ইশান্তকে গতিতে জোর দেওয়ার মন্ত্র দিয়েছিলেন কোচ শ্রবণ কুমার।
ইডেনে গোলাপি বলের টেস্টে প্রথম বলটা তিনিই করেছিলেন। দেশের ইতিহাসে, দিন-রাতের টেস্টে প্রথম পাঁচ উইকেটও তাঁর। এবং শেষ পর্যন্ত ঐতিহাসিক এই টেস্টে নয় উইকেট নিয়ে নায়কও তিনি। হয়েছেন সিরিজেরও সেরা। তিন ভারতীয় পেসারই দুরন্ত ছন্দে ছিলেন ইডেনে, শামির বলে ম্যাচের বাইরে ছিটকে গিয়েছেন দুই বাংলাদেশি, উমেশও ৫ উইকেট নেন দ্বিতীয় ইনিংসে, কিন্তু ইশান্ত শর্মার সামনেই সবচেয়ে বেশি অসহায় লেগেছে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের।
ভারতীয় ক্রিকেটের পক্ষে ইশান্তের এই প্রত্যাবর্তন সত্যিই সুখবর। দেশের মাটিতে এক ইনিংসে পাঁচ উইকেট পেলেন ১২ বছর পর। তবে সেরা ফর্মের ইশান্ত কী করতে পারেন, তা এক দশক আগে অস্ট্রেলিয়ায় টের পেয়েছিলেন রিকি পন্টিং। ইংল্যান্ডেও কয়েক বছর আগে বিধ্বংসী মেজাজে দেখা গিয়েছিল তাঁকে। কিন্তু ধারাবাহিকতা ছিল না। কখনও ভাল, কখনও সাদামাটা, কেরিয়ার গ্রাফ উঁচু-নিচুই দেখিয়েছে আগাগোড়া।
ইডেন টেস্টে মারাত্মক সুইংয়ের প্রদর্শনী মেলে ধরার পরও, তাই দিল্লির পেসারকে নিয়ে আশঙ্কা থেকে যাচ্ছে। আর এখানেই আশ্বস্ত করছেন তাঁর দীর্ঘদিনের কোচ শ্রবণ কুমার। সোমবার দুপুরে নয়াদিল্লি থেকে আনন্দবাজার ডিজিটালকে বললেন, “যে ছন্দে দেখলাম, তাতে আরও অন্তত বছর চার নিশ্চিন্ত থাকা যায়। যদি ফিটনেস ঠিক থাকে, তবে ও সেরা ফর্মেই খেলবে।” কিন্তু এতটা ভরসা আসছে কী ভাবে? কোচের কথায়, “এখন ক্রিকেটাররা খুব সচেতন। খেলাটার সঙ্গে প্রচুর অর্থ জড়িত। কেউ চায় না তা হারিয়ে ফেলতে। সেই তাগিদ থেকেই পরিশ্রম করে। এই তো গত বছর আইপিএলের নিলামে দল পায়নি ও। হতাশায় প্রায় ভেঙে গিয়েছিল। মানসিক ভাবে ধাক্কা খেয়েছিল খুব। দলের প্রধান বোলার হয়েও আনসোল্ড থাকার ব্যাপারটা মেনে নিতে পারেনি একেবারেই। তখন কাউন্টি ক্রিকেট খেলতে চলে গিয়েছিল। আর সেখানে কোচ হিসেবে পেয়েছিল জেসন গিলেসপিকে। সেটাই পাল্টে দেয় ওকে। এখন একেবারে অন্য বোলার দেখাচ্ছে।”
আরও পড়ুন: আড়াই দিনেই শেষ ইডেন টেস্ট, শেষ দু’দিনের টিকিটের টাকা ফেরত দিচ্ছে সিএবি
আরও পড়ুন: বোর্ড প্রেসিডেন্ট বলে সৌরভের সম্পর্কে ভাল কথা বলছে বিরাট, তীব্র কটাক্ষ গাওস্করের
২০১৮ সালের আইপিএল নিলামে দল পাননি ইশান্ত। সেই সময় তাই চলে গিয়েছিলেন সাসেক্সের হয়ে কাউন্টি খেলতে। সেখানেই গিলেসপির তত্ত্বাবধানে লাইন-লেংথ নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা খেটেছিলেন তিনি। গিলেসপি বলেছিলেন অফস্টাম্পের মাথা লক্ষ্য করে বল করতে। স্টাম্পে বল রাখার পাঠ নেন ইশান্ত। বল ছাড়ার সময় কব্জির অবস্থান নিয়েও ঘাম ঝরান তিনি। ক্রিজের বিভিন্ন কোণের ব্যবহারেও জোর দেওয়া হয়েছিল।
আর সেটাই বাইশ গজে ইশান্তকে এখন এত বিধ্বংসী করে তুলেছে বলে মনে করছেন শ্রবণ কুমার। তাঁর কথায়, “গিলেসপির সঙ্গে নেটে সময় কাটানোর পর বোলিংয়ে অনেক পরিবর্তন এসেছিল। নিশানা বেড়ে গিয়েছিল। আগের চেয়ে এখন অনেক বেশি ব্যাটসম্যানকে খেলায়। তার ফলে উইকেটও আসছে। লাইফে কখনও কখনও এমন চেঞ্জ আসে। যা পাল্টে দেয় কেরিয়ার। বিরাট কোহালি যেমন খুব ভাল ব্যাটসম্যান হয়েও এক সময় কেয়ারলেস টাইপের ছিল। আর এখন ওই বিশ্বের এক নম্বর ব্যাটসম্যান। ইশান্ত কিন্তু বোলিং অ্যাকশন বা রানআপ বদলায়নি। পাল্টে গিয়েছে শুধু ওর ভাবনা। এখন ও মারাত্মক পজিটিভ। এই মানসিক পরিবর্তনই আত্মবিশ্বাসী করে তুলেছে। ব্যাটসম্যানকে অনেক বেশি খেলাচ্ছে। এলোমেলো বল করছে না। এই দেখুন না ইডেনে প্রথম ইনিংসে ২২ রানে পাঁচ উইকেট নিয়েছে। যা ভাবাই যায় না!”
ইশান্তকে এই মেজাজেই দেখতে চাইছেন ক্রিকেটপ্রেমীরা। ছবি: এপি।
২০০৭ সালে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক হয়েছিল ইশান্তের। বিরাট কোহালি, রোহিত শর্মাদেরও আগে পা রেখেছিলেন এই সার্কিটে। কিন্তু কখনও নিজের জায়গা পাকা করতে পারেননি। আসা-যাওয়া করেছেন। এক সময় সীমিত ওভারের ক্রিকেটে জাতীয় নির্বাচকদের ভাবনা থেকেও গিয়েছেন মুছে। এখন শুধু টেস্টের জন্যই বিবেচিত হন। কিন্তু, টেস্টেও জায়গা নিশ্চিত নয়। দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে একমাস আগেই রাঁচীতে সিরিজের তৃতীয় টেস্টে দুই পেসারের মধ্যেও জায়গা হয়নি ইশান্তের। কোচের ব্যাখ্যা, “দেখুন, জীবনে ওঠা-পড়া থাকবেই। কেউ সব সময় সেরা থাকতে পারে না। ব্যাটসম্যানরাও পর পর সেঞ্চুরি, ডাবল সেঞ্চুরি, ট্রিপল সেঞ্চুরি করতে পারে না। তবে হ্যাঁ, যে সম্ভাবনা ছিল তার পুরোটা মেলে ধরতে পারেনি ইশান্ত। আর এগারোয় থাকার ব্যাপারটা নির্ভর করে দলের কম্বিনেশনের উপর। কিন্তু ইডেন টেস্টে যা বল করল, তা দুর্দান্ত। হ্যাঁ, গোলাপি বল অনেক বেশি চকচকে, তার জন্য একটা সুবিধা পেয়েছে অবশ্যই। তবে ও যে দারুণ বল করেছে, তা নিয়েও সংশয় নেই।”
এখনও নিয়মিত কথা হয় ছাত্রের সঙ্গে। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে সিরিজের আগেও হয়েছিল। আর তাই শ্রবণ কুমারের চোখে ভাসে আইপিএল নিলামের পরের দিনগুলো। ফ্ল্যাশব্যাকে ফিরে গিয়ে তিনি বললেন, “আমি চেষ্টা করেছিলাম ওকে পজিটিভ জোনে নিয়ে আসতে। বলেছিলাম যে আইপিএল হল টাকার খেলা। আইপিএলের কোনও রেকর্ড রাখা হয় নাকি? পাঁচদিনের ফরম্যাটে মন দিতে বলেছিলাম। জেদ নিয়েই গিয়েছিল কাউন্টি খেলতে। আর সেখানে গিলেসপিকে পাওয়ায় উপকার হয়েছে।”
জাতীয় দলে পেসারদের মধ্যে লড়াইও ইশান্তকে উৎকর্ষের সন্ধানে যেতে বাধ্য করেছে বলে জানালেন তিনি। শ্রবণ কুমার বললেন, “মহম্মদ শামি, উমেশ যাদব রয়েছে। জশপ্রীত বুমরা, ভুবনেশ্বর কুমার চোট সারিয়ে ফিরবে। এটা স্বাস্থ্যকর। এদের মধ্যে কোনও ঈর্ষা নেই। প্রত্যেকেই একে অন্যের সাফল্য উপভোগ করে। ফলে, একে অন্যকে সাহায্যও করে। এতে সবাই উপকৃত হয়। প্রত্যেকেই জানে যে পারফরম্যান্স না করতে পারলে পরের জন তৈরি।”
আরও পড়ুন: ধারাভাষ্যের মাঝে হর্ষ ভোগলেকে অপমান! সোশ্যাল মিডিয়ায় তোপের মুখে মঞ্জরেকর
আরও পড়ুন: পাকিস্তানের ‘বিস্ময় পেসার’-এর বয়স কি কমছে? কাইফদের টুইটে অবশেষে উত্তর দিল পিসিবি
এগারো বছরেরও বেশি আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেললেও বলের গতি কমেনি ইশান্তের। যার নেপথ্যে একটা গল্প রয়েছে। শ্রবণ কুমার সেটাই শোনালেন, “মাঝখানে একবার গতি কমে গিয়েছিল ইশান্তের। তখন ভারতের বোলিং কোচ ছিল ভেঙ্কটেশ প্রসাদ। যে নিজে মিডিয়াম পেসে সুইং করাত। ইশান্তকে বলেছিল লাইন-লেংথে জোর দিতে। একজন জোরে-বোলার, যাঁর প্রধান অস্ত্র হল গতি, তাঁকে যদি লাইন-লেংথে জোর দিতে বলা হয়, তখন তার গতিটাই যায় নষ্ট হয়ে। ইশান্তেরও তাই হয়েছিল। আমি বললাম, আরে তোর গতিটাই যদি হারিয়ে যায় তা হলে সুইং করানোর বোলার প্রত্যেক গলিতেই মিলবে। বয়স কমলেও আমি এখনও ইনসুইং-আউটসুইং করাতে পারি। তোর অস্ত্র হচ্ছে গতি। সেটাকে নষ্ট করিস না। আমাদের ইরফান পাঠানকে দেখুন, ও গতি বাড়াতে গিয়ে সুইং নষ্ট করে ফেলল। ইশান্তকে সেটাই বোঝালাম যে সহজাত জিনিসটার ক্ষতি করা যাবে না। ও সঙ্গে সঙ্গে বুঝে গেল। ব্যাস, কেরিয়ার জুড়ে আর গতি কমেনি।”
ছাত্রের দ্রুত শেখার ক্ষমতা এখনও মুগ্ধ করে তাঁকে। ভাল লাগে ছাত্রের ফিটনেস। আশিস নেহরার মতো অবস্থা যাতে না হয়, সে জন্য সতর্কও করে দিয়েছেন বার বার। বললেন, “শুরুর দিকে রোগা-পাতলা ছিল। অনেকে নানা কথা বলেছিল। কিন্তু আমি বলেছিলাম যে একটু সময় দিতে। চেহারা ঠিক শক্তপোক্ত হবে। তাই হয়েওছে। এখন দেখুন, টানটান চেহারা। চিতাবাঘের মতো চেহারা।” ভারতীয় পেসারদের জিমে যাওয়ার দরকার নেই, এই মতবাদও জোরালো।
গতি আর ফিটনেস। নিশানায় অভ্রান্ত থাকা। এবং অবশ্যই ইতিবাচক মানসিকতা। ইশান্তের বদলে যাওয়ার রেসিপি তা হলে এগুলোই।