জানত না টিম, অক্ষত সঙ্গকারাদের বিশ্বরেকর্ড

হাজারেদের রঞ্জি কীর্তি টপকেও মহারাষ্ট্র সংসারে আক্ষেপ-স্রোত

রঞ্জি ট্রফিতে সর্বকালীন রেকর্ড করা একটা টিমের মনন-নির্যাস কী রকম হতে পারে? তা-ও আবার বিজয় হাজারে-গুল মহম্মদের সত্তর বছরের পুরনো ইতিহাসকে চূর্ণ করে দিলে?

Advertisement

রাজর্ষি গঙ্গোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৫ অক্টোবর ২০১৬ ০৩:৪০
Share:

ওয়াংখেড়েতে রেকর্ড গড়ে ফিরছেন অঙ্কিত-স্বপ্নিল। শুক্রবার। ছবি টুইটার।

রঞ্জি ট্রফিতে সর্বকালীন রেকর্ড করা একটা টিমের মনন-নির্যাস কী রকম হতে পারে? তা-ও আবার বিজয় হাজারে-গুল মহম্মদের সত্তর বছরের পুরনো ইতিহাসকে চূর্ণ করে দিলে?

Advertisement

নিজেদের কীর্তি নিয়ে তারা উদ্বেলিত থাকবে। ইতিহাস সৃষ্টির উৎসবের শুরু থাকবে, কিন্তু শেষ পাওয়া যাবে না।

কীর্তিমানদের ফোন টানা ব্যস্ত শোনাবে। মেসেজের ভিড় বেড়ে যাবে এতটাই যে, এক রাতে সব পড়ে ওঠা যাবে কি না সন্দেহ।

Advertisement

মহারাষ্ট্র ক্রিকেট-সংসারে দ্বিতীয়টা আছে। শুধু প্রথমটা নেই।

দিল্লির বিরুদ্ধে শুক্রবার অবিচ্ছেদ্য ৫৯৪ রানের পার্টনারশিপ করলেন মহারাষ্ট্রের যে দু’জন, তাঁরা স্বপ্নিল গুগালে এবং অঙ্কিত বাওনে। ১৯৪৬-৪৭ মরসুমে রঞ্জি ট্রফিতে বিজয় হাজারে ও গুল মহম্মদের ৫৭৭ রানের পার্টনারশিপ রেকর্ড তাঁরা চূর্ণ করে দিলেন। সৃষ্টি করলেন নতুন রঞ্জি ইতিহাস। সর্বোচ্চ পার্টনারশিপের কীর্তি। স্বপ্নিল অপরাজিত থাকলেন ৩৫১ রানে (৫২১ বল, ৩৭X৪, ৫X৬)। অঙ্কিত অপরাজিত ২৫৮ রানে (৫০০ বল, ১৮X৪, ২X৬)। দু’জনেরই কেরিয়ার-সেরা ইনিংস। এবং এমন অসামান্য কীর্তির পর ক্রিকেটারের জীবনে যা ঘটা উচিত, স্বপ্নিল-অঙ্কিতের ক্ষেত্রে তাই ঘটেছে। পরের পর শুভেচ্ছাবার্তায় প্রায় দমবন্ধ পরিস্থিতি, অর্ধেক ফোন ধরা সম্ভব হচ্ছে না। আসছে তো টানা। মুশকিল হল, মহারাষ্ট্র রাজপাটে এর বাইরেও একটা পৃথিবী সমান্তরাল ভাবে থাকছে। দুঃখের পৃথিবী। চোরা হতাশার পৃথিবী। আক্ষেপের পৃথিবী।

কুমার সঙ্গকারা-মাহেলা জয়বর্ধনের পার্টনারশিপকে মাত্র তিরিশ রানের জন্য ছুঁতে না পারার আক্ষেপ। বিশ্বরেকর্ড হারানোর দুঃখ। ক্রিকেট এক বলের খেলা, স্বপ্নিল-অঙ্কিত খেললে যে সঙ্গাদের রেকর্ড নিশ্চিত ভেঙে মাঠ ছাড়তেন বলা যায় না, তবু।

মাঠে একজন স্ট্যাটিস্টিশিয়ান থাকলেই তো অনেক কিছু শুক্রবার পাল্টে যেতে পারত। হাজারেদের রেকর্ড ভাঙার পর কে বলতে পারে, সঙ্গকারাদের রেকর্ডও তখন ভেঙে দেওয়া যেত না? দশ বছর আগে কলম্বোয় দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে টেস্টে ৬২৪ রানের পার্টনারশিপ করেছিলেন সঙ্গকারা এবং জয়বর্ধনে। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে আজ পর্যন্ত ওটাই চিরশ্রেষ্ঠ পার্টনারশিপ। যা আজ ভেঙে যেতে পারত, শ্রীকান্ত কল্যাণীর টিমকে কেউ কথাটা বলার থাকলে। কেউ বলেনি। মহারাষ্ট্র টিম সন্ধে পর্যন্ত জানতই না, তিরিশটা রানের জন্য কী অমূল্য সম্পদ তারা ওয়াংখেড়েতে ফেলে এসেছে।

ঠিকই পড়েছেন। ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে ঘটেছে এটা। যাকে ভারতীয় ক্রিকেটের মক্কা বলা হয়।

সন্ধেয় একা অপরাজিত ৩৫১ করা মহারাষ্ট্র অধিনায়ক স্বপ্নিল গুগালে বলছিলেন যে, খেলার সময় কোনও রেকর্ডের কথা তাঁদের মাথায় ছিল না। ‘‘আমি আর অঙ্কিত বলাবলি করছিলাম যে, উইকেটে থেকে যেতে হবে। ব্যাট করতে এখন সুবিধে হচ্ছে। যতটা পারব, রান তুলে রাখব।’’ বলে-টলে বীরেন্দ্র সহবাগের অন্ধভক্তের সহাস্য সংযোজন, ‘‘প্রথম দিকে বীরু পাজির মতো মারব ঠিক করেছিলাম। পরে অঙ্কিত বলল, শান্ত থাক। ওর সঙ্গে ব্যাট করার এটাই সুবিধে। ধৈর্য ব্যাপারটা চলে আসে। এ সব ইনিংসে ধৈর্য রাখাটাই আসল। সত্যি বলতে আমরা জানতামও না কী রেকর্ড করেছি, না করেছি! পরে এসে শুনলাম সব।’’ তাঁর পার্টনার অঙ্কিত, ঘরোয়া ক্রিকেটে ‘ক্রাইসিস ম্যান’ হিসেবে যাঁকে ডাকা হয় তিনিও ফোনে বললেন, ‘‘শুনলাম সঙ্গকারাদের রেকর্ডের ব্যাপারটা। সত্যি, বাজে মিস হয়ে গেল। ডিক্লেয়ার না করলে আমরা ওটা টপকে যেতে পারতাম হয়তো। খারাপ তো লাগছেই। যাক গে, যা করেছি সেটাও কম কী?’’

কম নয় মোটে। কিন্তু আরও বেশি হতে পারত। আর সেটা যে কতটা আক্ষেপবিদ্ধ করছে টিমকে, বাংলাকে আশি-নব্বইয়ের দশকে বহু রঞ্জি ম্যাচ জেতানো শ্রীকান্ত কল্যাণীর কথায় বোঝা যায়।

শ্রীকান্ত এখন মহারাষ্ট্র কোচ। ছাত্রদের নিয়ে যিনি গর্বিত। কিন্তু একই সঙ্গে আবার শোকার্তও। যিনি সন্ধের আগে জানতেনও না সঙ্গাকারাদের কীর্তির কথা। ‘‘আমরা গ্যালারিতে বসেছিলাম। কেউ কিছু বলেনি। আমরা জানতেও পারিনি কী রেকর্ড হচ্ছে, না হচ্ছে। শুধু স্কোরবোর্ডটা পাল্টাচ্ছিল। জানলে কি আর ডিক্লেয়ার করতাম না কি?’’ আক্ষেপ ছিটকে বেরোয় মহারাষ্ট্র কোচের গলা থেকে। ‘‘তিরিশটা রানের জন্য হল না। ইস্। ওরা কিন্তু করে ফেলতে পারত। রঞ্জি রেকর্ড কেন, বিশ্বরেকর্ড হয়ে যেতে পারত।’’

‘পারত’। কিন্তু হয়নি। ঠিক যেমন ভিভিএস লক্ষ্মণ-চেতেশ্বর পূজারাদের ঘরোয়া ক্রিকেটে সর্বোচ্চ রানকে টপকে যাওয়ার সুযোগ ছিল এ দিন স্বপ্নিলের সামনে। ভিভিএসের রঞ্জিতে সর্বোচ্চ ৩৫৩। পূজারার ৩৫২। স্বপ্নিল সেখানে থাকলেন ৩৫১ অপরাজিত। টপকে না যেতে পারার কারণ ওই একই— রেকর্ড সম্পর্কে টিম ম্যানেজমেন্টের ওয়াকিবহাল না থাকা। ওয়াংখেড়ের মতো স্টেডিয়ামে একজনও স্ট্যাটিস্টিশিয়ান না থাকা।

মহারাষ্ট্র কোচ পরে ছাত্রদের সাফল্য প্রসঙ্গে চলে গেলেন। চাইলেন, আজকের কীর্তির পিছনে স্বপ্নিল-অঙ্কিতদের গত দু’মাসের খাটুনিকে তুলে ধরতে। শ্রীকান্ত বললেন, ‘‘ওদের নির্দিষ্ট ডায়েট চার্ট করে দিয়েছিলাম। একটা ওয়ার্ক শিডিউল ছিল। অসম্ভব খেটেছে।’’ সাড়ে তিনশোর মালিক স্বপ্নিলও পরে বললেন, গত রঞ্জি মরসুম ভাল যায়নি মহারাষ্ট্রের। এ বার তা সুদে-আসলে মেটাতে চান। ‘‘দু’টো মাস খুব খেটেছি আমরা। ফিটনেস থেকে শুরু করে টেকনিক্যাল ব্যাপারস্যাপার, কোনওটা ছাড়িনি। আর শ্রীকান্ত স্যরের মতো ভাল কোচ পেয়ে যাওয়ায় সুবিধেও হয়েছে।’’ অঙ্কিত বাওনে— তিনিও আলাদা কিছু বললেন না। শোনালেন, ওয়াংখেড়ে উইকেটে বল প্রথম দিকে খুব মুভ করছিল। টিম ৪১-২ হয়ে গিয়েছিল। সেখান থেকে ইতিহাস। সেখান থেকে অপরাজিত ৫৯৪ রানের ইতিহাস-পার্টনারশিপ। বলছিলেন, ‘‘স্বপ্নিল যা করল, মহারাষ্ট্র ক্রিকেট চিরকাল মনে রেখে দেবে। দারুণ ব্যাটসম্যান। অনেক দূর যাবে।’’

শুনতে ভাল লাগে। কিন্তু আক্ষেপ লুকোতে এ সব বলা নয় তো?

সংক্ষিপ্ত স্কোর: মহারাষ্ট্র ৬৩৫-২ ডি: (স্বপ্নিল ৩৫১ নটআউট, অঙ্কিত ২৫৮ নটআউট), দিল্লি ২১-০।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement