বাঙালির ব্যাঘ্রগর্জন ধর্মশালা থেকে পদ্মাপার

যন্ত্রণা ভুলে দিন্দার পাঁচে জয় বাংলা

প্রতিপক্ষ পঞ্জাব: প্রথম ইনিংসে পাঁচ উইকেট। দ্বিতীয় ইনিংসে দু’টো। সর্বমোট—ম্যাচে সাত! প্রতিপক্ষ রেলওয়েজ: প্রথম ইনিংসে পাঁচ, দ্বিতীয় ইনিংসেও পাঁচ। সর্বমোট— ম্যাচে দশ-দশটা উইকেট! না, এটা ক্রিকেট-মরসুম শেষে কোনও বোলারের সেরা দু’টো বোলিং পারফরম্যান্স ঝাড়াই-বাছাই করে বার করা নয়।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ৩১ অক্টোবর ২০১৬ ০৪:০৫
Share:

প্রতিপক্ষ পঞ্জাব: প্রথম ইনিংসে পাঁচ উইকেট। দ্বিতীয় ইনিংসে দু’টো। সর্বমোট—ম্যাচে সাত!

Advertisement

প্রতিপক্ষ রেলওয়েজ: প্রথম ইনিংসে পাঁচ, দ্বিতীয় ইনিংসেও পাঁচ। সর্বমোট— ম্যাচে দশ-দশটা উইকেট!

না, এটা ক্রিকেট-মরসুম শেষে কোনও বোলারের সেরা দু’টো বোলিং পারফরম্যান্স ঝাড়াই-বাছাই করে বার করা নয়। শেষ কীসের? ভারতবর্ষে ঘরোয়া ক্রিকেট মরসুম তো সবে শুরু হয়েছে। ফার্স্ট ল্যাপ চলছে, প্রচুর ম্যাচ বাকি এখনও। উপরের বোলিং হিসেবটা যাঁর, তিনি সারা দেশের বাকি ক্রিকেটারদের মতোই তিন নম্বর রঞ্জি ম্যাচটা দীপাবলির দিন শেষ করে উঠলেন।

Advertisement

পার্থক্যের মধ্যে শুধু বাকিদের চোখ কপালে তুলে, শিরদাঁড়া দিয়ে হিমস্রোত নামিয়ে।

তিনি— অশোক দিন্দা!

রবিবারের ধর্মশালা যে ভয়াবহ দিন্দাকে দেখল, তার পর বোধহয় পরবর্তী প্রতিপক্ষ নিয়ে বিশেষ চিন্তায় থাকার প্রয়োজন নেই বাংলার। ভাবতে তো এ বার প্রতিপক্ষকে হবে, হবে বত্রিশের এক বাঙালি পেসারকে নিয়ে। দিন্দাকে নিয়ে। যিনি আবার পাঁচ উইকেট নিলেন (৫-৬৭)। রেলওয়েজকে একা হাতে উড়িয়ে দিলেন, ট্র্যাকে পেস-মাইন পুঁতে! এ দিন পড়ে থাকা পাঁচটা উইকেটের পাঁচটাই যার, যিনি মাঠ ছাড়লেন ম্যাচে দশ উইকেট নিয়ে। বাংলাকে টানা দু’টো রঞ্জি ম্যাচ জিতিয়ে।

এবং পুরোটাই করলেন ঘাড়ের অসহ্য যন্ত্রণা নিয়ে।

দু’টোর মধ্যে মাহাত্ম্যে যে কোনটা বড়, তা নিয়ে কিছুটা ধন্ধে পড়ে গেলে দোষ দেওয়া যাবে না। টানা দু’টো রঞ্জি ম্যাচ জয়, বহু দিন তো দেখেনি বঙ্গ ক্রিকেট! শেষ যত দূর মনে করা যাচ্ছে, বছর তিনেক আগে লক্ষ্মীরতন শুক্লের নেতৃত্বাধীন টিম বাংলা, যারা পরপর দু’টো ম্যাচ জিতে রঞ্জি ট্রফি সেমিফাইনাল খেলেছিল। বাংলা অধিনায়ক মনোজ তিওয়ারি যার পর ক্রুদ্ধ হুঙ্কার ছেড়ে রাখলেন এই বলে যে, বাংলা আর গ্রুপ টেবলের দিকে তাকিয়ে খেলবে না। বাংলাকে নিয়ে অন্যরা ভাববে। বাংলা বাকিদের নিয়ে ভাববে না। ধর্মশালা থেকে ফোনে বলে দিলেন, ‘‘বাকি পাঁচটা ম্যাচ টাফ। কিন্তু আমাদের গ্রুপে সবচেয়ে টাফ টিমটার নাম কিন্তু বাংলা!’’ আর যন্ত্রণা নামক বিপক্ষের সঙ্গে দিন্দার চোয়ালচাপা যুদ্ধ? তাকে হারিয়ে টিমের মাথায় বিজয়ীর তাজ পরিয়ে দেওয়া? পড়ে থাকা রেল ব্যাটিংকে একা সাফ করে মাঠ ছাড়া? তার বীরত্ব, মাহাত্ম্যও বা কম কী?

‘বেঙ্গল এক্সপ্রেস’ যে এ দিন এমন রুদ্রমূর্তি ধরবেন, আন্দাজ করা সম্ভব হয়নি। গত কাল বল করার সময় ‘স্টিফ নেক’ হয়ে গিয়েছিল দিন্দার। যন্ত্রণা হচ্ছিল। হয়তো তার প্রভাবেই উইকেটহীন থেকে যেতে হয়েছিল। পেনকিলার খেয়ে এ দিন নামতে হয়। কিন্তু নামার আগে বাংলা কোচ সাইরাজ বাহুতুলেকে অদ্ভুত একটা কথা বলেন দিন্দা।

‘‘যা হবে, হবে। আমি পুরো এফর্টটা আজ দেব!’’

দিলেনও বটে। রেলের মহেশ রাওয়াত আর কর্ণ শর্মার জুটিটা ভাঙতে হত বাংলাকে। এঁরা থেকে গেলে, বিপদ হতে পারত। কর্ণ তো শেষ পর্যন্ত অপরাজিতও থেকে গেলেন। কিন্তু বাঁচতে পারেননি মহেশ দিন্দার ‘রোষ’ থেকে। ‘‘ভেবে রেখেছিলাম, একটা ফুল এফর্ট দেব। যা হওয়ার হবে। এর পরে পাঁচ দিন বিশ্রাম পাওয়া যাবে। যথেষ্ট সময় থাকবে সুস্থ হওয়ার,’’ ধর্মশালা থেকে দিওয়ালি-সন্ধেয় ফোনে বলছিলেন দিন্দা। ‘‘আমি তো এটাও ভেবে রেখেছিলাম যে, যদি পুরোটা না পারি একটা ব্রেক থ্রু দিয়ে যাব। মহেশ বা কর্ণের মধ্যে কাউকে একটা তুলে নেব। বাকিদের অন্যরা দেখে নেবে। তার পর দেখলাম, ঠিক আছে। মহেশকে আউট করার পরেও পারছি। তখন মনে হল, ছাড়াছাড়ির কোনও ব্যাপার নেই। কাজ শেষ করে বেরোব!’’

বঙ্গ পেসারের কথাবার্তা শুনলে শ্রদ্ধা জন্মাবে আপনাআপনি। আলোর উৎসবের দিনে যন্ত্রণার প্রতিবন্ধকতা উপেক্ষা করে তিনি যে উপহার দিলেন, তার চেয়ে বড় উপহার আর কী হতে পারত বঙ্গ ক্রিকেটের কাছে? আর কাজটা যে কঠিন ছিল, অনস্বীকার্য। রেলের একশোর একটু বেশি প্রয়োজন ছিল জেতার জন্য, হাতে ছিল পাঁচটা উইকেট। সেখান থেকে ৪৩ রানে ম্যাচ জিতে বেরোনো, সহজ নয়।

বাংলা অধিনায়ককে রাতে বেশ ফুরফুরে মেজাজে পাওয়া গেল। স্বাভাবিক। তিন ম্যাচ খেলে বাংলার পয়েন্ট এখন ১৫। দিন্দার আবার তিন ম্যাচ খেলে উইকেটসংখ্যাটা আরও চার বেশি— ১৯। মনোজ বলছিলেন, ‘‘মানছি যে, তাড়াতাড়ি আমরা পিক-এ চলে গিয়েছি। কিন্তু এটা আমরা ধরে রাখতে পারব বলে বিশ্বাস। আসলে টিমে জয়ের এই অভ্যেস, কালচারটার খুব প্রয়োজন পড়ে। আমাদের ড্রেসিংরুম আবহাওয়াও চমৎকার। কেউ বলতে পারবে না সে চাপে আছে। সবাই খোলা মনে খেলতে পারছে।’’ বলে বাংলা অধিনায়কের সংযোজন, ‘‘এই জয়টা স্পেশ্যাল। কারণ, গত কাল যখন ওদের বড় পার্টনারশিপ হচ্ছিল, মনে হচ্ছিল ম্যাচটা বেরিয়ে যাবে না তো? কিন্তু আমি টিমের উপর ভরসা রেখেছিলাম। দু’টো ক্যাচ না পড়লে আরও আগে শেষ করে দিতাম।’’

মনোজ এর বাইরে দু’টো কথা বললেন। এক, জয়টা তিনি দেশের জওয়ানদের উৎসর্গ করছেন। দ্বিতীয়ত, দীপাবলিতে তিনি পরিবারকে মিস করছেন ঠিকই। কিন্তু ধর্মশালায়ও তাঁর একটা পরিবার আছে। যার নাম বাংলা। দিওয়ালির রাতটা যাদের সঙ্গে একটা পার্টি হবে। আর নায়ক নিজে? দিন্দাকে বলতে শোনা গেল, রবিবারের পাঁচ উইকেট নেওয়ার অনুভূতিটা আলাদা। অন্য রকম। ‘‘আমি সব সময়ই নিজের সেরাটা দিয়ে বোলিং করি। কিন্তু আজকের আনন্দটা একটু আলাদা। আসলে যন্ত্রণাটা নিয়ে করা তো, তাই।’’

আলাদা হওয়া উচিতও। এ রকম দিন রোজ-রোজ আসে না। এবং বাংলা পেসার চান না, কোনও ভবিষ্যৎদ্বাণীতে যেতে। লিগ টেবলে নেট রান রেটে দু’নম্বরে। গুজরাতের মতো বাংলারও ১৫ পয়েন্ট। তবু রঞ্জি কোয়ার্টার-সেমি নিয়ে বলতে চান না। শুধু চান, ম্যাচ ধরে-ধরে এগোতে। ‘বেঙ্গল এক্সপ্রেস’ চাইছেন, আগামী ৫ নভেম্বর থেকে ‘রেড চেরি’-টা নিয়ে একই আগ্রাসনে আবার প্রতিপক্ষের দিকে ছুটে যেতে। পঞ্জাব হারল। রেল উল্টোলো। এ বার রাজধানীতে গুজরাত।

পার্থিব পটেল সামলে, দিন্দা আসছে!

সংক্ষিপ্ত স্কোর:
বাংলা ২০৫ ও ২১৪। রেলওয়েজ ১০৫ ও ২৭১ (কর্ণ ন:আ: ৫৪, অরিন্দম ৫১, মহেশ ৩৪, দিন্দা ৫-৬৭)।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement