(বাঁ দিকে) মঞ্চে ম্যাগনাস কার্লসেনের সঙ্গে অনীশ। প্রজ্ঞানন্দের কোলে তিন বছরের খুদে (ডান দিকে)। —নিজস্ব চিত্র।
দক্ষিণ কলকাতার এক হোটেলের ছাদে তখন সন্ধ্যা নামছে। সকলেই অধীর অপেক্ষায় ম্যাগনাস কার্লসেন, রমেশবাবু প্রজ্ঞানন্দ, অর্জুন এরিগাইসিদের দেখতে। ঠিক তখনই মায়ের হাত ধরে হাজির সে। কিছু ক্ষণের মধ্যেই তাকে ঘিরে জটলা। তার ছবি তুলতে ব্যস্ত সকলে। ভিড় দেখে নিজেই কিছুটা থতমত খেয়ে গিয়েছিল সে। তিন বছরের অনীশ সরকার ভাবতেও পারেনি কার্লসেন, প্রজ্ঞানন্দদের মাঝে সেই তারকা হয়ে উঠবে। পরের দু’ঘণ্টায় বার বার তার নাম হল। ‘টাটা স্টিল চেস ইন্ডিয়া’ প্রতিযোগিতার উদ্বোধনের মঞ্চে নজর কাড়ল কলকাতার অনীশ। বিশ্বের সর্বকনিষ্ঠ ফিডে রেটিং পাওয়া অনীশকে দেখে অবাক হলেন পাঁচ বারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন কার্লসেনও।
পাঁচ বছর পর কলকাতায় কোনও প্রতিযোগিতা খেলতে নামছেন কার্লসেন। শেষ বার ২০১৯ সালে যখন খেলেছিলেন তখন তিনি বিশ্বচ্যাম্পিয়ন। তার পর অনেক কিছু হয়েছে সাদা-কালোর চৌষট্টি খোপে। বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপ থেকে স্বেচ্ছায় সরে দাঁড়িয়েছেন। আবার শূন্য থেকে শুরু করেছেন। মাঝে প্রজ্ঞানন্দের কাছে হারতে হয়েছে। একই মঞ্চে সেই কার্লসেন ও প্রজ্ঞানন্দই যে সব আলো নিজেদের দিকে টেনে নেবেন সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তা হল কই। উল্টে কার্লসেনরা আসার আগেই তারকা হয়ে উঠল অনীশ। শুরুতেই কোচ দিব্যেন্দু বড়ুয়ার কোলে সে। বাংলার প্রথম গ্র্যান্ডমাস্টার দিব্যেন্দু ব্যস্ত হয়ে পড়লেন নিজের কনিষ্ঠতম ছাত্রকে নিয়ে। সংবাদমাধ্যমের আলো, বুমের মাঝে প্রথমে একটু থতমত খেলেও কিছু ক্ষণের মধ্যেই সামলে নিল অনীশ। ঠিক যে ভাবে এই বয়সেই প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে নিজের ঘুঁটি সামলায় সে।
দিব্যেন্দু বড়ুয়ার কোলে অনীশ। —নিজস্ব চিত্র
চেস ইন্ডিয়া প্রতিযোগিতার প্রথম রাউন্ডের সূচি ঘোষণা হল এই মঞ্চ থেকে। সেখানেও উজ্জ্বল অনীশ। সূচি প্রকাশে ছিল নতুনত্ব। টেবিলের উপর দশটি স্কার্ফ রাখা ছিল। প্রতিটিতে এক জন করে খেলোয়াড়ের নাম লেখা ছিল। পাশে ছিল দশটি বেলুন। তার মধ্যে ১ থেকে ১০ লেখা নম্বর। যাঁর স্কার্ফ উঠছিল, তিনি একটি বেলুন ফাটাচ্ছিলেন। তাতে যে নম্বর লেখা ছিল বোর্ডে তাঁর নাম সেখানে উঠে যাচ্ছিল। এ ভাবেই ১০ জনকে দু’টি গ্রুপে ভাগ করে প্রথম রাউন্ডের সূচি তৈরি হয়েছে। সেখানে ওপেন ও মহিলাদের বিভাগে দু’টি করে স্কার্ফ তুলল অনীশ। মহিলাদের বিভাগে তার হাতে উঠল ভারতের এক নম্বর দাবা খেলোয়াড় কোনেরু হাম্পি ও প্রজ্ঞানন্দের দিদি রমেশবাবু বৈশালীর নাম। আর ওপেন বিভাগে। কার্লসেন ও প্রজ্ঞানন্দের নাম। এক অদ্ভুত সমাপতন। অনীশই ঠিক করে দিল যে পাঁচ বছর পর কলকাতায় খেলতে এসে প্রথম রাউন্ডেই প্রজ্ঞার সামনে কার্লসেন।
শুধু দিব্যেন্দু নন, হাম্পি, কার্লসেন, প্রজ্ঞাদের কোলেও উঠল অনীশ। এত বড় বড় দাবা খেলোয়াড়েরাও মজে খুদেতে। যত বার অনীশ মঞ্চে উঠল তত বার হাততালি দিলেন ওয়েসলি সো, ড্যানিল ডুবভের মতো বিদেশি খেলোয়াড়েরাও। অনীশকে দেখে অবাক কার্লসেন। তিনি বললেন, “আমার চার বছর বয়সি এক ভাইপো আছে। সে দাবা খেলে। কিন্তু ১৫৫০ রেটিং পয়েন্টের কাছেও যায়নি। এই বয়সে এই রেটিং পয়েন্ট পাওয়া অবিশ্বাস্য।” অনীশকে পরামর্শও দিলেন টানা ১১ বছর ধরে বিশ্বের এক নম্বর থাকা কার্লসেন। বললেন, “বাইরের কোনও কথা কানে নেবে না। নিজের উপর চাপ নেবে না। দাবাকে উপভোগ করো। মনের আনন্দে খেলো।”
মাত্র ১২ বছর বয়সে গ্র্যান্ডমাস্টার হয়েছিলেন প্রজ্ঞানন্দ। বিশ্বের সর্বকনিষ্ঠ ইন্টারন্যাশনাল মাস্টার তিনি। সেই প্রজ্ঞাও উচ্ছ্বসিত অনীশকে দেখে। তিনি বললেন, “আমি তিন বছর বয়স থেকেই দাবা খেলছি। কিন্তু এত অল্প বয়সে রেটিং পাওয়া মুখের কথা নয়।” সূচি ঘোষণা হয়ে যাওয়ার পরেও অনীশকে নিয়ে শোরগোল কমল না। কার্লসেনের কাছে সই নিল সে। তার পর দেখা গেল, এক জায়গায় দাঁড়িয়ে আপন মনে দাবা খেলছে অনীশ। তাকে ঘিরে তখনও সংবাদমাধ্যমের ভিড়। সে দিকে নজর নেই খুদের। অনীশ হয়তো তখনও বুঝে উঠতে পারেনি যে কার্লসেন, প্রজ্ঞাদের মঞ্চে দু’ঘণ্টাতেই তারকা হয়ে গিয়েছে সে।
প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়া ২০ জন গ্র্যান্ডমাস্টার। —নিজস্ব চিত্র।
এ বারের চেস ইন্ডিয়া প্রতিযোগিতায় মহিলাদের বিভাগে খেলছেন আলেকসান্দ্রা গোরিয়াশকিনা, ক্যাটেরিনা লাগনো, আলেকসান্দ্রা কস্টেনিয়াক, নানা জাগনিদজ়ে, ভ্যালেন্টিনা গুনিয়া, কোনেরু হাম্পি, রমেশবাবু বৈশালী, হরিকা দ্রোনাবল্লি, দিব্যা দেশমুখ ও বন্তিকা আগরওয়াল। ওপেন বিভাগে খেলছেন ম্যাগনাস কার্লসেন, নোদিরবেক আবদুসাত্তারভ, ওয়েসলি সো, ভিনসেন্ট কেমার, ড্যানিল ডুবভ, অর্জুন এরিগাইসি, রমেশবাবু প্রজ্ঞানন্দ, বিদিত গুজরাতি, নিহাল সারিন ও এসএল নারায়ণন। ১৩ থেকে ১৭ নভেম্বর পর্যন্ত চলবে প্রতিযোগিতা। প্রথম তিন দিন হবে র্যাপিড দাবা। পরের দু’দিন হবে ব্লিৎজ় দাবা। প্রথম রাউন্ডেই মুখোমুখি কার্সলেন ও প্রজ্ঞানন্দ। পাঁচ বছর আগে ২০১৯ সালে এই প্রতিযোগিতা জিতেছিলেন কার্লসেন। তবে এ বার তাঁর সামনে কঠিন চ্যালেঞ্জ। কার্লসেন নিজেই তা স্বীকার করে নিলেন। বললেন, “পাঁচ বছর আগে এরা সকলে বাচ্চা ছিল। তারা এখন বড় হয়ে গিয়েছে। গত কয়েক বছরে ভারতের দাবা আরও উন্নত হয়েছে। আশা করছি এ বার টান টান খেলা হবে।”