অঙ্গীকার: কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করে হারিয়ে দেবেন করোনাকে। প্রধানমন্ত্রীকে এ ভাবেই আশ্বাস দিলেন সৌরভ, সচিন। (বাঁ দিকে) টেলিকনফারেন্সে নরেন্দ্র মোদীকে নমস্কার ভারত-অধিনায়ক বিরাট কোহালির। শুক্রবার। টুইটার
করোনাভাইরাস সংক্রমণ নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বিশেষ টেলি-বৈঠকে যোগ দিতে ‘ওপেনার’ হিসেবেই আবির্ভূত হয়েছিলেন সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। যে জায়গায় তাঁকে দেখা যেত ওয়ান ডে ম্যাচে ভারত ব্যাট করার সময়ে। আর তাঁর প্রাক্তন সতীর্থ এবং দীর্ঘ দিনের বন্ধু সচিন তেন্ডুলকর এলেন তাঁর বিখ্যাত টেস্টের ব্যাটিং অর্ডার, চার নম্বরে।
সৌরভ সেই হার-না-মানা অধিনায়কের মতোই করোনার বিরুদ্ধে এই লড়াই ‘জিততেই হবে’ মন্ত্র নেওয়ার ডাক দেন। দলগত সংহতির উপরে জোর দিতে বলেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী যখন শুরুতেই তাঁর বক্তব্য চান, কমেন্ট্রি এবং নানা অনুষ্ঠানে সুবক্তা হিসেবে বন্দিত সৌরভ বলেন, ‘‘সকলে এককাট্টা হয়ে লড়তে হবে। লকডাউনকে সফল করতেই হবে কারণ বিভিন্ন দেশের পরিস্থিতি থেকে পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে, করোনাভাইরাস থেকে রক্ষা পেতে গেলে একে অন্যের সঙ্গে ব্যবধান রাখতে হবে। তার জন্য বাড়িতে থাকাটাই একমাত্র পথ।’’একযোগে করোনাভাইরাসের মোকাবিলার শপথ নেওয়ার উপরে জোর দেন সৌরভ। ভারতীয় ক্রিকেট ভক্তদের হৃদয় জয় করে নিয়েছিল সৌরভের ‘টিম ইন্ডিয়া’। সেই দল যে ভাবে তাঁরা গড়ে তুলেছিলেন, একই মন্ত্র করোনা মোকাবিলার ক্ষেত্রেও শোনা যায় তাঁর মুখে। শোনা গেল, টেলি-বৈঠকে তিনি বলেছেন, ‘‘কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে টিম হিসেবে এই যুদ্ধ জিততে হবে আমাদের। এবং, আমরা এই যু্দ্ধ জয় করবই।’’ টিম ইন্ডিয়ার সেই চোয়াল শক্ত করা, নাছোড় অধিনায়কই যেন উদয় হয়েছিলেন এ দিন। পরে তাঁর প্রিয় ওয়ান ডে ওপেনিং পার্টনার, যাঁর সঙ্গে তিনি বহু রেকর্ড তৈরি করে রেখেছেন, তিনিও এসে টিম স্পিরিটের উপরে জোর দিয়ে যান। তিনি— সচিন তেন্ডুলকর।
দেশের অন্তত চল্লিশ জন ক্রীড়াবিদের সঙ্গে শুক্রবার বেলা এগারোটা থেকে বিশেষ এই টেলি-বৈঠক করেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। ক্রিকেটারদের মধ্যে ছিলেন সচিন, সৌরভ, বিরাট, ধোনি, সহবাগ, যুবরাজ, মহম্মদ শামি, কে এল রাহুল। অন্যান্য জগতের তারকাদের মধ্যে ছিলেন দাবায় প্রাক্তন বিশ্বচ্যাম্পিয়ন এবং দেশের গর্ব বিশ্বনাথন আনন্দ, ব্যাডমিন্টনে সদ্য বিশ্বচ্যাম্পিয়ন পি ভি সিন্ধু, ভারোত্তোলনের মীরাবাই চানু। ব্যাডমিন্টন থেকে গোপীচন্দ, সাইনা নেহওয়াল, সাই প্রণীতও ছিলেন। অলিম্পিক্সের খেলাধুলো থেকে অনেক ক্রীড়াবিদ অংশ নিয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রী যে করোনা নিয়ে এমন একটি টেলি-বৈঠক করতে চলেছেন, সেই খবর শুক্রবার সকালেই আনন্দবাজারের খেলার পাতায় প্রকাশিত হয়েছিল।
