ফাইনালে শেষরক্ষা হল না লক্ষ্যের। ছবি: টুইটার ।
সেই বিয়াল্লিশ বছর আগে ১৯৮০ সালে প্রকাশ পাড়ুকোন চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন অল ইংল্যান্ড ব্যাডমিন্টন চ্যাম্পিয়নশিপে। তার ২১ বছর পরে ২০০১ সালে পুল্লেলা গোপীচন্দ শেষ বার এই প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল ভারত থেকে। তার ২১ বছর পরে লক্ষ্য সেন রবিবার ফাইনাল খেলল অল ইংল্যান্ডে। গত কয়েক মাসে ও যে রকম ছন্দে রয়েছে, তাতে আশা জেগেছিল আমার ছাত্র বোধহয়, ভারতীয় ব্যাডমিন্টনে ইতিহাস গড়ে ফেলতে পারে ২০ বছর বয়সে।
তাই অনেক আশা নিয়ে রবিবার অল ইংল্যান্ড ব্যাডমিন্টন চ্যাম্পিয়নশিপের পুরুষদের সিঙ্গলস দেখতে বসেছিলাম। শুধু আমি কেন, আমার ছাত্র লক্ষ্যের জন্য সচিন তেন্ডুলকর-সহ গোটা ভারতের অনেকেই এই প্রতিযোগিতায় চার বারের টানা চ্যাম্পিয়ন ভিক্টর অ্যাক্সেলসেনের বিরুদ্ধে লক্ষ্যের দ্বৈরথ দেখেছেন। ফাইনালে যদিও লক্ষ্যের ১০-২১, ১৫-২১ ফলে হার দেখে শেষ পর্যন্ত মনটা খারাপ হলেও নিরাশ হইনি। প্রথম বার অল ইংল্যান্ডের ফাইনালে উঠে হারলেও এই অভিজ্ঞতাই আগামী দিনে লক্ষ্যকে এই প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হওয়ার রসদ বা শিক্ষা দিয়ে গেল।
লক্ষ্য আমার ছাত্র বলে এ কথা বলছি না। ও কিন্তু যে কাজটায় ব্যর্থ হয়, তাতে সফল না হয়ে সেটা শেষ করে না। ওকে দীর্ঘদিন প্রশিক্ষণ দেওয়ার ফলে এ কথাই বলতে পারি। এ প্রসঙ্গে আমার মনে পড়ছে, কয়েক বছর আগে থমাস কাপে বাছাই পর্বের ম্যাচের একটি অভিজ্ঞতা। সেখানে লক্ষ্য একটি ম্যাচ হেরে ভারতীয় দলে জায়গা পায়নি। দু’দিন বেশ মন খারাপ করেই অনুশীলন করছিল। ও তখন আরও ছোট। আমি লক্ষ্যকে ডেকে বললাম, ‘‘পরিশ্রমে গলদ ছিল। আর এ ভাবে চলতে থাকলে, কখনও জিতবি। কখনও হারবি। কখনও দলে ঢুকবি। কখনও দলের বাইরে চলে যাবি। সেরা খেলোয়াড় হতে হবে বুঝলি। সেই খেলোয়াড় হতে হবে, যাকে দলের বাইরে রাখা যাবে না।’’ কথাগুলো খুব মন দিয়ে শুনে, পর দিন থেকেই অ্যাকাডেমিতে অনুশীলনের সময় দেড় ঘণ্টা বাড়িয়ে দিয়েছিল লক্ষ্য। তাই এই হার ওকে আরও পোক্ত করে আগামী দিনে ট্রফি জেতার বাড়তি প্রেরণা দেবে বলেই আমার বিশ্বাস। ছেলেটা ছোট থেকেই খুব দৃঢ় মানসিকতার। মনে আছে, এক বার প্রকাশ (পাড়ুকোন) ওর কাছে জানতে চেয়েছিল, অ্যাকাডেমিতে এসে ওর খারাপ লাগে কি না। লক্ষ্য সঙ্গে সঙ্গেই বলেছিল ওর বাড়ির জন্য মন খারাপ করে। পর দিনই ওকে বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। যার ফলে জুনিয়র স্তরে বেশ কয়েকটি প্রতিযোগিতায় ওর খেলা হয়নি। দু’সপ্তাহ পরে এটা যখন বুঝতে পারল তখন ও সঙ্গে সঙ্গেই অ্যাকাডেমিতে ফিরে এল। পরে আর বাড়ি যেতে বললেও বাড়ি যেত না লক্ষ্য। ব্যাডমিন্টন খেলা ও জিততে ও এতটাই মরিয়া ছোট থেকে।
আনন্দবাজারের হয়ে এই প্রতিবেদন লেখার আগে ফোনে লক্ষ্যের সঙ্গেই কথা বললাম। ওকে তখন বললাম, পিছনের দিকে চলে গেলে শক্তি বাড়িয়ে কী ভাবে বিপক্ষকে প্রত্যাঘাত করতে হবে, এটায় এ বার তোকে জোর দিতে হবে। শক্তি বাড়াতে হবে। আগামী কয়েক মাসে এই ট্রেনিংয়েই জোর দিতে হবে। ঠিক চেনা সুরে লক্ষ্য বলল, এ বার এটা করতেই হবে স্যর। এ দিন ডেনমার্কের ভিক্টর অ্যাক্সেলসেন ঠিক এই জায়গাতেই লক্ষ্যকে কোণঠাসা করে ম্যাচটা স্ট্রেট সেটে জিতে বেরিয়ে গেল। গত সপ্তাহেই জার্মান ওপেনের সেমিফাইনালে ভিক্টরকে হারিয়ে ফাইনালে উঠেছিল লক্ষ্য। ওর শক্তি হল নেটের সামনে। সে দিন এই রণনীতি নিয়েই ও হারিয়ে দিয়েছিল ভিক্টরকে। যা ও মাথায় রেখে এ দিন প্রথম গেমের প্রথম সার্ভিস থেকেই লক্ষ্যকে পিছনের পায়ে ঠেলে দেয়। গতি ও দুর্দান্ত কিছু শট মেরে লক্ষ্যকে প্রথম গেমে বার বার নেট থেকে দূরে নিয়ে যাচ্ছিল ভিক্টর। তার পরে জোরালো স্ম্যাশে পয়েন্ট নিয়ে গিয়েছে। প্রথম গেমটা এ ভাবেই হেরেছে লক্ষ্য।
দ্বিতীয় গেমে ভিক্টরের রণনীতি বোঝার পরে লক্ষ্য যখন পাল্টা নেটের কাছে এসে খেলে ৪-৪ করে ফেলল, তখন ভিক্টর ওকে র্যালিতে ব্যস্ত রেখে কোর্টের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত ছুটিয়ে ম্যাচের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে। অনেকে বলতে পারেন, পর পর খেলায় ক্লান্তির কারণে ভিক্টরের বিরুদ্ধে লক্ষ্য দাঁড়াতে পারেনি। আমি সেই দলে পড়ছি না। ক্লান্তি থাকলে তা দু’জনের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। লম্বা র্যালির পরে দ্বিতীয় গেমে যখন লক্ষ্য ১২-১৮ করছে, তখন ভিক্টরকেও ক্লান্ত লেগেছে আমার। কাজেই ক্লান্তি নয়, বিপক্ষের দুর্বলতা খুঁজে সেই জায়গাতে আঘাত করেই খেতাব নিয়ে গিয়েছে অ্যাক্সেলসেন।
রবিবার রাতেই কথা বলার সময়ে লক্ষ্য সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে মঙ্গলবার থেকে শুরু হওয়া সুইস ওপেনে ও খেলবে। আশা করি, সেখান থেকেই এই নেট থেকে দূরে চলে গেলে কী ভাবে শক্তি বাড়িয়ে প্রত্যাঘাত করতে হবে, তা শেখা ও প্রয়োগের কাজটা শুরু করে দেবে আমার ছাত্র। গত সপ্তাহে জার্মান ওপেনে রানার্স হয়েছে। তার আগে ইন্ডিয়া ওপেনে ট্রফি জিতেছে। গত ডিসেম্বরে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে ব্রোঞ্জ পদক জয়ও রয়েছে। সুতরাং আস্থা রাখুন। এই লক্ষ্যই ভারতীয় ব্যাডমিন্টননে নতুন রূপকথা লিখবে কয়েক বছরের মধ্যেই।