জেতালেন এক ক্রিস, মাতালেন আর এক ক্রিস, ইডেনে হারল কেকেআর

এ মাঠ-ও মাঠ, এ শহর-সে শহর ঘুরে ঘুরে তিনি এখন ছক্কা মেরে বেড়াবেন। আত্মজীবনীর শিরোনাম ছক্কার মেশিনের মতো।

Advertisement

সুমিত ঘোষ

শেষ আপডেট: ২২ এপ্রিল ২০১৮ ০৪:২০
Share:

সান্ত্বনা: ম্যাচের পরে কেকেআর অধিনায়ক দীনেশ কার্তিকের সঙ্গে ক্রিস গেল। রবিবার। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক

আইপিএল আবার ক্রিস গেলের!

Advertisement

এ মাঠ-ও মাঠ, এ শহর-সে শহর ঘুরে ঘুরে তিনি এখন ছক্কা মেরে বেড়াবেন। আত্মজীবনীর শিরোনাম ছক্কার মেশিনের মতো।

কখনও মোহালিতে মারবেন এগারো ছয়, কখনও তাঁর ব্যাটের ঘায়ে গ্যালারিতে আছড়ে পড়বে হাফ ডজন ছক্কা। ইডেনে যেমন ৩৮ বলে করলেন ৬২। পাঁচটা চার, ছ’টা ছক্কা। বৃষ্টি থামার পরে কিংস ইলেভেনের দরকার ছিল ১৩ ওভারে ১২৫ রান। গেল এবং কে এল রাহুল (২৭ বলে ৬০) তার আগেই মেরে রানটা প্রায় তুলেই দিয়েছেন। বাকিটা সেরে ফেললেন ১১ বল বাকি থাকতে। বৃষ্টিতে খেলা বন্ধ হওয়ার সময় গেল ছিলেন ৪৯। ফিরে এসে প্রথম বলটাই উড়িয়ে দিলেন ক্লাব হাউসের সামনে।

Advertisement

তত ক্ষণে ইডেনে মাঠের কর্মীরা বৃষ্টির মধ্যে ভিজতে ভিজতে প্লাস্টিকের উপর খালি মাথায় দাঁড়িয়ে থেকে, যুদ্ধকালীন তৎপরতায় মাঠকে শুকিয়ে তুলেছেন। ম্যাচটা ফের শুরু হওয়ার জন্য তাঁদেরও পুরস্কার দেওয়া যেত। বাইশ গজে ছিলেন এক জন গেল, আর মাঠকে খেলার যোগ্য করে তোলার জন্য পর্দার আড়ালে ছিলেন আরও অনেক দুঃসাহসিক গেল। যাঁরা ঝড়-জল মাথায় করে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকলেন প্লাস্টিকের উপরে। যাতে প্লাস্টিক উড়ে মাঠ ভিজে না যায়। প্রেসবক্সের বাতানুকূল আরাম কেদারায় বসে তা দেখতে দেখতে চিমটি কেটে নিজেকে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করছিল, প্রবল বৃষ্টির মধ্যে ইডেনে যাঁরা দাঁড়িয়ে আছেন, তাঁরা মানুষ না মূর্তি? আর সেই প্রয়াসকে সম্মান জানাতেই যেন ইডেনের গ্যালারিতে থেকে গিয়েছিলেন বেশির ভাগ দর্শক। পিচের উপর থেকে কভার সরানো মাত্র মোবাইলের টর্চ জ্বালিয়ে তাঁরা উৎসব করা শুরু করে দিলেন।

দীনেশ কার্তিককে অন্ধকার থেকে বার করার জন্য টর্চ নিয়ে কেউ এগিয়ে আসেননি। একে গেল-ঝড়ই থামানো যায় না, তায় রাহুল দোসর। কালবৈশাখীর মতোই উড়ে গেল কেকেআর। তবে নতুন করে প্রশ্ন উঠে গেল ডাকওয়ার্থ-লুইস নিয়ম নিয়েও। বিশেষ করে টি-টোয়েন্টি ম্যাচে পরে ব্যাট করা দল এই নিয়মে অতিরিক্ত সুবিধা পেয়ে যাচ্ছে কি না, তা নিয়ে ময়নাতদন্ত করার সময় হয়েছে।

কেকেআর প্রথমে ব্যাট করে তুলেছিল ১৯১-৭। এমনিতে বেশ ভাল স্কোর। পুরো ম্যাচ হলে হয়তো তুল্যমূল্য লড়াই হতে পারে বলে মনে হবে। কিন্তু এটা তো সাধারণ ম্যাচ নয়, গেলের বিরুদ্ধে ম্যাচ। গেল আর রাহুল যে রকম ধ্বংসাত্মক শুরু করেছিলেন, তাতে মনে হচ্ছে ১৯১-ও কি জেতার জন্য যথেষ্ট হত? গেল ছক্কার চেয়ে চার কম মারেন, এমনই এক বিরল ব্যাটসম্যান! সিঙ্গলস নেন আরও কম। কী বললেন? গেলের ইনিংসে ছুটে নেওয়া দুই বা তিন রান? দিবাস্বপ্ন দেখছেন না তো? গেল অত সব দৌড়ের ব্যাপারে বিশ্বাসী হলে তো!

শনিবারের ইডেনে ম্যাচের পরে দেখা দু’টো ছবি তুলে ধরা যাক—

এক) দু’দিন ধরে নিলামে অবহেলিত হওয়ার পরে যিনি কিনলেন গেলকে অর্থাৎ কিংস ইলেভেন পঞ্জাবের মালকিন প্রীতি জিন্টা। ম্যাচ জেতার আনন্দে ফিল্মের নায়িকার মতো নেচে বেড়াচ্ছিলেন ‘জারা’। যদিও ‘বীর’ শাহরুখ খান না আসায় ইডেনে ‘বীরজারা শো’ হল না। তাতে কী, ‘গেল শো’ তো হল। প্রীতি আলিঙ্গনে আবদ্ধ করলেন গেলকে, নিজস্বীও তুললেন। গেলকে আবার হাত ধরে দেখিয়েও দিলেন, কী রকম ভঙ্গিতে দাঁড়াতে হবে।

দুই) প্রীতির আলিঙ্গন থেকে বেরিয়ে গেল দেখলেন তাঁর প্রথম আইপিএল দলের শীর্ষ কর্তা দাঁড়িয়ে। কেকেআরের চিফ এগজিকিউটিভ অফিসার (সিইও) বেঙ্কি মাইসোর জড়িয়ে ধরে অভিনন্দন জানালেন। প্রথম আলিঙ্গনটায় যদি থাকে স্বস্তির আনন্দ, দ্বিতীয়টাতে আফসোসের দীর্ঘশ্বাস। আহা, শুরুতে আমাদের হাতে থাকা ‘সিক্স মেশিন’-কে কেন যে নিলামে উপেক্ষা করলাম?

ধরে রাখা যায়, আইপিএলে এখন ‘গেল শো’ চলবে। মাঠের মধ্যে তিনি নিজের দলকে জিতিয়ে যাবেন, প্রতিপক্ষকে আতঙ্কিত করে রাখবেন, দর্শকদের বিনোদন দিয়ে যাবেন। আর মাঠের বাইরে হাসিমুখে ধরা দেবেন সকলের আলিঙ্গনে। জামাইকা দ্বীপপুঞ্জের আমোদপ্রিয় মেজাজের সার্থক মুখ তিনি। জীবনকে উপভোগ করো, মানুষকে আনন্দ দিয়ে যাও। ডুবন্ত ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটের সূর্য যে হাতে গোণা কয়েক জনের জন্য এখনও পুরোপুরি ডুব দেয়নি, ক্রিস গেল তাঁদের এক জন। অন্য জন, কেকেআরের আন্দ্রে রাসেল। এ দিন খুব বেশি কিছু করতে না পারলেও নাইটদের প্রধান ভরসা তিনিই।

আরও এক জন আছেন আইপিএল দুনিয়ার দূত হিসাবে। কেকেআরের ওপেনিং ব্যাটসম্যান ক্রিস লিন। ৪১ বলে ৭৪ করে যিনি এ দিন নাইটদের পৌঁছে দিয়েছিলেন দু’শোর কাছাকাছি। লিন অস্ট্রেলীয় সংস্কৃতিতে প্রথম ক্রিকেটার, যিনি ব্যাগি গ্রিনকে শিরোধার্য করেননি। বরং তিনি মনে করেন, অস্ট্রেলিয়ার পবিত্র টেস্ট ক্যাপের বাইরেও ক্রিকেটারের জীবন আছে। সেই জীবন হল গেলের আদর্শ মেনেই বিভিন্ন দেশে টি-টোয়েন্টি লিগ খেলে বেড়ানো। টি-টোয়েন্টির জন্য অস্ট্রেলিয়ার ঘরোয়া ক্রিকেট খেলার চুক্তিও ফিরিয়ে দিয়েছেন লিন। বিগ ব্যাশে ব্রিসবেন হিটের সব চেয়ে দামী এবং জনপ্রিয় ক্রিকেটার তিনি। আইপিএলে কেকেআর কিনেছে সাড়ে ন’কোটি টাকা দিয়ে। ব্যাগি গ্রিন নিয়ে অস্ট্রেলীয় আবেগ অনুপস্থিত হতে পারে। কিন্তু ক্রিকেটার হিসেবে পেশাদারিত্বের সঙ্গে আপস করেন না। নিজেকে টি-টোয়েন্টি লিগের জন্য তৈরি করবেন বলে লিন রেখেছেন ব্যক্তিগত কোচ। তাঁর পরামর্শে জিমে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পড়ে থেকে গায়ের জোর বাড়ান। ছক্কা মারতে হবে তো! ব্যক্তিগত কোচ তাঁকে নেট নিয়ে গিয়ে দেখাবেন, ছক্কা মারতে গেলে কী ভাবে মাথাটাকে অনড় রাখতে হয়। লিন সেটাও মন দিয়ে করতে থাকেন। সব টি-টোয়েন্টি লিগে খেলতে যাওয়ার আগে চলে তাঁর এই অনুশীলন পর্ব। তারই প্রতিফলন দেখা গেল যখন এ দিন তিনি সামনের পায়ে দাঁড়িয়ে পুল মারলেন। অবিশ্বাস্য শট!

ইডেনে বীর-জারা হয়তো হল না। গেল বনাম রাসেল হয়তো জমল না। কিন্তু ছিল দুই ক্রিসের দ্বৈরথ। ক্রিস গেল বনাম ক্রিস লিন। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের জন্য বিশেষ ভাবে খোদাই হওয়া দুই মুখ। এবং, তাঁদের হাত ধরে উড়তে থাকা নব্য ক্রিকেট সংস্কৃতি!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement