কোহলির রূপান্তরিত ভারতের নেপথ্যের ভরত

রোববার দুপুরে যখন দিনে এক বলও খেলা হবে না মোটামুটি বোঝাই যাচ্ছে তখনও তিনি বোলারদের নিয়ে মাঠের ভেতর। প্রথমে একটা স্টাম্প লক্ষ্য করে বোলিং। তার পর হালকা ফুটবল দিয়ে নিজেদের মধ্যে পাসিং।

Advertisement

গৌতম ভট্টাচার্য

বেঙ্গালুরু শেষ আপডেট: ১৬ নভেম্বর ২০১৫ ০৩:৫৪
Share:

রোববার দুপুরে যখন দিনে এক বলও খেলা হবে না মোটামুটি বোঝাই যাচ্ছে তখনও তিনি বোলারদের নিয়ে মাঠের ভেতর। প্রথমে একটা স্টাম্প লক্ষ্য করে বোলিং। তার পর হালকা ফুটবল দিয়ে নিজেদের মধ্যে পাসিং। সেই ভিড়ে রবিচন্দ্রন অশ্বিন-সহ সব বোলার। এখানেই বোধহয় তাঁর ম্যান ম্যানেজমেন্ট দক্ষতা। নিয়মিত বোলারদেরও তিনি ভরা বৃষ্টির দিনে ড্রেসিংরুমের বাইরে আসার জন্য উদ্বুদ্ধ করতে পারেন।

Advertisement

পুরো নাম ভারতী অরুণ। সেখান থেকে যে-ই কাটছাঁট করে থাক, নামটা এখন দাঁড়িয়েছে ভরত অরুণ। ভারতীয় টিম ডিরেক্টরের মতে ইনি হালফিল ভারতীয় বোলিং রূপান্তরের সবচেয়ে বড় ব্যাখ্যা। ‘‘আপনারা কেউ এক বারও লেখেননি গত চারটে টেস্টে আমাদের বোলাররা যে ৪০ উইকেট তুলেছে। কালকেও বিপক্ষকে অল আউট করেছে। এই মানুষটা সেই সাফল্যের প্রধান লোক।’’ তাঁর বারো তলার ঘরে সামনের চেয়ারে বসা বোলিং কোচকে দেখান রবি শাস্ত্রী। অরুণ তখন মাথা নিচু করে লজ্জিত মুখে বসা।

ক্রিকেট কেরিয়ার একেবারেই ঝকঝকে নয়। জীবনের প্রথম টেস্ট ডেলিভারিটাই শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে করতে গিয়ে যখন বোলার্স রান আপে পড়ে যান, প্রেসবক্সে ফিসফাস শুরু হয়ে গেছিল, শুরু দেখেই শেষটা বোঝা যাচ্ছে। পূর্বাভাস অনুযায়ীই উপসংহার ঘটে। মাত্র দুটো টেস্ট আর চারটে ওয়ান ডে খেলে একই সঙ্গে বাতিল এবং বিস্মৃত হয়ে যান ভরত।

Advertisement

এর বেশ কয়েক বছর বাদে তাঁর পুনরাবির্ভাব কোচের বেশে। জাতীয় ক্রিকেট অ্যাকাডেমিতে তাঁকে শাস্ত্রী এনেছিলেন। এ ছাড়া তামিলনাড়ু আর বাংলার কোচিংও করেছেন। এগুলো ক্রিকেট কেরিয়ারের মতোই যাচ্ছিল। কিন্তু শাস্ত্রীর মনে হয়েছিল উল্টো। ক্রিকেটে ওর যে অনমনীয় জেদটা ছিল না সেটা কোচিংয়ে আছে। এ লম্বা রেসের ঘোড়া।

ডানকান ফ্লেচারের আনা বিদেশি বোলিং কোচ বরখাস্ত করে তাই টিম ডিরেক্টর হওয়ামাত্র শাস্ত্রী আনেন ভরতকে। তার পর এই পনেরো মাসে ভরত তো টিমের অপরিহার্য অস্ত্র হয়ে গিয়েছেন। ব্যাটিং কোচ সঞ্জয় বাঙ্গারকে নিয়ে নানা মহলে প্রশ্ন উঠেছে। সৌরভ-সচিনদের কলকাতা বৈঠকে এক বার নতুন ভারতীয় ব্যাটিং কোচ আনার সিদ্ধান্তই হয়ে গেছিল। কিন্তু বোলিং কোচ নিয়ে প্রশ্ন ওঠেনি।

কোচিংয়ের পক্ষে অরুণের বয়স খুব আদর্শ, বলা যায় না। তিপ্পান্ন ছুঁইছুঁই তিনি। কিন্তু কথা বললে বোঝা যায় একটা রোখ সব সময় কাজ করে তাঁর ভেতর। জীবনের প্রথম ইনিংসে ব্যর্থ, দ্বিতীয়তে সফল হবই।

দেড় বছর আগে যে টিম ইন্ডিয়ার বোলিং নিয়ে এত রকম সমস্যা ছিল, তারা আজ অনেক আঁটোসাঁটো। অরুণ এ দিন সাংবাদিক সম্মেলনে বলছিলেন, ‘‘যে কোনও পিচে খেলার জন্য আমাদের টিম এখন তৈরি। স্পিনে তো কোনও সমস্যাই নেই। অশ্বিন অ্যাটাক করে, উল্টো দিক থেকে জাডেজা বেঁধে রাখে। প্রথম জন আক্রমণকারী, দ্বিতীয় জন ব্যাঙ্কার। আবার যদি ফাস্ট উইকেটে ফেলা হয়, তখনও আমাদের চার জন বোলার আছে যারা ঘণ্টায় ১৪০ কিমি প্লাস স্পিড তুলতে পারে।’’

কথায় কথায় কালামের লাইন। গাঁধীজির বিখ্যাত মন্তব্য, এ সব আওড়ান ভরত। বলেন, এই লেভেলে তো কাউকে কোচিং করার বিশেষ দরকার নেই। শুধু তার মনের মধ্যে আইডিয়াগুলো গুঁজে গুঁজে দিতে হয়। দুটো বিখ্যাত উক্তির কথা তোলেন কোচ।

আপনি আজ যেমন সেটা আপনার গতকালের জন্য। আপনি আগামী কাল কী, সেটা হবে আপনার আজকের অবস্থান থেকে।

স্বপ্ন এমন একটা বস্তু নয় যা আপনি ঘুমের মধ্যে দেখেন। স্বপ্ন এমন জিনিস যা আপনাকে ঘুমোতে দেয় না।

ভরতের সফল ভারত অভিযানে সবচেয়ে ঝকমকে হিরের নাম অবশ্যই অশ্বিন। যে বোলার ধোনি- জমানায় গত বছরের ইংল্যান্ড সফরে নিয়মিত বাদ পড়েছেন। বাদ পড়তে পড়তে নিজের ওপর আস্থা চলে যাচ্ছিল, সেই বোলার কী করে এই অবস্থায় পৌঁছলেন যে ভারতীয় বোলিং কোচ তাঁকে নির্দ্বিধায় ‘বিশ্বের এক নম্বর স্পিনার’ আখ্যা দিচ্ছেন। কী করে অশ্বিন আর তিনি— বকলমে এত দ্রুত একটা গুরু-শিষ্য সম্পর্ক তৈরি হয়ে গেল?

‘‘আমি বিশেষ কিছু করিনি। শুধু ওর মনের মধ্যে থাকা কিছু সংশয় দূর করেছি আর ভেবে দেখতে বলেছি কোন কোন অ্যাঙ্গল থেকে এলে, কী ট্র্যাজেকটরিতে বল করলে ও আরও কার্যকর হতে পারে,’’ বললেন অরুণ। ‘‘বাকিটা অশ্বিন নিজে করেছে।’’ শোনা গেল শ্রীলঙ্কায় সঙ্গকারাকে কী ভাবে আউট করা হবে তা নিয়ে শাস্ত্রী-অরুণ-অশ্বিন ত্রিমুখী বৈঠক হয়েছিল। গোটা সিরিজে অশ্বিনের নিয়মিত খদ্দের হওয়া সঙ্গা রান পাননি তাঁর জন্য। ভরত অবশ্য কোনও কৃতিত্ব নিতে চান না। ‘‘প্লেয়ারকে এই লেভেলে শুধু বোঝাতে হয় এই ট্যালেন্ট নিয়ে সে কত কিছু করতে পারে। তার পর বাকি কাজটা সে নিজেই করে।’’

কিন্তু এই অশ্বিনকেই তো অ্যাডিলেড টেস্টে বাদ দিয়ে কোহলি প্রথম টেস্ট ক্যাপ্টেন্সি করতে নেমেছিলেন। সে দিন সেই সিদ্ধান্তের শরিক তো শাস্ত্রী আর ভরতও ছিলেন। কোহলির জোড়া সেঞ্চুরির পরেও ভারত টেস্টটা ৪৮ রানে হেরেছিল। ক্রিকেটমহলের সংখ্যাধিক্য অংশের বিশ্বাস, সে দিন অনভিজ্ঞ কর্ণ শর্মাকে না খেলিয়ে অশ্বিন নামলে ভারত অ্যাডিলেড জিতে সিরিজে ১-০ এগোত। তা হলে সিরিজটাও ড্র থাকত।

ভরত প্রথমে চুপ। তার পর বললেন, ‘‘অশ্বিন সেই সময় এই রকম তুঙ্গ মানসিক অবস্থায় ছিল না। অনেক দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছিল ওর মনে। আর একটা কথা বলি, ভুল তো আমাদেরও হতে পারে। কিন্তু আমাদের এই টিম যেটা চেষ্টা করছে তা হল কোনও বড় ভুল যেন দ্বিতীয় বার না হয়।’’

শাস্ত্রী ততক্ষণে ফিরে এসেছেন আলোচনায়। ‘‘নেপথ্যের লোকটাকে চিনলেন তো?’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement