তারকা: খুদে ভক্তদের সঙ্গে নিজস্বী সোনম কপূরের। শুক্রবার। নিজস্ব চিত্র
ভারতীয় খেলাধূলার ইতিহাসে জুড়ল নতুন পালক। আরব সাগরের পারে তৈরি হল ইতিহাসও!
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পরের বছর সেই ১৯৪৬ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শুরু হয়েছিল বাস্কেটবলের পেশাদার লিগ বাস্কেটবল অ্যাসোসিয়েশন অফ আমেরিকা। তিন বছর পরে সেই লিগেরই নাম পাল্টে হয় ন্যাশনাল বাস্কেটবল অ্যাসোসিয়েশন (এনবিএ)। তার পর থেকে যা প্রতি বছর চলে আসছে মার্কিন মুলুকে। এ বার সেই এনবিএ-র ঢেউ এসে লাগল ভারতেও। সচিন তেন্ডুলকরের শহরে ঝলমলে বোধন হল মাইকেল জর্ডানদের বাস্কেটবলের।
শুক্রবার ওরলির ইন্ডোর স্টেডিয়াম এনএসসিআই-এ সেই লিগেরই দুই দল স্যাক্রামেন্টো কিংস ও ইন্ডিয়ানা পেসার্স ইতিহাস তৈরি করে ভারতে প্রথম বার খেলে ফেলল প্রাক্-মরসুম প্রস্তুতি ম্যাচ।
ভারতীয় খেলার ইতিহাসে এটিই প্রথম এনবিএ-র কোনও দলের ম্যাচ। ঢাকের বাদ্য, ভাংড়া, বলিউডের জনপ্রিয় গান, সাইকেডেলিক আলোর দুরন্তপনা, গমগমে সাউন্ড সিস্টেম, তারকা সমাবেশ সবই ছিল। বাদ গেল না গণপতি উৎসবের সময় মুম্বইয়ের বিখ্যাত সেই দহি-হান্ডিও। যেখানে একজনের কাঁধের উপরে একজন উঠে ভাঙেন উপরে ঝোলানো দই ভরা পাত্র। খেলা শুরুর আগে বাজল ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র— দুই দেশের জাতীয় সঙ্গীত। সাত হাজার আসনের স্টেডিয়ামের একটা আসনও খালি ছিল না। যা দেখে খেলা দেখতে আসা এ দিনের অতিথি বলিউড অভিনেত্রী সোনম কপূর বলেই ফেললেন, ‘‘মনে হচ্ছে স্বপ্ন দেখছি। এই পরিবেশ তো মার্কিন মুলুকে দেখি। মনে হচ্ছে আস্ত একটা এনবিএ-বিনোদন মুম্বইয়ে এনে টুক করে কেউ বসিয়ে দিয়েছে।’’ শুটিংয়ে ব্যস্ত থাকায় এ দিন আসেননি প্রিয়ঙ্কা চোপড়া বা বচ্চন পরিবার। তাঁরা আসবেন আজ, শনিবারের ম্যাচ দেখতে। ফলে ‘স্যাটারডে নাইট’-এ আরও বড় ধমাকা আসতে চলেছে।
এ দিন ভারতে ঐতিহাসিক এই ম্যাচ শুরুর এক ঘণ্টা আগে সাংবাদিক সম্মেলন ডেকেছিলেন এনবিএ-এর কমিশনার অ্যাডাম সিলভার। সেখানেই দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এই ঐতিহাসিক মুহূর্তের সাক্ষী হতে মায়ানগরী মুম্বইয়ে জড়ো হওয়ার সাংবাদিকদের তিনি বলে দিলেন, ‘‘ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকেই সাংবাদিক বন্ধুরা এসেছেন। এটা আমাদের কাছে বড় প্রাপ্তি। এটা ভারতীয় খেলাধূলার জগতেই ঐতিহাসিক দিন নয়। এনবিএ-র কাছেও লাল কালি দিয়ে লিখে রাখার দিন।’’
তার পরেই তিনি শোনালেন এই ইতিহাস তৈরি হওয়ার নেপথ্য কাহিনি। তাঁর পাশে তখন এ দিনের ম্যাচে অংশগ্রহণকারী দুই দল স্যাক্রামেন্টো কিংস ও ইন্ডিয়ানা পেসারসের দুই মালিক বিবেক রণদিভে ও হার্ব সাইমন। পাঁচ বছর আগে এনবিএ লিগের কমিশনার হয়েছিলেন অ্যাডাম। সে কথা জানিয়ে তিনি বলতে শুরু করলেন, ‘‘২০১৪ সালে এনবিএ-র কমিশনার হওয়ার পরে প্রথম শুভেচ্ছা জানিয়ে আমাকে ভারতে আসার আমন্ত্রণ জানান বিবেক। আর তার পরে মুম্বইয়ে এসে এই স্টেডিয়ামেই আমাকে এক বিকেলে বলেছিলেন, আরও একটা অনুরোধ রাখতে হবে। তা হল, ভারতে এনবিএ-র প্রাক্-মরসুম প্রস্তুতি ম্যাচ। রাজি হয়ে গিয়েছিলাম। তার পরে ধীরে ধীরে এগিয়ে আজ ইতিহাসের সন্ধিক্ষণের সামনে হাজির আমরা।’’
যা শুনে এ বার হাসতে শুরু করে দেন দুই দলের মালিকই। বিবেক বলেন, ‘‘সতেরো বছর বয়সে মুম্বই ছেড়ে পাকাপাকি ভাবে আমেরিকা চলে গিয়েছিলাম। আজ একটা স্বপ্ন সত্যি হওয়ার দিন। ছোটবেলায় কোনও দিন ভাবতে পারতাম না, ভারতে এনবিএ-র দল খেলবে! আজ গোটা দেশের তিন হাজার স্কুল ছাত্রছাত্রী এই ম্যাচ দেখবে। এখনও স্বপ্ন দেখছি, একদিন এদের মধ্যে কোনও একজনকে এনবিএ-র দলে খেলতে দেখব।’’
এ বার সাইমন স্বল্প কথায় বলেন, ‘‘চিনে এনবিএ শুরুর দিন থেকে রয়েছি। আশা করছি, এ বার চিনকে ছাপিয়ে বাস্কেটবল এশিয়ায় আরও জনপ্রিয় হবে ভারতের হাত ধরে। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গেও এ ব্যাপারে কথা হয়েছে। আগামী দিনে ফাইভ জি প্রযুক্তি চালু হলে কোচিং বা যোগাযোগেও কোনও সমস্যা থাকবে না।’’ যা শুনে গোটা প্রেক্ষাগৃহে বয়ে যায় করতালি।
খেলা শুরু হওয়ার কথা ছিল সন্ধে ৭টায়। কিন্তু তার তিন ঘণ্টা আগেই এ দিন দলে দলে মুম্বইকররা আসতে শুরু করে দিয়েছিলেন স্টেডিয়ামে। ওরলি বা পেডার রোড থেকে ট্র্যাফিক জ্যাম শুরু হয়ে যায় বিকেল পাঁচটা থেকেই। শুধু মুম্বইকর বা ভারতেই নয়। মার্কিন মুলুকেও সমান উচ্ছ্বাস ছিল ভারতে এ দিনের এনবিএ ম্যাচের জন্য। স্যাক্রামেন্টো কিংস দলকে ভারতে আসার জন্য তার নিজের ব্যক্তিগত জেট ‘জেট এয়ার ড্রেক’ দিয়ে দিয়েছেন আমেরিকার প্রখ্যাত র্যাপ গায়ক ড্রেক। ম্যাচ শুরুর আগে তিনিও ভেসে উঠলেন স্টেডিয়ামের জায়ান্ট স্ক্রিনে। বললেন, ‘‘ভারতের কোণায় কোণায় ছড়িয়ে পড়ুক এনবিএ। তার জন্য শুভেচ্ছা রইল।’’ টানটান উত্তেজনার ম্যাচে নির্ধারিত ৯০ মিনিটে খেলার ফল ছিল ১১৮-১১৮। ফলে আরও ৫ মিনিট অতিরিক্ত সময় দেওয়া হয়। সেখানে ম্যাচ জেতে ইন্ডিয়ানা পেসার্স ১৩২-১৩১ ফলে।