নিজে গল্ফার না হলে অন্য কোনও খেলায় দেশের হয়ে অলিম্পিক্সে নামা তাঁর পক্ষে সম্ভব হত না। তাতে তিনি যত ভাল পারফর্মই করুন। আর সেটা সম্ভব হত না ভারতীয় অলিম্পিক্স কর্তাদের কারণে। বিস্ফোরক এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন অনির্বাণ লাহিড়ী। নিজের প্রথম অলিম্পিক্সে ভারতীয় ক্রীড়া প্রশাসকদের কাছ থেকে দেখার পর তাঁদের আচরণকে যিনি সরাসরি ‘দেশদ্রোহিতা’ বলতেও পিছপা হননি।
অনির্বাণ সেনা পরিবারের ছেলে। গর্ব করে বলে থাকেন, তিনি ভারতের ‘ফৌজি সন্তান’। কিন্তু দেশের হয়ে অলিম্পিক্স যুদ্ধ লড়ে ফেরার পর তিনিই চরম হতাশ। এক ওয়েবসাইটকে সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘‘আমাদের দেশে ক্রীড়া প্রশাসন যে ভাবে চলে সেটা সত্যিই দেশদ্রোহিতা।’’ তাঁর কথায়, এ দেশের অলিম্পিয়ানদের লড়াইটা গাড়ির রেসে সাইকেল চালিয়ে জেতার চেষ্টা করার মতো। যে কারণে দীপা কর্মকারকে কুর্নিশ করে বলেছেন, ‘‘বাকিরা ম্যাকলারেন, ফেরারি চালাচ্ছে। আমরা সাইকেলে। যে কারণে দীপা চতুর্থ হওয়ায় আমি অসম্ভব গর্বিত। ওর হাতে সাইকেলই ছিল। কিন্তু ব্যক্তিগত দক্ষতায় ও সাইকেলটাই সুপার উওম্যানের গতিতে চালিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে।’’
নরসিংহ যাদবের প্রসঙ্গ টেনে অনির্বাণ যোগ করেছেন, ‘‘আমি অন্য দেশের এক গল্ফারকে বলছিলাম কী ভাবে নরসিংহের পানীয়ে কেউ নিষিদ্ধ স্টেরয়েড মিশিয়ে ওকে বিপদে ফেলেছে। সেই গল্ফার হতবাক তাকিয়ে থাকার পর আমাকে থামিয়ে বলে, বিশ্বাসই হচ্ছে না। নিজের দেশের অ্যাথলিটের সঙ্গে কেউ এই আচরণ কী করে করে!’’
অলিম্পিক্সের আগে হলে হয়তো অনির্বাণ নিজেও বুঝতেন না। কিন্তু রিওয় অরাজক অবস্থাটা স্বচক্ষে দেখেছেন। কী ভাবে অলিম্পিক্স দলের সাপোর্ট স্টাফ আর কর্মকর্তারা খেলোয়াড়দের নিজেরটা নিজে বুঝে নাও বলে ‘মিনিস্টারসাহেব’-এর পিছনে ঘুরে বেড়িয়েছেন। ‘‘আর আমি কিনা ভেবেছিলাম এঁরা রিও গিয়েছেন খেলোয়াড়দের দেখাশোনার দায়িত্ব পেয়ে!’’ তিক্ততা ঝরেছে দেশের সেরা গল্ফারের গলায়।
অনির্বাণ যা শুনিয়েছেন সেগুলো এই রকম। তিনি রিও পৌঁছচ্ছেন জানার পরেও বিমানবন্দরে গাড়ি পাঠাতে ভুলে গিয়েছিলেন কর্তারা। ট্যাক্সি নিয়ে গেমস ভিলেজ পৌঁছে ঢোকার অনুমতি পাননি টিমের সরকারি গাড়িতে আসেননি বলে। অন্য দেশের গল্ফারদের সঙ্গে কোচ, সহকারী কোচ এবং ফিজিও ছিল। অনির্বাণ বলেছেন, ‘‘আমাদের টিমে শুধু আমি আর শিবশঙ্কর প্রসাদ চৌরাসিয়া আর আমাদের ক্যাডিরা। কোচই নেই, তার আবার ফিজিও।’’ বৃষ্টি আর রিওর বারো-তেরো ডিগ্রি ঠান্ডায় অন্য গল্ফারদের কাছে জাতীয় দলের সোয়েটার, বর্ষাতি থাকলেও ভারতের দুই গল্ফারের ছিল শুধু টি-শার্ট আর ট্র্যাক-টপ। ‘‘ঠান্ডায় ঠকঠক কাঁপতে কাঁপতে ভেজা জামাতেই খেলেছি আমরা। অলিম্পিক্সে নিজের জিনিস পরা যায় না। দেশেটা পরতে হয়। খুব লজ্জা করেছিল।’’
ম্যারাথন রানার ও পি জৈশা দেশে ফিরে তাঁর দৌড়ের সময় টিমের থেকে জল বা খাবারের ব্যবস্থা করেনি বলে অভিযোগ করেছেন। অনির্বাণের কথায় স্পষ্ট, বাকিদের দশাও খুব একটা ভাল ছিল না। জানিয়েছেন, রিওয় ভারতীয় টিমের চিফ মেডিক্যাল অফিসারের দেখা পাননি। শুধু তিনি নন, বেশির ভাগ ভারতীয় অ্যাথলিটকেই চিকিৎসা, ম্যাসাজ বা ফিজিওথেরাপির জন্য লাইন দিতে হয় আন্তর্জাতিক অলিম্পিক্স কমিটির মেডিক্যাল সেন্টারের সামনে।
বীতশ্রদ্ধ অনির্বাণ যোগ করেছেন, ‘‘আমাদের ক্রীড়া সংস্থাগুলো চালাচ্ছে একদল অহং সর্বস্ব লোক। নিজেদের অহংয়ের লড়াইয়ে নরসিংহের মতো খেলোয়াড়কে বলি চড়াতে যাদের বাধে না। নরসিংহের সঙ্গে যা হয়েছে সেটা দেশদ্রোহিতা। এ যেন কুড়ুলের কোপে নিজের পা-টাই কেটে ফেলা!’’
অনির্বাণ মানছেন, ভারতের ক্রীড়া সাফল্যে এ দেশের সিস্টেমের কোনও ভূমিকা নেই। বলেছেন, ‘‘আজ পদক আসেনি বলে সমালোচনা হচ্ছে। পরের বার পঁচিশটা পদক এলেও সেটা হবে ব্যক্তিগত দক্ষতায়, এই সিস্টেমের কারণে নয়।’’ অন্য খেলার ছেলেমেয়েদের লড়াইটা তাঁর মতো পেশাদার গল্ফারের চেয়ে অনেক কঠিন মেনে নিয়ে বলেছেন, ‘‘অন্য খেলা থেকে লড়াই করতে হলে আমার কোনও দিন অলিম্পিক্সে নামা হত না। এই কর্মকর্তাদের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারতাম না। বিশ্বের প্রথম সারির গল্ফারের মতে, ক্রীড়া প্রশাসনে খেলোয়াড়দের না আনা হলে ভারতীয় এই দুর্দশা ঘুচবে না।
তবে হতাশ হলেও জানিয়েছেন, পরের বার টোকিওয় ছ’মাস আগে থেকে নিজে সব বন্দোবস্ত করে নামবেন। ‘‘সমস্ত সরঞ্জাম, সবকিছু নিজে আগে থেকে ঠিক করব। যাতে কিছু অপদার্থ কর্মকর্তার শেষ মুহূর্তের ভুলে আমাদের পদক সম্ভাবনা নষ্ট না হয়।’’ ফৌজি ছেলে সাফ বোঝাচ্ছেন, লড়াই এত সহজে ছাড়বেন না।