প্রবীণদের বাড়তি খেয়াল রাখার দিকে নজর দেওয়ার উপরে জোর দেওয়ার কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী। করোনায় আক্রান্তদের মধ্যে বয়স্কদের সংখ্যা বেশি। এখন পর্যন্ত রিপোর্ট অনুযায়ী, সব দেশেই করোনায় আক্রান্তদের মধ্যে বয়স্ক মানুষের সংখ্যা বেশি। ক্রীড়াবিদদের সঙ্গে টেলি-বৈঠকেও করোনা ত্রাসের এই দিকটি উঠে আসে। ক্রীড়াবিদদের কাছে এমনও প্রস্তাব রাখেন প্রধানমন্ত্রী যে, পরিচিত বয়স্ক মানুষের জীবনকাহিনি শুনিয়ে তাঁদের প্রতি বিশেষ সচেতনতা গড়ে তোলা যেতে পারে। তাঁদের অভিজ্ঞতার কথা মানুষের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া যায় কি না, সে ব্যাপারে ক্রীড়াবিদদের ভেবে দেখতে বলেন তিনি।
সচিন তেন্ডুলকর বক্তব্য রাখতে এসে বলেন, ‘‘এখন পর্যন্ত লকডাউনে আমরা খুব ভাল করেছি। শৃঙ্খলা এবং সংযম দেখিয়েছি। কিন্তু ১৪ এপ্রিল লকডাউন উঠে গেলেই যেন হাল্কা দিয়ে না-ফেলি।’’ মোদী একমত হন সচিনের সঙ্গে যে, লড়াই ১৪ এপ্রিলেই শেষ হয়ে যাবে না। সচিন তখন আরও বলেন, ‘‘আমার মনে হয়, ১৪ এপ্রিলের পরবর্তী পর্যায়ে আমরা কী ভাবে নিজেদের শৃঙ্খলাপরায়ণ রাখতে চলেছি, তা খুব গুরুত্বপূর্ণ হতে যাচ্ছে।’’ জানা গেল, সচিন এমনও প্রস্তাব দিয়েছেন যে, করোনা অতিমারী থেকে মুক্তি পাওয়ার পরেও করমর্দনের অভ্যেস ত্যাগ করা জরুরি। টেলি-বৈঠকে ভারতরত্ন ক্রিকেটার বলেন, ‘‘আমরা এখন যে রকম হাত মেলানোর চেয়েও নমস্কার করছি, সেটাই চালিয়ে যাওয়া উচিত বলে আমার মনে হয়।”
এখানেই শেষ নয়। বরাবর একশো কোটি মানুষের প্রত্যাশার চাপ নিয়ে ব্যাট করে যাওয়া সচিন প্রধানমন্ত্রীর টেলি-বৈঠকে জোর দেন মানসিক শক্তির উপরেও। বলেন, ‘‘শারীরিক ভাবে যেমন করোনার বিরুদ্ধে লড়াই করতে হচ্ছে, তেমনই মানসিক দিকটাও খুব গুরুত্বপূর্ণ। মানসিক ফিটনেসের দিকেও আমাদের নজর দিতে হবে।’’ এর পরে তিনি কয়েকটি টোটকাও দেন, কী ভাবে এই উদ্বেগের সময়েও নিজের মনকে ফুরফুরে রাখা যায়, তা নিয়ে। শেষের দিকে তাঁর ক্রিকেট জীবনের সঙ্গে তুলনা টেনে আবেগপূর্ণ আবেদন রাখেন তিনি, ‘‘আমাদের গোটা দেশের কাছে এটা খুব কঠিন একটা সময়। সকলকে একজোট হয়ে লড়তে হবে। ঠিক যে ভাবে আমরা ক্রিকেট মাঠে টিম হিসেবে খেলে জিততাম। মনে রাখতে হবে যে, টিম স্পিরিটই আমাদের এই লড়াইয়ে জেতাবে।’’
সিন্ধুর মতো কেউ কেউ প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন জানান, ডাক্তার এবং নার্সদের সুরক্ষা বাড়ানোর জন্য। যে ভাবে দেশের কয়েকটি জায়গায় ডাক্তার, নার্সরা আক্রান্ত হয়েছেন, তার সমালোচনা করেন অনেকে। সচিনের মতো সিন্ধুও শারীরিক এবং মানসিক ফিটনেসের উপরে জোর দেন। তারকাদের মাধ্যমে করোনা নিয়ে সচেতনতা গড়ে তোলার বিষয়টি সব চেয়ে প্রাধান্য পায়। ক্রীড়াবিদেরা জানান, তাঁরা টুইটার বা ফেসবুকে ডাক্তারি পরামর্শ মতো হাত ধোয়ার ভিডিয়ো পোস্ট করছেন। সেগুলি বার বার করে যাবেন তাঁরা। সঙ্গে কী ভাবে শারীরিক এবং মানসিক সক্ষমতা গড়ে তোলা যায়, তার টোটকাও দিতে পারেন তাঁরা।