Cricket

ধর্ম বদলেছেন, ঢাকার সেই ঐতিহাসিক স্কোয়াডের অভিমানী ক্রিকেটার থাকছেন ইডেনে

দারুণ সম্ভাবনা নিয়ে এসেছিলেন রঞ্জন। ১৮ বছর বয়সে প্রথম টেস্ট ম্যাচ খেলতে নেমেছিলেন ভারতের বিরুদ্ধে। সেটা ছিল বাংলাদেশেরও প্রথম টেস্ট।

Advertisement

কৃশানু মজুমদার

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৮ নভেম্বর ২০১৯ ১৫:২৩
Share:

ট্রফি হাতে বিকাশরঞ্জন দাস। এখন ব্যাঙ্কের ম্যানেজার তিনি। —নিজস্ব চিত্র।

রেকর্ড বই বলছে, ‘সদাগোপান রমেশ বোল্ড রঞ্জন দাস ৫৮।’ এই পরিসংখ্যানটুকু বাদ দিলে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তাঁকে চেনার, জানার আর কোনও উপায় নেই। কী করেই বা থাকবে! সেই ২০০০ সালের ১০ নভেম্বর-এর ভারত-বাংলাদেশ প্রথম টেস্ট ম্যাচটাই যে তাঁর জীবনের প্রথম এবং শেষ আন্তর্জাতিক ম্যাচ। তিনি বিকাশরঞ্জন দাস।

Advertisement

দারুণ সম্ভাবনা নিয়ে এসেছিলেন রঞ্জন। ১৮ বছর বয়সে প্রথম টেস্ট ম্যাচ খেলতে নেমেছিলেন ভারতের বিরুদ্ধে। সেটা ছিল বাংলাদেশ ক্রিকেটের এক ঐতিহাসিক দিন। নাবালকত্ব ছেড়ে সাবালকত্বের পথে পা বাড়িয়েছিল পদ্মাপাড়ের ক্রিকেট। অনেকেই তখন বলেছিলেন, লম্বা দৌড়ের মশলা রয়েছে বিকাশের মধ্যে। ঠিকঠাক রাস্তা ধরে এগোলে বাঁ হাতি পেসার সৌরভ ছড়াতেই পারতেন সে দেশের ক্রিকেটে।

কিন্তু যা ভাবা হয়, তা সব সময় মেলে না। ফুল হয়ে ফোটার আগেই ঝরে যেতে হয় বিকাশকে। ‘বিকাশ’ নামের অস্তিত্ব এখন আর নেই। সে দিনের বিকাশরঞ্জন দাস ব্যক্তিগত বিশ্বাসে বদলে ফেলেছেন ধর্ম। হয়ে গিয়েছেন মাহমুদুল হাসান। ক্রিকেটারের পরিবর্তে এখন তিনি ব্যাঙ্কের ম্যানেজার। ব্যস্ততার মধ্যে কাটে প্রতিটা দিন।

Advertisement

আরও পড়ুন: ইনদওরে মহড়ায় আবিষ্কার হল, বাউন্সও সামলাতে হবে পুজারাদের

এ হেন মানুষটার সঙ্গে যখন যোগাযোগ করা হল, তখন তিনি ভারতে আসার ভিসা সবেমাত্র হাতে পেয়েছেন। উত্তেজনায় ফুটতে থাকা প্রাক্তন ক্রিকেটার আনন্দবাজার ডিজিটালকে বললেন, ‘‘২১ তারিখ ভারতের বিমানে উঠছি। ২২ তারিখ ইডেন গার্ডেন্সে দেখা হবে দাদার সঙ্গে। ১৯ বছর আগে সৌরভের বিরুদ্ধে শেষ বার খেলেছি। তার পরে আর দেখা হয়নি ওর সঙ্গে। এ বার আবার দেখা হবে। দাদা দারুণ একটা উদ্যোগ নিয়েছে। আমাদের কথা যে ভুলে যায়নি, তাতেই প্রমাণিত সৌরভ অনেক বড় মাপের মানুষ।”

