বোধনের চব্বিশ ঘণ্টা আগে ক্লার্কের ফর্ম এল, উত্তেজনা এল কোথায়

বিশ্বের প্রাচীনতম ক্রিকেট মাঠকে নবীনতম করে তোলার এমন প্রাণপণ হ্যাঁচকাহেঁচকি হয়েছে যে প্রত্যক্ষদর্শীর মনে হবে, রঙের মিস্ত্রি আর ঠিকাদার এমসিজি-র ভেতর না ঢোকালেই কি চলছিল না! সেই ১৮৭৭ সাল থেকে এমসিজি-র আসল সৌন্দর্য তার বিশালত্বে। তার রঙহীন মেজাজে। যেন মহাকাল ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট ছবির মেজাজে গোটা স্টেডিয়ামকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে।

Advertisement

গৌতম ভট্টাচার্য

মেলবোর্ন শেষ আপডেট: ১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০৩:৫৮
Share:

বিশ্বের প্রাচীনতম ক্রিকেট মাঠকে নবীনতম করে তোলার এমন প্রাণপণ হ্যাঁচকাহেঁচকি হয়েছে যে প্রত্যক্ষদর্শীর মনে হবে, রঙের মিস্ত্রি আর ঠিকাদার এমসিজি-র ভেতর না ঢোকালেই কি চলছিল না!

Advertisement

সেই ১৮৭৭ সাল থেকে এমসিজি-র আসল সৌন্দর্য তার বিশালত্বে। তার রঙহীন মেজাজে। যেন মহাকাল ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট ছবির মেজাজে গোটা স্টেডিয়ামকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। যে, এই মাঠ আর বাকিরা কখনও এক হবে না। এক দাঁড়িতে গিয়ে কিছুতেই মিলবে না।

অথচ এ বারের বিশ্বকাপের জন্য যে এমসিজি তৈরি হয়েছে তা আকারে অন্য মাঠের তুলনায় বড়, এই যা। বহিরঙ্গে আর কোনও পার্থক্য নেই। যে মাঠের বৈশিষ্ট্য ছিল আশি গজ দূরবর্তী বাউন্ডারি। যেখানে ব্যাটসম্যান ছুটে চার রানও করে ফেলত, সেখানে আপাতত দড়ি দশ মিটার এগোনো। বাউন্ডারি ছোট করার উদ্দেশে। যেমন আইপিএলে হয়! এমসিজির মাচো মেজাজটাই তো এখানে মরে গেল।

Advertisement

মাঠের মধ্যে রং করার দায়িত্বটাও নিশ্চয়ই বড় কোনও ইন্টিরিয়র ডেকরেটরকে দেওয়া হয়নি। কারণ, সে যথেচ্ছ রং মেরেছে। কমলা, নীল, হলুদ, সবুজ, লাল জাবড়া জাবড়া করে। বিশাল ভিডিও স্ক্রিন-সহ স্টেডিয়ামটা এখনও বিশাল। কিন্তু ২৯ মার্চ ফাইনালের দিনও সাবেকি মেজাজটা ফিরলে হয়!

বুধবার সকালে মেলবোর্ন নামা ইস্তক ধারণা ছিল, অ্যাডিলেডের যে বিজ্ঞাপনী ব্যয়সংকোচ দেখেছি তাকে ঢেকে দেবে শেন ওয়ার্নের শহর। আফটার অল কাল বিশ্বকাপের বোধন। শনিবার ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়া ম্যাচ দিয়ে এই মহাদেশে বিশ্বকাপ উদ্বোধন। ফাইনালটাও তো আবার এই শহরে।

অথচ এখানেও এক ছবি! রাস্তায় কোনও বিলবোর্ড নেই। স্টেডিয়াম পৌঁছবার দেড় মিনিট আগেও কোনও ব্যানার নেই। বাংলা কথায় কোনও স্পন্দন নেই। স্থানীয় কারও কারও মুখে শুনলাম, অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট স্পন্দন এখন বিপরীত দুটো মেরুতে পরিষ্কার বিভাজিত— যার কোনওটাতেই ওয়ান ডে ক্রিকেটের নিবাস নয়।

টেস্ট ক্রিকেট আর বিগ ব্যাশ লিগ।

পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, টি-টোয়েন্টি এসে অনেকটা খেয়ে ফেলেছে ওয়ান ডে-র বাজার। বুধবার অস্ট্রেলিয়ার জাতীয় দৈনিকের স্পোর্টস পেজ যা লিখেছে, হতভম্ব করার মতো। বলেছে যে, স্মরণকালের মধ্যে সেরা টুর্নামেন্ট আয়োজনের পুরস্কার দেওয়া হল ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়াকে। ২০২০-র টি-টোয়েন্টি ওয়ার্ল্ড কাপ। আইসিসি দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর অস্ট্রেলিয়াকে একটা ভাল টুর্নামেন্ট শেষমেশ তা হলে দিল। পড়ে যে কারও মনে হবে, বলছে কী! ওয়ান ডে বিশ্বকাপ বোধনের চব্বিশ ঘণ্টা আগে কিনা উচ্ছ্বাস দেখাচ্ছে কবে দু’হাজার কুড়িতে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ হবে!

ফুটবলও এই কয়েক বছরে এখানে পর্যাপ্ত জনপ্রিয়তা পেয়েছে। অস্ট্রেলিয়া যবে থেকে নিয়মিত বিশ্বকাপ খেলছে, তখন থেকে ফুটবল মাঠে ভিড় বাড়ছে। সন্দেহ নেই এ দেশে ওয়ান ডে নিয়ে পুরনো উন্মাদনা ফুটবলও কেটেছে।

অস্ট্রেলিয়ানরা বরাবরই ওয়ান ডে ক্রিকেট ঘিরে চিত্তাকর্ষক থিম নির্বাচনে বিশ্বাসী। যাতে বিপণন আরও জমকালো হয়। প্যাকারের সময় আবির্ভূত সাদা বল, কালো পর্দা, ভিডিও স্ক্রিনের পাশাপাশি ছিল উদ্দীপক সেই জিঙ্গল— কাম অন অজি কাম অন! বিরানব্বই বিশ্বকাপের সময় জিঙ্গলটা বদলে দাঁড়ায় রুল দ্য ওয়ার্ল্ড, পৃথিবী শাসন করো! এ বার আইসিসি বেছেছে তেমনই একটা লাইন। গ্রেটনেস ইজ কন্টেজিয়াস। গ্রেটনেস ছোঁয়াচে বস্তু।

তা বুধবার বিশ্বের প্রাচীনতম ক্রিকেটনগরীতে সামান্য পরিভ্রমণের পর মনে হল মার্কেটিংয়ের সর্বগ্রাসী অভাবটাও ছোঁয়াচে। সিডনি থেকে কুরিয়ার ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত বাঙালি পেশাদার বললেন, মনেই হচ্ছে না এ দেশে বিশ্বকাপ হচ্ছে।

নইলে চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে এমসিজি থেকে এক কিলোমিটারের মধ্যে সিডনি মায়ার মিউজিক বোল মাইলস নামক একটা জায়গায় কাপের বোধন। অথচ কেউ বলতেই পারছে না, প্রোগ্রামটায় কী হবে? বিশেষ আকর্ষণ কারা? বিশ্বকাপ ফুটবল যেমন শাকিরা কী জেনিফার লোপেজকে হাজির করে গ্ল্যামারের রামধনু ছড়িয়ে দেয়, তেমন মেলবোর্নে কোনও বড় নাম কি রক কনসার্টের এই ভেন্যুতে হাজির থাকবেন? প্রোগ্রামটায় ছাই আর হবেটা কী?

কেউ জানে না। অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট টিম সূত্রে জানা গেল তাদের গোটা টিম আর ইংল্যান্ডকে উপস্থিত থাকতে বলা হয়েছে। ধোনি-সহ অন্য দেশের অধিনায়করাও নাকি থাকবেন। শ্রীলঙ্কা বা নিউজিল্যান্ড ক্যাপ্টেন থাকা সম্ভব নয়। তাঁরা তো ক্রাইস্টচার্চের উদ্বোধনীতে যোগ দেবেন। বিশ্বকাপের মতো একটা এত বড় মাপের টুর্নামেন্টের আন্তর্জাতিক উদ্বোধন হচ্ছে কিনা ভেঙে ভেঙে দুটো দেশে। কস্মিনকালে এমন আজব কিছু ঘটেছে?

আইসিসি-র লোকেরা অবশ্য মচকাবেন তবু ভাঙবেন না। তাঁরা ক্রমাগত বলে যাচ্ছেন পাবলিসিটি বাড়তি করে কী হবে? রেকর্ডসংখ্যক টিকিট তো অলরেডি বিক্রি হয়েই গেছে। মেলবোর্নে অস্ট্রেলিয়া-ইংল্যান্ড আর অ্যাডিলেডে ভারত-পাক পুরো টিকিট শেষ। কর্তারা বলছেন, ওই দুটো ম্যাচের বল গড়ানোই টুর্নামেন্টের এমন আপন গতি তৈরি করে দেবে যে, আলাদা প্রোমোশনের আর দরকার নেই। সেই মোমেন্টামটাই টেনে নিয়ে যাবে ২৯ মার্চ পর্যন্ত।

তাঁরা যাই বলুন, বিশ্বকাপের এমন স্বল্প প্রচার নিয়ে সমালোচনা বাড়ছে। কাপ নিয়ে সংগঠকদের প্রচারে অনাগ্রহ যেমন অকল্পনীয় তেমনই অকল্পনীয় এত দ্রুততার সঙ্গে হ্যামস্ট্রিংয়ের চোট সারিয়ে অস্ট্রেলীয় অধিনায়ক যে মাঠে নেমে পড়লেন। তিনি মাইকেল ক্লার্ক ওপেন করলেন আমিরশাহির বিরুদ্ধে প্র্যাকটিস ম্যাচে। মাঠ জনশূন্য অথচ প্রেসবক্স ভর্তি। মিডিয়া আসলে প্রবল অবিশ্বাসের সঙ্গে প্রত্যাবর্তনকারী অজি অধিনায়ককে দেখতে চলে এসেছিল। অস্ট্রেলিয়ান নির্বাচকেরাও কেউ কেউ ছিলেন যে ক্লার্ক টুর্নামেন্টে কবে নামতে পারবেন, আদৌ প্রথম ম্যাচ খেলতে পারবেন কি না পরখের জন্য!

এত সব অবিশ্বাসী চোখজোড়ার সামনে দু’মাস বাদে ফেরত আসা ক্লার্ক করলেন ৬৪। দু’ওভার বলও করলেন। বিশ্বকাপ দেশের মাঠে খেলতে তিনি কতটা মরিয়া আজ আরও আন্দাজ পাওয়া গেল। ক্লার্কের ফেরত আসা অস্ট্রেলিয়াকে শক্তি দেওয়ার সঙ্গে অবশ্যই টুর্নামেন্টের ঝিকিমিকি বাড়াবে!

দিনের শেষে আসলে ক্রিকেটে লোক টানে তারকারা আর সেটা বিক্রির সহজ দায়িত্বে থাকে বেচুবাবুরা। সেটা জানে বলেই কি ধূর্ত আইসিসি বিপণনে এমন হাত গুটিয়ে বসে রয়েছে?

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement