ধোনির ধূর্ত চালে ভারতীয় টিমে এখন ‘রঙ্গ বরসে’

টিম বাসে আবির নিয়ে হুড়োহুড়ি ফেলে দিয়েছেন ‘দুই সিংহ’। হাতে আবির, দিনটা হোলির, হরভজন-যুবরাজকে আর থামায় কে? ‘রঙ্গ বরসে ভিগে চুনরওয়ালি’ গানটা গাইছে কারা? না, মোটেও অমিতাভ বচ্চন নন। গান এক, গলা হুবহু, কিন্তু গায়ক বিগ বি নন। ওঁরা তিন। সুরেশ রায়না। হার্দিক পাণ্ড্য। শিখর ধবন।

Advertisement

রাজর্ষি গঙ্গোপাধ্যায়

বেঙ্গালুরু শেষ আপডেট: ২৫ মার্চ ২০১৬ ০৪:০৩
Share:

বাংলাদেশকে হারিয়ে ফুরফুরে টিম ইন্ডিয়া।

টিম বাসে আবির নিয়ে হুড়োহুড়ি ফেলে দিয়েছেন ‘দুই সিংহ’। হাতে আবির, দিনটা হোলির, হরভজন-যুবরাজকে আর থামায় কে?

Advertisement

‘রঙ্গ বরসে ভিগে চুনরওয়ালি’ গানটা গাইছে কারা? না, মোটেও অমিতাভ বচ্চন নন। গান এক, গলা হুবহু, কিন্তু গায়ক বিগ বি নন। ওঁরা তিন। সুরেশ রায়না। হার্দিক পাণ্ড্য। শিখর ধবন।

‘হোলি কঁহা মনায়া? খেললেন কোথায় হোলি?’ চণ্ডীগড় এয়ারপোর্টে এক সাংবাদিকের প্রশ্ন শুনে হেসে ফেললেন এমএস ধোনি। আকাশের দিকে আঙুল উঁচিয়ে বলে দিলেন, ‘‘আসমান মে!’’

Advertisement

ইতিহাসের পরের সকাল। টুকরো কয়েকটা ছবি। যা টিম ইন্ডিয়ার বেঙ্গালুরু রাত-উত্তর সময় ব্যাখ্যা করে দেবে। যেখানে উৎসব আছে। টিম বাসে সবুজ আবিরে একে অন্যকে রাঙিয়ে দেওয়া আছে। বেঙ্গালুরু রাতের স্মরণীয় জয়ে মোহাচ্ছন্ন হয়ে থাকা আছে। সিরিয়াসনেসের ছিঁটেফোঁটা নেই।

ভুল। ওটাও আছে।

এ দিন কর্নাটক থেকে পঞ্জাব পৌঁছে গেল টিম ইন্ডিয়া। নয়াদিল্লি ঘুরে। মোহালিতে ২৭ মার্চ অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে গ্রুপের শেষ ম্যাচ শুধু নয়। পরিস্থিতি বিচারে তা মহাগুরুত্বপূর্ণ। স্টিভ স্মিথের টিমই ঠিক করে দেবে ধোনির ভারত বিশ্বকাপে থাকবে কি না। শোনা গেল টিম বাসে আবির নিয়ে রায়নাদের হুল্লোড় চলেছে। হার্দিক বিগ বি-র গলা নকল করে ‘রঙ্গ বরসে’ গেয়ে জমিয়ে দিয়েছেন। চণ্ডীগড়ে নেমে ভারত অধিনায়ক সাংবাদিকের সঙ্গে রসিকতা করেছেন— এ সব যেমন সত্যি, ঠিক তেমনই বেঙ্গালুরু থেকে নয়াদিল্লিগামী ফ্লাইটে সিরিয়াস মুখচোখ করে বসে থাকা মহেন্দ্র সিংহ ধোনিও সমান সত্যি। প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ অনুযায়ী, ফ্লাইটে উঠে রোহিত যখন কানে হেডফোন গুঁজে দিলেন, রায়নাকে যখন পছন্দের সিনেমা ডাউনলোড করতে দেখা গিয়েছে, তখন এমএস ধোনি কি না রিক্লাইনার সিটে আধশোয়া হওয়ার কথাও ভাবেননি!

ভারত অধিনায়কের মাথায় কী চলছিল, চিন্তার বিষয়বস্তু অনুন্নত রান রেট কি না, জানা যায়নি। কিন্তু টিম যে গত রাতে কতটা ‘প্রেশার কুকার’ পরিস্থিতিতে পড়ে গিয়েছিল, জানা গিয়েছে। সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে রায়না-ধবনদের স্বস্তির বহিঃপ্রকাশই তো তা বলে দেবে। বুধবার গভীর রাতে টিম বাসে বসে থাকা কোহালি-যুবরাজদের যে মুখচ্ছবি ধরা পড়ছিল, দেখে মনে হয়নি তখনও তাঁরা স্বপ্নের ঘোর থেকে বেরোতে পেরেছেন বলে। চিন্নাস্বামী দর্শক শুধু মাঠে উৎসব করেনি, টিম বাস বেরনো পর্যন্ত মহাত্মা গাঁধী রোডের দু’পাশে কর্ডন করে দাঁড়িয়েছিল। বাস বেরনোর সময় তীব্র জয়ধ্বনিতেও ব্যাপারটা শেষ হয়নি, শ’য়ে-শ’য়ে লোক রীতিমতো ধাওয়া করেছে টিম বাসকে! সিটে উপবিষ্ট রবি শাস্ত্রী-কোহালিরা তখনও বিহ্বল চোখে চতুর্দিকে তাকিয়ে। টিম ইন্ডিয়ার স্নায়ু বরং কাজ করতে শুরু করল মধ্যরাতের পর থেকে। যখন একটার পর একটা আবেগঘন টুইট ছড়িয়ে পড়তে লাগল।

সবিস্তার দেখতে ক্লিক করুন।

সুরেশ রায়না লিখে ফেললেন, ‘শেষ পর্যন্ত হাল ছাড়তে নেই। না জেতা পর্যন্ত উৎসব করতে নেই। কী ম্যাচ!’’ আগাম উৎসবের খোঁচাটা কার উদ্দেশ্যে, রায়না নাম না কারলেও বোঝা সহজ। তিনি মুশফিকুর রহিম— যিনি ম্যাচের শেষ ওভারে পরপর দু’টো বাউন্ডারি মেরে আগাম জয়োৎসব শুরু করেছিলেন। শিখর ধবনও আবেগাচ্ছন্ন, ‘ওহ্ মজা আ গয়া। আমার জীবনের অন্যতম সেরা অভিজ্ঞতা হয়ে থাকল।’ সাক্ষী ধোনিকেও একটা টুইট করতে দেখা গেল— শান্তিতে ঘুমোতে পারছি।

ভারতীয় ক্রিকেটের ফার্স্ট লেডির টুইট দিয়ে বুধবার ভারত-বাংলাদেশ মহাযুদ্ধের সারমর্ম ধরা যায়। ঘুমোনো দূরস্থান, চিন্নাস্বামীতে একটা সময় শান্তিতে বসাও যাচ্ছিল না। ম্যাচের শুরু থেকে শেষ, এতটা উত্তেজনা, দু’পক্ষের এতটা হানাহানিতে ঠাসা ছিল। ম্যাচে কখনও ভারত উঠেছে। কখনও পড়েছে। বাংলাদেশও তাই। কিন্তু যাবতীয় উত্থান-পতন বিস্মৃত করে দিয়েছে শেষ ওভার। ভাল করে বললে, শেষ বল। যেখানে ধোনির অসামান্য ক্ষিপ্রতা ছিটকে না বেরোলে কী হত কে জানে।

শেষ ওভারে ১১ চাই— এ অবস্থায় হার্দিককে আনেন ধোনি। প্রথম বলে সিঙ্গলস দেওয়ার পর আচমকাই পরের দুটো বলে মুশফিকুর রহিমের কাছে দুটো বাউন্ডারি খেয়ে যান হার্দিক। মুশফিকুরের ব্যঙ্গও সহ্য করতে হয়। বাংলাদেশের লক্ষ্য দ্রুত নেমে এসেছে ৩ বলে ২ রানে, টি-টোয়েন্টিতে যা সহজলভ্য। কিন্তু তার পরেও নাটক বাকি ছিল। এ বার পরপর দু’বলে বাউন্ডারি নয়, গেল দু’টো উইকেট। মুশফিকুর রহিম চালাতে গিয়ে আউট! মাহমুদউল্লাহ ফুলটসে রবীন্দ্র জাডেজার হাতে! ব্যাট হাতে প্রতিরোধ এ বার মুস্তাফিজুর রহমান, বাংলাদেশের চাই ১ বলে ২ এবং তখনই দেখা গেল বুধবারের পর ক্রিকেট-লোকগাথায় চলে যাওয়া ওই দৃশ্য।

ডান হাতের কিপিং গ্লাভস খুলে ফেলছেন এমএস ধোনি। যেন বুঝতে পারছেন শেষ বল মুস্তাফিজুর কানেক্ট করতে পারবেন না। মরিয়া হয়ে ছুটবেন ম্যাচটাকে সুপার ওভারে নিয়ে যেতে। আর তাঁকে, এমএস ধোনিকে তখন করে ফেলতে হবে কাজটা। সরাসরি থ্রোয়ে উড়িয়ে দিতে হবে স্টাম্প। গ্লাভস পরে করতে গেলে অসুবিধে, তাই আগেই হঠাও।

এবং ধোনি-কল্পিত স্ক্রিপ্ট মেনে প্রায় সবই হল! মুস্তাফিজ বলে ব্যাট ছোঁয়াতে পারলেন না, প্রাণপণ দৌড় দিলেন এক রান নিতে, আর ধোনি শুধু ডাইরেক্ট থ্রোয়ের বদলে পনেরো গজ ছুটে এসে উড়িয়ে দিলেন স্টাম্প। যা দেখার পর তাঁকে নিয়ে ধন্য ধন্য পড়ে গিয়েছে। প্রবল প্রশংসিত হচ্ছে তাঁর উপস্থিত বুদ্ধি ও বরফশীতল মস্তিষ্ক, যা মহাচাপের ম্যাচেও এক রানে জিতিয়ে দিয়েছে ভারতকে। অমিতাভ বচ্চন পর্যন্ত সামলাতে না পেরে টুইট করেছেন, ‘এমএস ধোনি তুমি বাংলাদেশের বিরুদ্ধে আজ অসাধারণ খেললে। একেবারে শেষ বল পর্যন্ত যে ভাবে স্ট্র্যাটেজি করে গেলে, মুখের কথা নয়।’ কিন্তু ধোনি, অবিচল। পরে বলে দিলেন, চাপের মধ্যে ওই সময় টিমের হট্টগোল ম্যানেজ করাই আসল ছিল। বললেন, ‘‘এ সময় নানা রকম অভিমত আসতে থাকে। হই-হট্টগোল ম্যানেজ করাই আসল।’’ কোথাও নিজে নেই। পুরোটাই পরিস্থিতি ম্যানেজমেন্ট।

এমএস ধোনিকে কে বোঝাবে, পরিস্থিতি, তার ম্যানেজমেন্ট, এ সব প্রসঙ্গ হয়তো পরে উঠতই না তাঁর সোনার হাতটা না থাকলে। কে বোঝাবে, তাঁর চিন্তা-তরঙ্গের ক্ষিপ্রতা না থাকলে ভারতীয় দলকে হয়তো স্বপ্নের বদলে স্বপ্নভঙ্গের রং মেখে ছাড়তে হত বেঙ্গালুরু, গোটা রিপোটর্টাও হয়তো লিখতে হত অন্য ভাবে!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement