Football

বাবা অমর একাদশের একজন, মোহনবাগানের প্রথম লিগ জয়ী ক্যাপ্টেন আজ বিস্মৃত

আজ মোহনবাগান দিবস। দিনের শুরুটাই হয়েছে দারুণ ভাবে। নিউ ইয়র্কের বিখ্যাত টাইমস স্কোয়ারের বিলবোর্ডে শোভা পেয়েছে মোহনবাগান। অমর একাদশের ছবিও দেখানো হয়েছে সেখানে। কিন্তু ক’জন আর খবর রাখেন বিমল মুখোপাধ্যায়ের?

Advertisement

কৃশানু মজুমদার

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৯ জুলাই ২০২০ ১৭:০৬
Share:

ইতিহাস তৈরি করা সেই অমর একাদশ। —নিজস্ব চিত্র।

বাবা মনমোহন মুখোপাধ্যায় ছিলেন মোহনবাগানের প্রথম শিল্ড জয়ের অন্যতম নায়ক। বিপক্ষের পা থেকে বল কেড়ে নিতে দক্ষ ছিলেন তিনি। সারা মাঠ জুড়ে দাপিয়ে খেলতেন। রাইট হাফের খেলোয়াড় মনমোহনের ডাক নাম ছিল ‘টেরিয়ার’। এ হেন বাবার ছেলে বিমল আবার প্রথম লিগ জয়ী দলের ক্যাপ্টেন। ১৯৩৯ সালে মোহনবাগান প্রথম বার লিগ জেতে তাঁরই নেতৃত্বে। ক্লাবের ইতিহাসের প্রথম লিগ জয়ী অধিনায়কের কথা কি জানেন হোসে রামিরেজ ব্যারেটো-সনি নর্দেরা? তাঁরাও তো বাগানে এনে দিয়েছিলেন অনেক বসন্ত। প্রথম লিগ জয়ী অধিনায়ক তাঁদের কাছে অশ্রুতই।

Advertisement

আজ মোহনবাগান দিবস। দিনের শুরুটাই হয়েছে দারুণ ভাবে। নিউ ইয়র্কের বিখ্যাত টাইমস স্কোয়ারের বিলবোর্ডে শোভা পেয়েছে মোহনবাগান। অমর একাদশের ছবিও দেখানো হয়েছে সেখানে। কিন্তু ক’জন আর খবর রাখেন বিমল মুখোপাধ্যায়ের? ক’জনই বা চেনেন নজির সৃষ্টিকারী অধিনায়ককে?

বিমলবাবুর পুত্র নিখিলবাবু শান্ত গলায় বলছেন, ‘‘অনেক দিন আগের ঘটনা। অনেকের মনেও হয়তো নেই। তবে ভারতবর্ষের ফুটবলে এমন ঘটনা তো সত্যিই বিরল। বাবা পেলেন শিল্ড। তাও আবার বিদেশি দলকে হারিয়ে। আর ছেলে প্রথম লিগ জয়ী দলের ক্যাপ্টেন।’’ নিখিলবাবু নিজেও একসময়ে মোহনবাগানের জার্সি পরে খেলেছিলেন। কিন্তু কোমরের চোট তাঁর ফুটবল কেরিয়ার দীর্ঘায়িত করেনি। চিকিৎসকের পরামর্শে ফুটবলকে বিদায় জানাতে হয় তাড়াতাড়ি।

