সফল: লাভলিনার (ডান দিকে) ঘুসিতে বেসামাল প্রতিদ্বন্দ্বী।
গ্রামের নাম বারোমুখিয়া। কিন্তু বড় মুখ করে বলার মতো এত দিন কিছুই ছিল না গ্রামটার। একটা মুখ মঙ্গলবার বদলে দিল সবকিছু। অসমের প্রথম মহিলা বক্সার লাভলিনা বরগোহাঁই আজ রাজ্যের গর্ব আরও এক ধাপ বাড়িয়ে পৌঁছে গেলেন চলতি টোকিয়ো অলিম্পিক্সের কোয়ার্টার ফাইনালে। আর একটা ম্যাচ জেতা মানেই পদক নিশ্চিত। লাভলিনার জয়ের পর থেকে আতসবাজির রোশনাই গ্রাম জুড়ে।
গোলাঘাট জেলার অনুন্নত গ্রামের মানুষজন লাভলিনার পদক জয়ের প্রার্থনায় মগ্ন। ঘরের মেয়ে টোকিয়ো থেকে পদক আনলে এ বার হয়তো গ্রামে আসার কাদা রাস্তায় পিচ পড়বে। না হলে নেতা-মন্ত্রীরা গ্রামে ঢুকতে পারবেন না। যেমনটা বর্ষাকালে গ্রাম থেকে হাসপাতালে পৌঁছতে পারেন না মুমূর্ষু রোগীরা। একটা পদক গ্রামে এনে দিতে পারে বিশুদ্ধ পানীয় জল। গ্রামের কাছে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে শয্যা বা চিকিৎসক কিছুই নেই। একটা পদকের সুবাদে হয়তো সেই স্বাস্থ্যকেন্দ্রে এ বার রোগীদের চিকিৎসাও শুরু হবে।
২৩ বছরের লাভলিনা আসলে বারোমুখিয়া মানুষের অনেক অপূর্ণ স্বপ্ন, প্রত্যাশার বোঝা নিজের কাঁধে তুলে নিয়ে আজ বক্সিং রিংয়ে নেমেছিলেন। এর আগে মুখ্যমন্ত্রী হিমন্তবিশ্ব শর্মার নেতৃত্বে সব দলের বিধায়কেরা তাঁর জন্য সাইকেল অভিযান করছেন। আজকের জয়ের পরে রাজ্যবাসী ঘরে ঘরে প্রদীপ জ্বালাচ্ছেন। আজ জার্মানির নাদিন আপেতজ়-এর বিরুদ্ধে শেষ ষোলোর লড়াইয়ে ৩-২ জয়ের পরে মুখ্যমন্ত্রী থেকে শুরু করে অন্য সব মন্ত্রীদের শুভেচ্ছায় ভাসছেন লাভলিনা। আর গুয়াহাটি থেকে ৩২০ কিলোমিটার দূরে হাজার দুয়েক বাসিন্দারা আশায় বুক বেঁধেছেন, হিমা দাসের গ্রাম কান্ধুলিমারির মতোই ভাগ্য ফিরতে চলেছে তাঁদের গ্রামেরও।
এশিয়ান গেমসে তিনটি পদক, কমনওয়েলথ গেমস ও বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে (অনূর্ধ্ব-২০) পদকজয়ী হিমা দাসকে অসম সরকার ডিএসপি পদে নিয়োগ করেছে। হিমার বাড়ি যাওয়ার দেড় কিলোমিটার রাস্তা পাকা হয়েছে। গ্রামে তৈরি হয়েছে তোরণ, নামঘর, মিনি স্টেডিয়ামও। ছ’বারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ও অলিম্পিক পদকজয়ী মেরি কমের ইম্ফলের বাড়ি ও গ্রামের বাড়ির ভোল বদলে গিয়েছে।
বারোমুখিয়া যাওয়ার ১২ কিলোমিটার রাস্তা পাকা করতে ২০১৬ সালে উদ্যোগ নেওয়া হলেও ১০০ মিটার কাজ হওয়ার পরে সব বন্ধ। গ্রামে নেই বিশুদ্ধ জলের লাইন। ভরসা টিউবওয়েল ও পুকুরের জল। কেউ অসুস্থ হলে পাড়ি দিতে হয় ৪৫ কিলোমিটার দূরের সদর হাসপাতালে। কারণ বরপথার স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নেই শয্যা, আসেন না কোনও চিকিৎসক।
লাভলিনার পড়শি হেমন্ত মহন্ত বলছিলেন, “মেয়েটা অলিম্পিক্সে পদক জিতলে নিশ্চয়ই হিমার গ্রামের মতোই সরকারের নজর পড়বে বারোমুখিয়াতেও। রাস্তা ভাল করতে বাধ্য হবে সরকার।” এক সুর পারিবারিক বন্ধু হরেন গগৈ-এর গলাতেও, “ও-ই আমাদের শেষ আশা। আশপাশের গ্রামে প্রতিভার অভাব নেই। কিন্তু লাভলিনা পদক না পেলে তাদের উপরে হয়তো আর কোনওদিনই আলো পড়বে না।”
লাভলিনার ছোট দুই যমজ বোন লিচা ও লিমাও জাতীয় পর্যায়ে কিকবক্সিং করেছেন। কিন্তু লভলিনার প্রতিভা চিনতে পেরে সাইয়ের কোচ পদুম বড়ো ২০১২ সালে তাঁকে গুয়াহাটি নিয়ে আসেন। ২০১৮ সালে কমনওয়েলথ গেমসে সুযোগ পাওয়ার পরে তাঁকে আর পিছনে তাকাতে হয়নি।
কোয়ার্টার ফাইনালে চিনা তাইপের নিয়েন চিন চেন-এর মুখোমুখি হওয়ার আগে লাভলিনার বাবা টিকেন বরগোহাঁই অবশ্য নির্লিপ্ত। বললেন, “যে গ্রামে খেলার কোনও পরিকাঠামোই নেই, সেখান থেকে উঠে এসে অর্জুন পুরস্কার পাওয়া, অলিম্পিক্সের কোয়ার্টার ফাইনাল পর্যন্ত যাওয়াটাই তো রূপকথা। বিশ্বাস করি, আমার মেয়ে নিজের সেরাটাই উজাড় করে দেবে।”