুন্দর হেয়ারকাটও করেছি।
প্র: নমস্কার। আমি বার্মিংহাম থেকে বলছি। আমি এজবাস্টন ক্রিকেট মাঠের কাছে থাকি, যেখানে আপনি অনেক ম্যাচ খেলেছেন। বার বার নীল জার্সির স্রোতে ভেসেছি। অনেক দিন হল, মাঠ একদম ফাঁকা। পার্কে কোনও লোক নেই। পাল্টে যাওয়া সময়ে আছি আমরা সকলে। আমার প্রশ্ন, আপনার মা ঠিক কী ভেবে আপনাকে কিশোর বয়স থেকে নিজের প্রিয় খেলা ক্রিকেট নিয়ে থাকার স্বাধীনতা দিয়েছিলেন?
সচিন: দেখুন, আমার মনে হয়, সব বাবা-মায়েরাই চান, তাঁদের সন্তানেরা নিজেদের পছন্দের কেরিয়ারের দিকেই যাক। বাবা-মায়েরা চান, তাঁদের ছেলেমেয়েরা যে বিভাগেই যাক না কেন, নিজেদের সেরা প্রচেষ্টাটুকু দিক। আমার ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা তেমনই ছিল। আমাদের বড় পরিবার। বাবা, মা, দুই বড় ভাই, দিদি, কাকা, কাকিমা— সকলেই আমার ক্রিকেট প্রেমকে সমর্থন করেছেন। ওঁরা সকলে বলতেন, সচিন যদি ক্রিকেটার হতে চায়, আমাদের সম্পূর্ণ সমর্থন থাকবে। জীবনের প্রথম ক্রিকেট ব্যাট আমি পেয়েছিলাম দিদির কাছ থেকে। ওটা ভীষণ স্পেশ্যাল একটা মুহূর্ত। যত সময় এগিয়েছে, সব চেয়ে বড় ভূমিকা নিয়েছে দাদা অজিত। আমার ক্রিকেটে পুরোপুরি মন দেওয়ার সিদ্ধান্ত বাবা-মায়ের ছিল না। ছিল দাদা অজিতের। দাদার কথায় বাবা, মা রাজি হয়েছিলেন। বাবা প্রফেসর ছিলেন। তার পরেও খেলায় যেতে মত দিয়েছিলেন, জেনেবুঝে যে, ক্রিকেট খেললে পড়াশুনো ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আমার ছোটবেলাতেই ওঁরা বুঝে যান, আমার ঝোঁক আউটডোর খেলায়। সহজাত কিছু দক্ষতা আমার মধ্যে দেখেছিল দাদা অজিত। এমনিতে আর সকলের মতো আমার ক্ষেত্রেও মায়ের কাঁধ হচ্ছে সেই বিরল জায়গা যেখানে নির্ভাবনায় যে কোনও সময়ে মাথা রাখতে পারি। যে আবদার কারও কাছে করা যায় না, তা-ই তো করা যায় মায়ের কাছে। খেলার ক্ষেত্রে কিন্তু দাদা অজিতই রাজি করায় বাবা ও মা-কে।
প্র: (এক ডাক্তার) আমরা শুনেছি, আপনার মা রজনী তেন্ডুলকর সব সময় খুব নার্ভাস থাকতেন আপনি ব্যাট করার সময়। কিন্তু ২০১৩ সালে আপনার খেলা দেখতে মাঠে এসেছিলেন রজনী দেবী। মায়ের সামনে দেশের জার্সি গায়ে ক্রিকেট খেলার অভিজ্ঞতা কেমন ছিল?
সচিন: বিস্ময়কর শোনালেও সত্যি, ওই এক বারই আমার খেলা দেখতে মা উপস্থিত ছিলেন। ক্রিকেটকে বিদায় জানানোর আগে ওটাই আমার একটা শেষ ইচ্ছা ছিল। আমি এন শ্রীনিবাসনকে (বোর্ডের তখনকার প্রেসিডেন্ট) ফোন করে বলেছিলাম, ওয়াংখেড়েতে শেষ ম্যাচ খেলতে চাই আমার মায়ের চোখের সামনে। চব্বিশ বছর ধরে আমি ভারতের হয়ে খেলেছি কিন্তু মা কখনও আমার খেলা দেখতে মাঠে আসেননি। এন শ্রীনিবাসন সেই অনুরোধ রেখেছিলেন। ভারতের হয়ে খেলা তো ছেড়েই দিন, স্কুল জীবন থেকেই মা কখনও আমার খেলা দেখেননি। তাই আমি চেয়েছিলাম, ক্রিকেট থেকে বিদায় নেওয়ার আগে অন্তত এক বার মাঠে এসে খেলা দেখার অভিজ্ঞতা হোক মায়ের। চেয়েছিলাম, এক বার মাঠে এসে সরাসরি মা দেখুন, গত চব্বিশ বছর ধরে ছেলে কী করছিল! ওয়াংখেড়েতে দিনের শেষ ওভারটা যখন আমি খেলছিলাম, প্রত্যেকটা বলের পরে মাঠের জায়ান্ট স্ক্রিনে আমার পরিবারকে দেখাচ্ছিল। বাইশ গজে দাঁড়িয়ে নিজের আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করা তখন খুব কঠিন হয়ে যাচ্ছিল। বিশেষ করে মায়ের মুখটা যখন ভেসে উঠছিল জায়ান্ট স্ক্রিনে। ক্রিকেট চিরদিন থাকে না, কিন্তু মায়ের ওই মুখটা, আমি ব্যাট করছি আর ওঁর মুখের সেই প্রতিক্রিয়াটা বাকি জীবন আমার সেরা স্মৃতি হয়ে থাকবে।
প্র: (করোনাভাইরাসে কর্মরত ডাক্তার) আপনার স্ত্রী অঞ্জলিও খুব মানসিক ভাবে শক্তিশালী এক জন মা। যিনি নিজে ডাক্তার, আবার একার হাতে সংসার সামলেছেন। আপনার জীবনে অঞ্জলির ভূমিকা নিয়ে কী বলবেন?
সচিন: অঞ্জলির সামনে খুব ভাল কেরিয়ার ছিল। একটা সময় এল যখন আমাদের সন্তান হল। অঞ্জলি তখন বলে তুমি কেরিয়ার এগিয়ে নিয়ে যাও। আমি পরিবার সামলাব। ডাক্তারি ছেড়ে দিল। ওর মতো জীবনসঙ্গিনী পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। খেলোয়াড়ের জীবনে অনেক ‘স্ট্রেস’ থাকে। সারাক্ষণ তাকে নিয়ে কাঁটাছেঁড়া চলছে। ক্রমাগত বিচার চলছে। তাই পরিবারের সমর্থন এবং জীবনসঙ্গীর সহায়তার খুব বড় ভূমিকা থাকে। অঞ্জলির সঙ্গে পার্টনারশিপ আমার মাঠের যুদ্ধ সহজ করে দিয়েছিল। ব্যাটসম্যানদের মেজাজ ঠিক রাখতে হয়। অঞ্জলি এ ব্যাপারে উদাহরণ। এত ঠান্ডা, ধীরস্থির আর এত সুন্দর নিয়ন্ত্রণ যে, আমারও কখনও অস্থির লাগত না। আর সেটা ক্রিকেট মাঠে শান্ত, নিয়ন্ত্রিত থাকতে সাহায্য করত। সাধারণত এক জন খেলোয়াড় যখন ভাল খেলে, তার উপরেই টিভি ক্যামেরা ফোকাস করে। আসলে কিন্তু তার সাফল্যের পিছনে থাকে বড় একটা টিম। পরিবারের টিম।
প্র: আপনার সব চেয়ে পছন্দের খাবার কী?
সচিন: আমি খেতে খুব ভালবাসি। নানা জায়গায় আমাকে যেতে হয়েছে। নানা রকম খাবারও চেষ্টা করে দেখেছি। থাই খেয়েছি, পাস্তা, জাপানিজ। কিন্তু মায়ের হাতের রান্নার সঙ্গে কোনও কিছুর তুলনা হয় না। ওটাই সেরা। আমি যখন বিদেশ থেকে খেলে ফিরতাম, মায়ের কাছে আবদার থাকত, তোমার হাতের একদম ঘরোয়া রান্না খেতে চাই। মরাঠি স্টাইলের ডাল-ভাত খুব প্রিয় আমার। সঙ্গে একটু লেবু থাকলে, আহা! আমি চিংড়ি খেতে ভালবাসি। এটাও সব চেয়ে প্রিয় মায়ের হাতের রান্নাটাই। মায়ের একটা নিজস্ব রেসিপি আছে চিংড়ির। মায়ের থেকে এখন আমি শিখে ফেলেছি। তাই বলি, আমিও কিন্তু এখন মায়ের স্টাইলের চিংড়ি রান্না করতে পারি।
আরও পড়ুন: চার হাজার দুঃস্থের পাশে দাঁড়ালেন সচিন
(অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। স্বভাবতই আপনি নানান ঘটনার সাক্ষী। শেয়ার করুন আমাদের। ঘটনার বিবরণ, ছবি, ভিডিয়ো আমাদের ইমেলে পাঠিয়ে দিন, feedback@abpdigital.in ঠিকানায়। কোন এলাকা, কোন দিন, কোন সময়ের ঘটনা তা জানাতে ভুলবেন না। আপনার নাম এবং ফোন নম্বর অবশ্যই দেবেন। আপনার পাঠানো খবরটি বিবেচিত হলে তা প্রকাশ করা হবে আমাদের ওয়েবসাইটে।)