Advertisement

আরও পড়ুন: মোহনবাগান দিবসে টাইম স্কোয়ারের বিলবোর্ড ঢাকল সবুজ মেরুনে

শিল্ড জয়ের শতবর্ষে মরণোত্তর ‘মোহনবাগান রত্ন’ সম্মানে ভূষিত করা হয়েছিল মনমোহনবাবুকে। বিমলবাবু সে সব কিছুই পাননি। তিনি বিস্মৃতপ্রায়। শুধু মোহানবাগানই নয়, নিজের ভিটে হুগলির উত্তরপাড়া এলাকাও কি স্বীকৃতি দিয়েছে তাঁকে? নিখিলবাবুর ছেলে তথা মনমোহনবাবুর প্রপৌত্র অরিজিৎবাবু বলছেন, ‘‘আমার দাদু বিমল মুখোপাধ্যায় দুর্ভাগ্যজনক ভাবে কোনও সম্মানই পাননি। উত্তরপাড়ায় ফুটবল টুর্নামেন্ট হয়। কিন্তু আজ পর্যন্ত দাদুর নামে কোনও ট্রফি বা পুরস্কার দেওয়া হয়নি। এ সব দেখলে খুবই অবাক লাগে। কী কারণে তাঁকে কেউ মনে রাখেননি, তা আমার জানা নেই।’’

(বাঁ দিকে) বাবা মনমোহন মুখোপাধ্যায়। (ডান দিকে) বিমল মুখোপাধ্যায়। -নিজস্ব চিত্র

তবে মনমোহন মুখোপাধ্যায় মারা যাওয়ার বেশ কয়েক বছর পরে তৎকালীন মন্ত্রী যতীন চক্রবর্তীর উদ্যোগে উত্তরপাড়ার প্রাচীন মাঠে মনমোহনবাবুর মূর্তি বসানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সেই সময়ে মূর্তি বসানোর কাজ সম্পূর্ণ হয়নি। অনেক বছর পরে শিল্ড জয়ের একশো বছর উদযাপনের সময়ে বিধায়ক শ্রুতিরাজ প্রহরাজ ও উত্তরপাড়া স্পোর্টিং ক্লাবের উদ্যোগে মনমোহনবাবুর মর্মর মূর্তি বসে। অরিজিৎ বলছেন, “ওঁরা নিজেদের স্বীকৃতির ব্যাপারে উদাসীন ছিলেন। সেই সময়ে কেউই অর্থের বিনিময়ে খেলতেন না। মোহনবাগান ছিল ওঁদের কাছে মন্দির।”

সেই ‘মন্দিরে’ কী ভাবে এলেন বিমলবাবু? পিছনের গল্প বলছেন তাঁর ছেলে নিখিলবাবু, ‘‘১৯৩০ সালের ঘটনা বলছি। মোহনবাগান তাঁবুতে তখন বসে গোষ্ঠ পাল, উমাপতি কুমার এবং কয়েক জন কর্মকর্তা। ছিলেন আমার দাদু মনমোহন মুখোপাধ্যায়ও। বাবা স্বপ্নে দেখতেন মোহনবাগানের জার্সি পরে মাঠে ঘুরছেন, খেলছেন। মোহনবাগানে খেলার মনোবাঞ্চা নিয়েই তিনি চলে যান ক্লাবে। কর্তাদের জানান মোহনবাগানের হয়ে খেলার ইচ্ছার কথা। কিন্তু সেই প্রস্তাবে তাঁরা সাড়া দেননি। কর্তারা বলেন, পাওয়ার লিগ খেলে নিজেকে প্রমাণ করতে হবে। তা হলেই তিনি মোহনবাগানের খেলার সুযোগ পাবেন। বাবা সাফ না বলে চলে এলেন মোহনবাগান থেকে।’’

হতাশ বিমলের সঙ্গে এর পর এক পরিচিতর দেখা হয়ে যায়। তিনি আবার যুক্ত ছিলেন ইস্টবেঙ্গলের সঙ্গে। ময়দানে মোহনবাগানের পাশেই তখন ইস্টবেঙ্গল তাঁবু। সেই ভদ্রলোক বিমলবাবুকে বলেন, তিনি ইস্টবেঙ্গলে ব্যবস্থা করা দিতে পারেন। নিখিলবাবু বলছেন, ‘‘তত ক্ষণে মোহনবাগানে খবর চলে গিয়েছে, মনমোহন মুখোপাধ্যায়ের ছেলে সই করতে চলেছেন ইস্টবেঙ্গলে! ডেকে পাঠানো হয় বাবাকে। বাবা ক্লাবে ঢুকতেই এক কর্মকর্তা সপাটে চড় কষিয়ে দেন বাবাকে। বলেন, লিগের ম্যাচে নিজেকে প্রমাণ দিতে পারলে তবেই খেলতে পারবে মোহনবাগানের হয়ে। পুলিশের বিরুদ্ধে প্রথম ম্যাচেই বাবা সেন্টার ফরোয়ার্ড হিসেবে নেমে ২ গোল করেন। মোহনবাগানকে এনে দেন জয়। তার পরে বাবাকে আর ফিরে তাকাতে হয়নি।

আজ মোহনবাগান দিবস। বাড়িতে অমর একাদশের ছবির সামনে নিখিল মুখোপাধ্যায়।

১৯৩০ থেকে টানা ১০ বছর মোহনবাগানের রাইট হাফে সবুজ-মেরুন জার্সি পরে চুটিয়ে খেলেন।’’ ১৯৩৮ সালে ক্যাপ্টেন করা হয় বিমলবাবুকে। আর ১৯৩৯ সালে মোহনবাগানকে তিনি এনে দেন প্রথম লিগ। কিন্তু সেই সবুজ-মেরুন রংয়েই যে এসেছে বিবর্তন, এসেছে বিচ্যুতি। আগের সেই জার্সির রং ও ডিজাইনও নেই। নিখিলবাবু বলছেন, ‘‘এখন যে জার্সি রয়েছে তা ব্যক্তিগত ভাবে আমার পছন্দ নয়। যে জার্সি ছিল সেটার এক দিকে ছিল সবুজ আর এক দিকে মেরুন। পরে সেই রঙের বিবর্তন হয়। আমার মনে হয় সবুজ ও মেরুন রংয়ের গভীরতা কমে গিয়েছে। তবে শুনছি ১৯১১ সালের জার্সি ফেরানোর কথা হচ্ছে এটিকে-মোহনবাগানে। সেই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাই।’’

মুখোপাধ্যায় পরিবারের কাছে এখনও সযত্নে রয়েছে মনমোহন ও বিমলবাবুর ব্যবহৃত সবুজ-মেরুন জার্সি, ব্লেজার, নানা মেডেল, পুরস্কার, পুরনো ফটোগ্রাফ। এমনকি প্রায় একশো বছরের পুরনো মনমোহন মুখোপাধ্যায়ের সাধের বেহালাও রয়েছে সেই সংগ্রহের তালিকায়।

আরও পড়ুন: ‘কিক’ তত্ত্ব উড়িয়ে ‘দলের সম্পদ’ ঋষভকে আরও সুযোগ দিতে বলছেন কোচ

সেই সব অমূল্য জিনিস নিয়ে মুখোপাধ্যায় পরিবার করতে চায় মিউজিয়াম। কিন্তু ভাড়াটে সমস্যায় তাঁদের সেই ইচ্ছা এখনও বাস্তবায়িত হয়নি।

অরিজিৎবাবু বলছেন, ‘‘আমাদের কাছে অমূল্য সব জিনিস রয়েছে। মিউজিয়াম করার পরিকল্পনা করেছিলাম আমরা। যে বাড়িতে মিউজিয়াম করব বলে ঠিক করেছিলাম, সেটা দখল করে বসে রয়েছেন ভাড়াটে। বাড়ি তালা দিয়ে রেখেছেন তিনি। তার ফলে আমরা কিছুই করতে পারিছ না। মিউজিয়াম হলে মোহনবাগান সদস্য সমর্থকদের এই অমূল্য সম্পদগুলো দেখাতে পারতাম। আমার বাবার বয়স ৭৬। এই বয়সে আমার বাবার পক্ষে মামলা মোকদ্দমা করা সম্ভব নয়। আমরা চাই এই সমস্যার সমাধান হোক। তা হলে মিউজিয়ামটা করা সম্ভব হবে।’’

মিউজিয়াম তৈরির স্বপ্ন কি পূরণ হবে? সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজছে মুখোপাধ্যায় পরিবার।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement