মেলবোর্নে সেন্ট কিলডা বিচ বাদ দিলে রোম্যান্টিক হাঁটাহাঁটির প্রকৃষ্ট জায়গা সাউথ ইয়ারা। ইয়ারা নদীর দক্ষিণে অনেকটা জায়গা জুড়ে খুব সুন্দর হাঁটার রাস্তা। ফুল, গাছ-গাছালি। নদীর ধার ঘেঁষে রেস্তোরা।ঁ কফিশপ একটু পরপর। গান-বাজনা। পাব। নদীর ধারে বসার বেঞ্চি। কী নেই সেখানে।
ভারতীয় মিডিয়ার একটা বড় অংশকে বুধবার নদীর ধারের সেই বেঞ্চগুলোয় লটবহর সমেত আবিষ্কার করা গেল! বেশির ভাগই টিভি চ্যানেলের সাংবাদিক। কেউ আছেন ছয় ঘণ্টা। কেউ চার ঘণ্টা। কেউ আড়াই। ওই বেঞ্চিগুলো থেকে পনেরো-কুড়ি পা হাঁটলেই টিম হোটেল ল্যাংহ্যাম। এঁদের ওখানে পজিশন নেওয়ার কারণও তাই। যাতে ভারতীয় ক্রিকেটারদের যাওয়া-আসার ভিসুয়্যাল পাওয়া যায়।
ভারতের মাঠে খেলা হলে নিরাপত্তাজনিত কারণে ইলেকট্রনিক মিডিয়াকে সব সময় হোটেলে ঢুকতে দেওয়া হয় না। এ ভাবেই বাইরে তারা অপেক্ষায় থাকে। কিন্তু অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশে, যেখানে নিরাপত্তাজনিত কড়াকড়ি অনেক কম, সেখানে এই জাতীয় অবস্থান নজিরবিহীন। তা-ও টিম পাকিস্তান ম্যাচ জিতে ওঠার পরে।
বিশ্বকাপে ৫-০-য় যা হয়নি তাই হচ্ছে ৬-০-র পরে। এর আগে প্রতি বার পাকিস্তান সংহারের পর প্লেয়ারদের দরজা এক রকম অবারিত থেকেছে ভারতীয় সাংবাদিকদের জন্য। এ বার ধোনির বাধ্যতামূলক সাংবাদিক সম্মেলন (তা-ও ঠিক দশ প্রশ্নের) ছাড়া মিডিয়ার সামনে একজনও আসেননি। প্লেয়ারদের মধ্যে মিডিয়ার সঙ্গে কথা বলা নিয়ে এমন ভীতি ছড়িয়ে গিয়েছে যে চেনা সাংবাদিক দেখলেও তাঁরা প্রকাশ্যে কথা বলতে ভয় পাচ্ছেন।
সুরেশ রায়না আর রবীন্দ্র জাডেজা এ দিন গল্প করতে করতে ইয়ারার ধার দিয়ে হোটেল ফিরছিলেন। হঠাৎ খেয়াল করেন, টিভি চ্যানেলের লেন্স তাঁদের দিকে তাক করে রয়েছে। দ্রুত সার্কলের মধ্যে ফিল্ডিং করার ক্ষিপ্রতা দেখিয়ে তাঁরা অন্য রুট নিয়ে নেন। হোটেলের যে দিকটা মিডিয়া নেই। রায়না বা জাডেজাকে নিয়ে তো তবু বিতর্ক রয়েছে। অজিঙ্ক রাহানের মতো নির্বিরোধী প্লেয়ারও মুখ খুলতে ভয় পাচ্ছেন।
পাকিস্তান ম্যাচের মতো মর্যাদাব্যঞ্জক যুদ্ধ জিতে উঠে টিম ডিরেক্টর রবি শাস্ত্রী এবিপিকে দেওয়া ইন্টারভিউয়ের বাইরে সবার মুখ শুধু বন্ধ নয়। আই টু আই কন্ট্যাক্টও এক এক জন এড়িয়ে চলছেন। বিশ্বকাপ অংশগ্রহণকারী বাকি তেরো দেশের টিম আর মিডিয়ার মধ্যে কোথাও এমন তিক্ত সম্পর্ক নেই।
এঁদের সাক্ষাৎকার পাচ্ছে একমাত্র স্টার স্পোর্টস। কিন্তু সেটা তারা অফিশিয়াল ব্রডকাস্টার বলে। এটা যদি আইপিএল হত যেটা দেখায় সোনি, তা হলে স্টারের প্রতিনিধিকেও নদীর ধারের বেঞ্চিতে বসতে হত!
অনেক টিম আছে যেখানে মিডিয়ার সঙ্গে অধিনায়কের সম্পর্ক ভাল নয়। সেখানে কোচ সমস্যাটা বুঝে মিডিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক রেখে দেন। যাতে দু’পক্ষে পুরো ব্রেকডাউন না হয়ে যায়। সেরা উদাহরণ অস্ট্রেলিয়া। যেখানে মাইকেল ক্লার্কের সঙ্গে বিবিএম যোগাযোগ এক-আধজনের বেশি না থাকতে পারে কিন্তু ডারেন লেম্যান প্রত্যেককে নামে চেনেন। প্রত্যেককে অস্ট্রেলীয় কোচ সময় দেন।
ভারতীয় দলে সেটারও উপায় নেই। কোচ ডানকান ফ্লেচার দায়িত্ব নিয়েছেন ২০১১ বিশ্বকাপের পর থেকে। এই ক’বছরে সাকুল্যে তিন-চারটে সাংবাদিক সম্মেলন ছাড়া কাউকে হাই-হ্যালোও বলেননি। তিনি সম্ভবত বিশ্বের একমাত্র ক্রিকেট কোচ যিনি চার বছরের টার্ম শেষ করে বিশ্বকাপের পর ছাঁটাই হবেন একটা রেকর্ড করে। কী না, ইন্টারভিউ দূরে থাক একটা উদ্ধৃতিও ভারতীয় মিডিয়াকে দেননি। শোনা যায় তাঁর চাকরির শর্ততেই আছে মিডিয়া থেকে দূরে থাকতে হবে।
সিনিয়র সাংবাদিকদের কারও কারও মনে হচ্ছে, এ তো এক পক্ষ জলে আর এক পক্ষ স্থলে এতটা প্রকৃতিগত তফাত হয়ে গিয়েছে। কারও কারও আবার মনে হচ্ছে তিক্ত সম্পর্ক বললে তো তবু একটা সম্পর্ক বোঝায়। এখানে তো কিছুই নেই। কেউ কারও সঙ্গে কথাই বলে না।
প্লেয়ারদের তরফে সেন্টিমেন্ট হল ইলেকট্রনিক মিডিয়ার একাংশের বিরুদ্ধে ক্ষোভ আর তা থেকে গোটা মিডিয়াকুলকেই বর্জন করা। এতে সবচেয়ে মদত রয়েছে স্বয়ং শ্রীনিবাসনের। তিনি মিডিয়ার আক্রমণে নিজে এত জর্জরিত যে চান না টিম মিডিয়ার কাছাকাছি যাক। শ্রীনি-মডেলটাই চাঁছাছোলা ভাবে অনুসরণ করেন ধোনি।
ভাবাই যায় না যে পাকিস্তান ম্যাচ হারার পরেও তার প্লেয়াররা পরিচিত সাংবাদিকদের সঙ্গে অন্তত ব্যক্তিগত ভাবে কথা বলছে। মিসবা বা ওয়াকার কাউকে আটকাচ্ছেন না। আর এখানে জিতে ওঠা টিম কভার করতে গিয়ে দেশজ সাংবাদিকদের আশ্রয় নদীর ধারের বেঞ্চি!