২০০০ সালে টেস্ট খেলার স্বীকৃতি পায় বাংলাদেশ। সৌরভের নেতৃত্বে ভারত গিয়েছিল সে দেশে। প্রাক্তন সেই ভারত অধিনায়ক এখন বোর্ড প্রেসিডেন্ট। টেস্ট ক্রিকেটের গরিমা ফেরাতে দারুণ এক উদ্যোগ নিয়েছেন তিনি। ভারত-বাংলাদেশ দ্বিতীয় টেস্ট হবে ইডেনে। বোর্ড প্রেসিডেন্ট আমন্ত্রণ জানিয়েছেন বাংলাদেশের হয়ে প্রথম টেস্ট ম্যাচ খেলা ক্রিকেটারদের। প্রিয় ‘দাদা’র কাছ থেকে আমন্ত্রণ পেয়ে নস্ট্যালজিক বিকাশ। ফিরে যাচ্ছেন ১৯ বছর আগের সেই ঐতিহাসিক দিনে। ঢাকার ইস্টার্ন ব্যাঙ্ক লিমিটেডের ব্র্যাঞ্চ ম্যানেজার বলছেন, “সেই মধুর স্মৃতি কী করে ভুলব বলুন তো! শান্ত (হাসিবুল হোসেন) ভাই প্রথম ওভার করেছিল। আর এক প্রান্ত থেকে আমি শুরু করেছিলাম। প্রথম বলটা করেছিলাম সদাগোপান রমেশকে।”

বিকাশের জোরের উপরে ধেয়ে আসা বলটাই মৃত্যু পরোয়ানা নিয়ে হাজির হয় রমেশের কাছে। টাইম মেশিনের সাহায্য না নিয়ে বিকাশ ফিরে যান ২০০০ সালের সেই প্রথম টেস্টে। তিনি বলছিলেন, ‘‘একটু জোরের উপরেই বলটা রেখেছিলাম। বাড়তি বাউন্সে বল রমেশের ব্যাটে লেগে স্টাম্পে লাগে। একটু পরেই আম্পায়ার স্টিভ বাকনার এগিয়ে এসে আমার হাতে বেলটা তুলে দিয়ে বলেন, এটা যত্ন করে রেখে দিও। এটা তোমার প্রথম টেস্ট উইকেটের স্মৃতি। বেলটা হাতে নিয়ে দেখলাম ভেঙে গিয়েছে।’’

আন্তঃ ব্যাংক প্রতিযোগিতায় এখনও বল হাতে নজর কাড়েন বিকাশ (সামনের তিন জনের মাঝখানে)।

সেই বেল এখনও বিকাশের শো কেসে সযত্নে সাজানো রয়েছে। অভিষেক টেস্টের সেই স্মারকের দিকে তাকালে অদ্ভুত এক ভাল লাগা কাজ করে তাঁর। সেই সঙ্গে যন্ত্রণায় মোচড় দিয়ে ওঠে তাঁর বুক। শুরুতেই কেন শেষ হয়ে গেল প্রতিশ্রুতি জাগানো একটা কেরিয়ার? সেই প্রশ্নের ব্যাখ্যা দিয়ে বিকাশ বলছেন, ‘‘ঘরোয়া ক্রিকেটে নাগাড়ে বল করে যেতাম। পিঠে ব্যথা অনুভব করতাম। কেউ সে ভাবে আমাকে গাইড করার ছিল না। ওই পিঠের চোটই আমার কেরিয়ার শেষ করে দিল।’’

আরও পড়ুন: ইডেনে প্রথম গোলাপি বলে দিনরাতের টেস্টই বড় পরীক্ষা, বলছেন সৌরভ

কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে শেষ করে উঠেই প্রাক্তন বাঁ হাতি পেসারের প্রশ্ন, ‘‘আপনাদের বুমরাও তো চোটের কবলে। তাঁকে ফেরানোর জন্য চেষ্টা করছে না বিসিসিআই?’’ চোট-আঘাত ফাস্ট বোলারের জীবনে বিভীষিকা। চোট সারিয়ে ফিরে আসার লড়াইটা একজন ফাস্ট বোলারের কাছে আরও কঠিন। সংশ্লিষ্ট ক্রিকেট বোর্ডের সাহায্যের দরকার পড়ে। বিকাশের অভিমান তাঁর দিকে সেই সময়ে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়নি বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড। অবহেলিত বিকাশ অভিমানের বাষ্প গলায় জড়িয়ে বলছেন, “অস্ট্রেলিয়ায় কমনওয়েলথ ব্যাঙ্ক টুর্নামেন্ট খেলতে গিয়ে সচিন তেন্ডুলকর ও অজিত আগরকরের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। পরে জানতে পারি চোট সারানোর জন্য বোর্ড ওদের অস্ট্রেলিয়ায় পাঠিয়েছে। আমিও আমাদের দেশের বোর্ডের শরণাপন্ন হয়েছিলাম। দুঃখের কথা, কোনও সহযোগিতাই পাইনি। তখন ঠিকঠাক সাহায্য পেলে আমাকে হয়তো খেলা ছাড়তে হত না।’’

বাংলাদেশের ঐতিহাসিক টেস্টের সেই দল।

সেই কষ্ট বুকে চেপে রেখে দিয়েছেন বিকাশ। বোর্ডের প্রতি অভিমান এখনও রয়েছে। বলছিলেন, “যে তোমাকে সার্ভিস দেবে, তাকে তো যত্ন করতে হয়।’’ সেই যত্নটাই পাননি বলে অভিযোগ তাঁর। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের প্রতি তীব্র অভিমানে আর যোগাযোগও রাখেননি। কথায় বলে, দৃষ্টির আড়াল হলে, স্মৃতি থেকেও নাকি মুছে যাওয়া হয়। বিকাশকেও হয়তো ভুলেই গিয়েছিল সে দেশের বোর্ড। না হলে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের আমন্ত্রণের কথা তাঁকে কেন জানাল না কেন বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড? দেশের প্রাক্তন অধিনায়ক হাবিবুল বাশারের কাছ থেকেই প্রথম তিনি জানতে পারেন ইডেনে আসার আমন্ত্রণ জানিয়েছেন ‘দাদা’।

দ্বিতীয় টেস্টের জন্য সেজে উঠছে কলকাতা। শহর মোড়ানো হবে গোলাপি আলোয়। ইডেনে বসবে চাঁদের হাট। ইতিহাস তৈরির ম্যাচে ভারতকে কি বেগ দিতে পারবে বাংলাদেশ? ইনদওরে মাত্র তিনদিনেই টেস্ট ম্যাচ জিতে নিয়েছে ভারত। দ্বিতীয় টেস্টে তো আরও ঝড়ঝঞ্ঝা বইবে বাংলাদেশের উপর দিয়ে! খেলতে হবে সম্পূর্ণ অপিরিচিত গোলাপি বলে। শামি-ইশান্তদের মোকাবিলা করতে হবে ফ্লাডলাইটের আলোয়। কাজটা কতটা কঠিন? বিকাশ বলছেন, “ভারতের মাটিতে দক্ষিণ আফ্রিকাও তো কয়েকদিন আগে বিধ্বস্ত হল। খুবই শক্তিশালী দল ভারত। বিশ্বের সেরা বোলার রয়েছে ভারতের এই দলটায়। বাংলাদেশ আরও ভাল খেলতেই পারত। তবে এটাও তো ভাবতে হবে, পুরো শক্তির দল নিয়ে যেতে পারেনি বাংলাদেশ। আশা করি ইডেনে লড়াই হবে। দিন-রাতের টেস্ট উপভোগ করবেন সবাই।’’

শুক্রবারের ভরা ইডেন আবেগতাড়িত করে তুলতে পারে বিকাশকে। ফিরিয়ে দিতে পারে ১৯ বছর আগের সোনা রোদ্দুর। কল্পচোখে তিনি দেখতেই পারেন ১৮ বছরের এক তরুণ প্রতিভা বল হাতে ছুটছেন বঙ্গবন্ধুতে। তাঁর বিষাক্ত ছোবলে মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে রমেশের উইকেট। কে বলে ক্রিকেট কেড়ে নেয়! মন ভাল করা অনেক স্মৃতিও তো ফিরিয়ে দেয় ক্রিকেট।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement