অরুণ লাল ও রণদেবের প্রতি ক্ষোভ উগরে দিলেন অশোক ডিণ্ডা।
বঙ্গক্রিকেটে অশোক ডিন্ডা বিতর্কিত এক চরিত্র। বহু যুদ্ধের নায়ক, অনেক স্মরণীয় জয়ের কারিগর। কিন্তু বাংলার সঙ্গে সেই নাড়ির টান ছিঁড়ে যেতে বসেছে। গত মরসুমেই ছিলেন না দলে। এ বার, পরের মরসুমের জন্য বাংলা ছাড়তে চাইছেন তিনি। কেন এই সিদ্ধান্ত, আনন্দবাজার ডিজিটালের সামনে অকপট ‘নৈছনপুর এক্সপ্রেস।’
বাংলা ছাড়ার সিদ্ধান্তে পৌঁছনো কতটা কঠিন ছিল?
অশোক ডিন্ডা: খুব যন্ত্রণার। কিন্তু আমি তো ক্রিকেটার। পেশাদার খেলোয়াড়। বাংলার জন্য কী করেছি, বাংলা আমাকে কী দিয়েছি, সেগুলো একটা বড় দিক। যাই হোক না কেন, বাংলা ক্রিকেট থেকেই সব পেয়েছি। নাম থেকে শুরু করে জীবনের সব আনন্দ এসেছে বাংলার হয়ে খেলেই। বাংলা ক্রিকেটের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারব না কোনও দিন। বাংলার ড্রেসিংরুমে ১৪ বছর কাটিয়েছি। কলকাতায় নিজের বাড়িতেও হয়তো এত সময় কাটাইনি। পেনফুল, খুব কষ্টের ছিল সিদ্ধান্তটা।
গত মরসুমে আপনার ফিটনেস নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল।
অশোক ডিন্ডা: আমি ফিট না ফিট নই, সেটা কে ঠিক করবে? (হাসি) কে এই সিদ্ধান্ত নেবে? অরুণ লাল? অরুণ লাল নিজে ফিট কি না সেটাই তো প্রশ্ন। ওঁর থিওরি হল দৌড়ও, দৌড়েই যাও। এটা নব্বইয়ের দশকের তত্ত্ব। তখনকার ক্রিকেটের থেকে এখন অনেক কিছু পাল্টেছে। গত ১৪ বছর আমি যে ভাবে ট্রেনিং করে এসেছি, হুট করে সেটা বদলাতে বলা হচ্ছে। আমাকে বলা হল, ম্যাচে পাঁচ-ছয় ওভার বল করার পর তুমি কেন মাঠ ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছো দু’ওভারের জন্য? আমি বললাম যে, আমরা ফাস্ট বোলার। আমাদের এক বার বেরিয়ে গিয়ে পোশাক পরিবর্তন করে আসতে হয়। কারণ, জামা, অন্তর্বাস সব ভিজে যায়। পাল্টে না এলে শরীরের ক্ষতি। হাওয়া লেগে ব্যাক পেনের আশঙ্কা থাকে। ভেজা পোশাকে থাকলে কোমর টাইট হয়ে যায়, পেশীতে টান ধরে। সেটা তো এরা বুঝবে না। ওই কনসেপ্টই নেই। আর ওঁকে বোঝাতে পারবেও না কেউ। উনি যা বলবেন, সেটাই বাংলা ক্রিকেটের জন্য শেষ কথা। আর ওঁকে বুঝিয়েও লাভ নেই। প্রথম প্রথম বোঝানোর চেষ্টা যে করিনি তা নয়। কিন্তু দেখলাম কোনও ফায়দা নেই। তাই পরের দিকে এড়িয়ে যাচ্ছিলাম। যা বলছে বলুক। আমি নিজে পারফরম্যান্স করে খেলব। আমি নিজের জোরে খেলি। কারও দয়ায় খেলি না। কোনও কোচকে তেল দিয়ে চলি না। এই সব কারণেই আমি কোচের অপ্রিয়।
আরও পড়ুন: ‘ক্রিকেটে স্বজনপোষণ থাকলে রোহন গাওস্কর তো টেস্টও খেলত’
শুধু এই কারণেই এত অশান্তি?
অশোক ডিন্ডা: নানা ঘটনা আছে। কোচ সারা ক্ষণ বলে চলেছিলেন, ডিন্ডার গতি কমে গিয়েছে, সুইং হচ্ছে না। সুইং হচ্ছে কি হচ্ছে না, গতি কমেছে কি কমেনি, এগুলো আসলে কোনও বিষয়ই নয়। বলেছিলাম, আমার ইনসুইং হয়, নাকি আউটসুইং হয়, তোমার জানার তো দরকার নেই। আমি ম্যাচ জিতিয়ে দিলেই হল, পারফর্ম করলেই হল, উইকেট নিলেই হল। আমি কোন ম্যাচে উইকেট নিইনি সেটা বলা হোক।
মরসুমের শুরুতে বিজয় হজারে ট্রফি ও সৈয়দ মুস্তাক আলি ট্রফিতে আপনার পারফরম্যান্স নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল।
অশোক ডিন্ডা: তাতেও তো উইকেট নিয়েছি। যতগুলো ফাস্ট বোলার ছিল, যে চার জন খেলেছিল, তাঁদের সবার চেয়ে বেশি উইকেট ছিল আমার। আসলে উইকেট নেওয়া কোনও ব্যাপার নয়। ডিন্ডার থেকে সবাই অনেক বেশি আশা করে। এত বছরে ওরা দেখে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছে যে, ডিন্ডা মানেই পাঁচ উইকেট নেবে। এটাই নিয়ম হয়ে গিয়েছে। দুটো করে উইকেট নিলে দেখি কেউ খুশি নয়। আমি কিন্তু বিজয় হজারে ট্রফির সময় বলে দিয়েছিলাম যে সব ম্যাচ খেলব না। বেছে বেছে খেলব। সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গেও এটা নিয়ে কথা বলেছিলাম। আমার ১৪ বছর খেলা হয়ে গিয়েছে। যাতে গুরুত্বপূর্ণ সময়ে বাংলার বেশি কাজে আসতে পারি, সেই কারণেই বেছে বেছে খেলতে চেয়েছিলাম। অরুণ লাল গত বছর একটা প্রশ্ন মিডিয়ার মাধ্যমে ছুড়ে দিয়েছিলেন যে, ডিন্ডা কেন ক্লাব ক্রিকেট খেলে না। আমি বলেছিলাম যে, দরকার নেই ক্লাব খেলার। বাংলার হয়ে এত বল করি যে ক্লাবের হয়েও বল করলে পরমায়ুই চলে যাবে (হাসি)। বাংলার হয়েও কুকুরের মতো দৌড়ব, ক্লাবের হয়েও তাই করব, আমি কি রোবট নাকি? আমি তো মানুষ, এটা তো মানুষের শরীর। তখন আমাকে বলা হল যে ক্লাব ক্রিকেটে বল না করলে নাকি যোগ্য ক্রিকেটার উঠে আসছে না! আমি তখন বললাম, আমি কি ক্রিকেটার গড়ার জন্য ক্লাব ক্রিকেট খেলব? এগুলো আমার ভাল লাগেনি। এই কারণেই আমাকে ওর অপছন্দ। দুনিয়ায় প্রচুর মানুষ। অনেকেই আমাকে পছন্দ করে, অনেকে করে না। তবে তাতে আমার কিছু আসে-যায় না।
ফেলে আসা সোনার দিন। বাংলার হয়ে চেনা মেজাজে ডিণ্ডা।—ফাইল চিত্র।
মানে কোচের অপছন্দ বলেই বাংলা ছাড়তে হচ্ছে।
অশোক ডিন্ডা: দেখুন, পারফর্ম করছিলাম বলে বাদ দেওয়া যাচ্ছিল না। তখন ফিটনেসের কথা বলা হল। জানানো হল, ইয়ো ইয়ো টেস্ট দিতে হবে। অন্যদের ক্ষেত্রে দূরে বসে থাকলেও আমার সময় সামনে চেয়ার নিয়ে এসে বসলেন। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, পাশ মার্ক কত। বললেন, ১৬। আমি বললাম, এটা পেরিয়ে থেমে যাব। উনি বললেন, করে দেখাও। মুখে বলে কী হবে। আমি বললাম, হাসতে হাসতেই করে দেব। করেও দিলাম। ওঁর সামনেই পাশ করলাম। কিন্তু উনি মানলেন না। বললেন, তুমি পাশ করেছো বিশ্বাস হচ্ছে না। আমি বললাম, লালজি, আপ তো অরুণ লাল হো না? বললেন, হাঁ। আমি বললাম, আপনার সামনেই তো করলাম, কোনও ভূতের সামনে তো পাশ করিনি!
আর এক দিন ভিডিওকন মাঠে বলল প্র্যাকটিস হবে। গেলাম। বৃষ্টি হয়েছিল। বলা হল রাস্তায় দৌড়তে। কিন্তু আমার তা বারণ ছিল। ফিজিও অ্যান্ড্রু লিপাস আমাকে রাস্তায় দৌড়তে বারণ করেছিলেন। হার্ড সারফেসে দৌড়লে শরীর টাইট হয়ে যায় আমার। তাই আমি করব না বলে দিলাম। উনি বললেন, আমি অরুণ লাল, আমার কাছে দলের সবাই সমান। আমি বললাম, এটা আমি করতে পারব না। দেখুন, টিম ডিনারে সবাই খাচ্ছে বলে নিরামিষাশী কাউকেও কি আমিষ খেতে হবে? সে তো তার শরীরের ধরন, খাওয়ার অভ্যাস মেনে চলবে। নাকি, তখন সবার জন্য একই নিয়ম, সবাই সমান বলা উচিত? আমাকে যদি ডাক্তার বলে দেয় যে এটা করা চলবে না, সেটা করতে পারব না। আর আমি তো নিজের জন্য বা আইপিএল খেলব বলে তো এটা করছি না। নিজের শরীরকে বাঁচাচ্ছি বাংলার হয়ে উজাড় করে দেব বলে। বাংলার কোচ হওয়ার নেপথ্যে ওর উদ্দেশ্য হল, সিনিয়রদের চাপে ফেলা। সুযোগ মিলছিল না আমাকে ঝামেলায় ফেলার। রণ বোসের সঙ্গে হাত মিলিয়ে তাই আমাকে বের করে দেওয়া হল।
আরও পড়ুন: ১৯৮৩-এর সেই বিশ্বকাপজয়ী দলের সদস্যরা আজ কে কোথায়
শুধু তো কোচ অরুণ লালই নন, বোলিং কোচ রণদেব বসুর সঙ্গেও আপনার সমস্যা ছিল।
অশোক ডিন্ডা: রণ যে পাঁচ বছর বাংলার কোচ, আমি প্রতি বারই বেশি উইকেট নিই। কিন্তু আমার সঙ্গে একটা কথাও বলে না। কোনও পরিকল্পনা করে না। সেটা অন্যদের বলে দেয়। আমার জন্য ওর চাকরি থাকছে, আমি উইকেট নিচ্ছি বলে ও কোচ থাকছে, কিন্তু এক বারও আলোচনা করে না। অন্ধ্রপ্রদেশ ম্যাচের আগে বোলারদের নিয়ে মিটিং হচ্ছিল। আমি ওদের ব্যাটসম্যানদের সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানতাম না। অভিমন্যু ঈশ্বরনের কানে কানে রণ বলছিল কোথায় কোথায় ফিল্ডার দিতে হবে। আমি বললাম, জোরে কথা বলতে। আমিও জানতে চাইছিলাম কাকে কোথায় বল করব। তা দু’মিনিট পর রণ ফের একই কাজ করল। আমি আবার বললাম জোরে সবাইকে জানিয়ে কথা বলতে। বলেই খাবার আনতে উঠে গিয়েছিলাম। রণ তৃতীয় বারের জন্য ফের একই কাজ করতেই মাথা গরম হয়ে গেল। তখন কথা শুনিয়ে দিলাম। খারাপ খারাপ কথাও বলে দিলাম। ব্যাস, বাংলায় ডিন্ডার দ্য এন্ড। অরুণ লাল একটা সুযোগের অপেক্ষায় ছিল। এটাকেই কাজে লাগাল সঙ্গে সঙ্গে।
অন্য সিনিয়রদের সঙ্গেও কি অরুণ লাল এমন করেন?
অশোক ডিন্ডা: মনোজ তিওয়ারির সঙ্গে কী করেন, জানি না। তবে মনোজও খুব একটা পাত্তা দেয় না। নিজের মতো থাকে। আমিও তাই করছিলাম। উনি অরুণ লাল তো কী, আমিও তো অশোক ডিন্ডা রে ভাই! গত ৩০ বছর কোথায় ছিলেন অরুণ লাল?
এই ব্যপারে সৌরভের সঙ্গে কথা হয়নি?
অশোক ডিন্ডা: দাদার সঙ্গে অনেক বার কথা হয়েছে। দাদা বলল যে, আমি কথা বলেছিলাম, কিন্তু ওরা চাইছে না। টিম চায়ই না যে আমি ফিরে আসি (মলিন হাসি)।
শেষ প্রশ্ন, বাংলা ছেড়ে কোন দলে যাচ্ছেন?
অশোক ডিন্ডা: বিশ্বাস করুন, এখনও কারও সঙ্গে কথা হয়নি। ফালতু সব কথা লেখা হচ্ছে। আগে ছাড়পত্র নিই, তার পর কথা বলব। ক্রিকেট আর খেলব কিনা, সেটাই সন্দেহ!