স্বাদবদল: ক্রিকেট মাঠ ছেড়ে গল্ফ কোর্সে কার্তিক। নিজস্ব চিত্র
কেকেআরের নতুন অধিনায়ক হিসেবে যখন তাঁর নাম ঘোষিত হয়, কেউ পাত্তাই দেয়নি। এর পরেই শ্রীলঙ্কায় নিদাহাস ট্রফির ফাইনালে তাঁর সেই ৮ বলে ২৯ রানের অবিশ্বাস্য ইনিংস। শেষ বলে ছক্কা মেরে ভারতকে হারা ম্যাচে জিতিয়ে চ্যাম্পিয়ন করা। ব্যস, একটা ইনিংস যেন পাল্টে দিয়ে গেল তাঁর পৃথিবীটাই। তাঁর সেই জাভেদ মিয়াঁদাদ-সুলভ ছক্কা থেকে শুরু করে আইপিএল নেতৃত্ব, টি-টোয়েন্টির রমরমায় ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ কী দাঁড়াতে পারে— সব কিছু নিয়ে আনন্দবাজারের সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় দীনেশ কার্তিক। কলকাতা নাইট রাইডার্সের অধিনায়ক হিসেবে তাঁর প্রথম সাক্ষাৎকার।
প্রশ্ন: ঘরের বাইরে ঘরের অধিনায়ক হওয়ার অনুভূতিটা ঠিক কেমন আপনার কাছে?
দীনেশ কার্তিক: দারুণ। খুবই ভাগ্যবান মনে করছি নিজেকে যে, কলকাতা নাইট রাইডার্স আমাকে অধিনায়ক হওয়ার এই সুযোগটা দিয়েছে। দলের পরিচালন সমিতি ভরসা রেখেছে, গোটা দলের সমর্থনও পাচ্ছি। আর কী চাওয়া থাকতে পারে আমার? এখন সকলে মিলে এগিয়ে চলাটাই
একমাত্র লক্ষ্য।
প্র: আইপিএলে এগিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে কোথায় দাঁড়িয়ে কেকেআর?
কার্তিক: আমরা তিনটে ম্যাচ জিতেছি, তিনটে হেরেছি। অর্থাৎ আমাদের তিনটে দিন ভাল গিয়েছে, তিনটে দিন খারাপ। ভাল দিনগুলোতে আমরা সত্যিই খুব ভাল ক্রিকেট খেলেছি। এই প্রতিযোগিতায় ধারাবাহিকতা দেখানোটা সব চেয়ে জরুরি। সে দিকেই নজর দিচ্ছি।
প্র: প্লে-অফে যেতে গেলে কোন ব্যাপারগুলো গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে?
কার্তিক: কয়েকটা জায়গায় উন্নতি করা প্রয়োজন আমাদের। যেমন ব্যাটিংয়ে প্রথম তিন-চার জনের মধ্যে কাউকে লম্বা ইনিংস খেলতে হবে। ৭৫-৮০ স্কোর করতে হবে কাউকে। ১৮ ওভার মতো খেলে ইনিংসটা গড়তে হবে। ফাস্ট বোলিং বিভাগে উন্নতি করার অনেক জায়গা রয়েছে। তবে সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ফিল্ডিং। এই বিভাগটায় আমরা আরও অনেক উন্নতি করতে পারি।
প্র: কেকেআরের দলে এ বার অনেক তরুণ ক্রিকেটার রয়েছেন। অধিনায়ক হিসেবে তাঁদের নিয়ে কতটা আশাবাদী আপনি?
কার্তিক: দারুণ সব তরুণ প্রতিভা রয়েছে এই দলটায়। প্রত্যেকের ভবিষ্যৎ খুব উজ্জ্বল। সেই কারণে সকলের কাছে একটা আর্জিও জানাতে চাই যে, আপনারা এই ছেলেগুলোকে নিয়ে ধৈর্য ধরুন। ফলের জন্য তাড়াহুড়ো না করে ওদের বেড়ে ওঠার সময়ও দিতে হবে।
প্র: শিবম মাভি দারুণ বল করলেন কিংস ইলেভেন পঞ্জাবের বিরুদ্ধে। ক্রিস গেল বার বার পরাস্ত হচ্ছিলেন ওঁর সুইংয়ে। মাভির মতো তরুণকে আপনি কী উপদেশ দেন?
কার্তিক: প্রত্যেক ব্যাটসম্যানের বিরুদ্ধে আমাদের কিছু পরিকল্পনা থাকে। সেটা ম্যাচে খেলতে নামার আগেই বোলারদের বুঝিয়ে বলা হয়। এর পরেও মাঠে নেমে সেই বোলারকে পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করতে হয়। মাভি সে দিন দারুণ ভাবে সেটা করল। ওর মস্তিষ্কটা বেশ ভাল। দারুণ ফিট, শক্তিশালী। আমার মনে হয়, ভবিষ্যতের রাস্তায় মাভি অনেকের নজর কেড়ে নেবে। আমি আরও একটা ছেলের কথা বলব। শুভমান গিল। যেটুকু সুযোগ পেয়েছে, দারুণ
ব্যাট করেছে।
জুটি: কার্তিকের সঙ্গে তাঁর স্ত্রী স্কোয়াশ তারকা দীপিকা পাল্লিকল।
প্র: দলে আছেন সুনীল নারাইন, আন্দ্রে রাসেলের মতো সিনিয়র ক্রিকেটারও। একইসঙ্গে তারুণ্য এবং অভিজ্ঞতা কী ভাবে সামলাচ্ছেন?
কার্তিক: ওরা সিনিয়র এবং আমার খুব বেশি কথা বলার প্রয়োজনই হচ্ছে না। টি-টোয়েন্টির খুব সফল ক্রিকেটার ওরা। আমার একটাই কাজ। ওদেরকে নিজেদের মনের ভাব প্রকাশ করতে দেওয়া। স্বাধীন ভাবে ওরা যাতে নিজেদের সেরাটা দিতে পারে।
প্র: অধিনায়কত্ব নিয়ে আপনার ভঙ্গি, আপনার দর্শনটা ঠিক কী রকম?
কার্তিক: আমি অধিনায়ক হিসেবে মানুষকে বোঝার চেষ্টা করি। আমার মনে হয়, সতীর্থদের মনের ভাব বা তাদের আবেগ না বুঝলে ভাল নেতা হওয়া যায় না। অধিনায়ককে বুঝতে হয়, কোন টোটকা কার ক্ষেত্রে কাজে লাগতে পারে।
প্র: বলা হচ্ছে, শ্রীলঙ্কায় নিদাহাস ট্রফির ফাইনালের ৮টা বল আপনার জীবনকে পাল্টে দিয়ে গেল। যে ইনিংসে শেষ বলে ছক্কা মেরে আপনি ভারতকে জেতালেন।
কার্তিক: আমি কিন্তু শুধু ওই ৮টা বলই খেলিনি জীবনে। গত পনেরো বছর ধরে আরও অনেক ইনিংস খেলেছি। ক্রিকেট নিয়ে জীবনের সব পরিশ্রম এবং প্রচেষ্টা একত্রিত হয়ে নিদাহাস ট্রফির ফাইনালের ফলটা আমাকে পেতে সাহায্য করেছিল। শ্রীলঙ্কার ফাইনালটা আমার ক্রিকেট যাত্রার অংশবিশেষ। আমার লক্ষ্য, ধারাবাহিক ভাবে সফল হওয়া।
প্র: দশ বছর অতিক্রান্ত আইপিএল সম্পর্কে আপনার কী মূল্যায়ন?
কার্তিক: ভারতীয় ক্রিকেটের জন্য বিরাট আশীর্বাদ হয়ে দেখা দিয়েছে আইপিএল। কী সব ক্রিকেটার বেরোচ্ছে দেখুন! বিশ্বের কোথাও এমন তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক ঘরোয়া ক্রিকেট প্রতিযোগিতা আছে? এখন যে ভারতীয় দল তিন ধরনের ক্রিকেটেই (টেস্ট, ওয়ান ডে এবং টি- টোয়েন্টি) শাসন করছে, তার প্রধান কৃতিত্ব আইপিএলের। প্রত্যেকটা দলে প্রতিশ্রুতিমান তরুণদের পথ দেখানোর জন্য দারুণ সব সিনিয়র তারকা রয়েছে। তাদের পরামর্শে তরুণরা শুরুতেই ক্রিকেট সম্পর্কে সব কিছু জেনে নিতে পারছে। কী ভাবে ম্যাচের জন্য তৈরি হতে হয়, কোন পিচ কেমন আচরণ করে— প্রত্যেকটা বিষয় জেনে যাচ্ছে ওরা। আইপিএল ক্রিকেটের সীমান্ত উপড়ে ফেলছে। ফিল্ডিং এবং ফিটনেসের মান অবিশ্বাস্য ভাবে বেড়ে গিয়েছে। এত প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক একটা প্রতিযোগিতার জন্যই বিভিন্ন দেশে এখন প্রচুর ক্রিকেটার এসে গিয়েছে যারা অনেক তাড়াতাড়ি আন্তর্জাতিক মঞ্চের জন্য তৈরি হয়ে যাচ্ছে।
প্র: ক্রিকেটে আইপিএলের মতো টি-টোয়েন্টি প্রতিযোগিতা কি একটা নতুন পথও তৈরি করে দিচ্ছে?
কার্তিক: টি-টোয়েন্টি লিগকে আর কোনও দেশের পক্ষেই অস্বীকার করার উপায় নেই। সব দেশেই এখন এটা চালু হয়ে গিয়েছে। আমার মনে হয়, ক্রিকেট খেলাটার দিক থেকে খুব আকর্ষণীয় একটা অধ্যায়ের মধ্যে দিয়ে আমরা যাচ্ছি। আগ্রহ নিয়ে বসে থাকব দেখার জন্য যে, এখান থেকে দশ বছর পরে ক্রিকেট কোথায় যায়।
প্র: আপনার কী মনে হচ্ছে, কোন দিকে এগোচ্ছে ক্রিকেট?
কার্তিক: আইপিএল আসার পরে ২০০৮ থেকে ২০১৮— এই দশ বছরে ক্রিকেট কতটা পাল্টে গিয়েছে ভাবুন। ক্রিকেটারদের মনোভাব, শরীরী ভাষা সব পাল্টে গিয়েছে। টি-টোয়েন্টির আগমনে খুব শক্তি-নির্ভর খেলা হয়ে দাঁড়াচ্ছে ক্রিকেট। আগামী দশ বছরে কী পরিবর্তন আসে, সেটা দেখার অপেক্ষায় আছি। অ্যাকাডেমিতেও যদি এখন যান, দেখবেন কিশোররা আইপিএল নিয়ে কথা বলছে, খেলার স্বপ্ন দেখছে।
প্র: আপনার জীবনে অন্যদের প্রভাব নিয়ে বলুন।
কার্তিক: আমি ক্রিকেট খেলি সকলে দেখতে পায়। যেটা দেখা যায় না, সেটা হচ্ছে আমার প্রিয় মানুষগুলোর আত্মত্যাগ। যেমন আমার স্ত্রী দীপিকা (স্কোয়াশ তারকা দীপিকা পাল্লিকল)। ওকে সময় দিতেই পারি না। তার জন্য কোনও অভিযোগ নেই ওর। উল্টে ও-ই আসে নিজের কাজ ফেলে আমার সঙ্গে থাকবে বলে। আমার বাবা-মা কাজ ছেড়ে দিয়েছেন আমার সঙ্গে থাকবেন বলে। আমার ব্যক্তিগত কোচ অভিষেক নায়ার অনেক রাত পর্যন্ত জেগে থাকেন আমার সঙ্গে কথা বলার জন্য। ওঁরা না থাকলে আমি ক্রিকেট খেলতেই পারতাম না।
প্র: খেলার তারকা দম্পতি হওয়ার অভিজ্ঞতাটা কেমন?
কার্তিক (হাসি): আমরা দু’জনেই খেলি ঠিকই। কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে, আমরা খেলা নিয়ে আলোচনাই করি না। দীপিকা মোটেই ক্রিকেটের ভক্ত নয়। আমি স্কোয়াশ দেখতে ভালবাসি, ওর খেলা থাকলে গিয়ে দেখিও। কিন্তু ও ক্রিকেট ভালবাসে না। অল্পস্বল্প বোঝে ঠিকই কিন্তু বেশিক্ষণ ধরে ক্রিকেট দেখা উপভোগ করে না। আমরা খুব সাধারণ দম্পতি, অন্য যে কোনও স্বামী-স্ত্রীর মতোই।
প্র: স্ত্রীর খেলা নিয়ে কখনও কথা বলেন না আপনি?
কার্তিক: না, সাধারণত বলি না। সেই কাজটা ওর কোচেদের ওপর ছেড়ে দিই। মানসিক ভাবে কখনও যদি হতাশ হয়ে পড়ে, আমি চাঙ্গা করার চেষ্টা করি। কিন্তু খেলার বিষয়ে পরামর্শ দিতে যাইনি কখনও। সেটা করতে গেলে নিশ্চয়ই ও খুব হাসবে।
প্র: কলকাতায় এসে নতুন কী করলেন? মিষ্টি-দই খেলেন?
কার্তিক: কোয়েস্ট মলে গেলাম প্রথম বার। বেশ ভাল লেগেছে। আর মিষ্টি খাওয়ার প্রশ্ন নেই কারণ কঠোর ডায়েট মেনে চলতে হয় আমাদের। বিরাট কোহালি আমাকে মেরে ফেলবে যদি শোনে আমি কলকাতায় বসে মিষ্টি খাচ্ছি আর আনফিট হচ্ছি! বর্তমান ভারতীয় দলের ফিটনেস মান বেঁধে দেওয়া হয়েছে অনেক উঁচুতে। হেড কোচ রবি শাস্ত্রী এবং সহকারী কোচেরা ফিটনেস নিয়ে কোনও আপস করতে চান না। ভারতের হয়ে খেলতে গেলে ফিট থাকতেই হবে।
প্র: ডাকওয়ার্থ-লুইস নিয়ে আপনি খুব অখুশি ছিলেন কিংস ইলেভেন পঞ্জাবের ম্যাচের পরে।
কার্তিক: বৃষ্টির পরে যখন ম্যাচটা শুরু হল, পঞ্জাবের কাজটা অনেক সহজ হয়ে যায়। বল-প্রতি-রান করলেই চলবে। আমাদের নিজেদের দেশের একটা নিয়ম আছে— ভিজেডি প্রক্রিয়া (কেরলের ইঞ্জিনিয়ার ভি জয়দেবনের তৈরি করা)। ঘরোয়া প্রতিযোগিতায় সেটা ব্যবহারও করা হয়েছে। আইপিএলের মতো ভারতীয় প্রতিযোগিতায় এক ভারতীয়ের তৈরি করা পদ্ধতিকে কেন ব্যবহার করে দেখব না? ডাকওয়ার্থ-লুইস এমনিতেও তো খুব জটিল প্রক্রিয়া। কেউ কিছু বোঝে না।
প্র: ভারতে উইকেটকিপারের জীবন কেমন? বিশেষ করে যদি কেউ মহেন্দ্র সিংহ ধোনির প্রজন্মের হোন?
কার্তিক: উইকেটকিপারের জীবনটা এমনিতে আম্পায়ারদের মতো। ‘থ্যাঙ্কলেস জব’। মানুষ সব সময় মনে রাখবে ভুলগুলোর জন্য। সেটা মেনে নিয়েই চলতে হবে। আর ধোনিকে নিয়ে বলি, ওর সঙ্গে একসঙ্গে খেলতে পারাটা সৌভাগ্য হিসেবেই দেখি। ধোনির উপস্থিতি আমাকে এমন একটা জায়গায় দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল যে, ব্যাটিংয়ে উন্নতি করতেই হত। জানতাম, সুযোগ পেলে ব্যাটসম্যান হিসেবেই তো পাব। আমি সেই চ্যালেঞ্জটা ভালবেসেছি। পরিস্থিতির দাবি অনুযায়ী, নিজেকে তৈরি করার চেষ্টা করে গিয়েছি।