মঙ্গলবারের চিন্নাস্বামী। ছবি: বিসিসিআই
পাগলের মতো ছুটে এসে মহানায়কের বুকে মুখ গুঁজে দিচ্ছেন তিনি, প্রাণপণ শক্তিতে সতেরো নম্বর জার্সিকে জড়িয়ে ধরছেন আঠারো নম্বর। চোখের কোণে কি ভেজা মুক্তো? টলটলে কয়েকটা বিন্দু? গবেষণার সময় পাওয়া গেল না। কারণ সস্নেহ হাতটা ততক্ষণে উঠে এসেছে, ঘেঁটে দিচ্ছে চুল, পিঠে-মাথায় আদর করে চলেছে পরম মমতায়।
আঠারো আদর করছে। আদর করছে সতেরোকে।
আঠারো নম্বর কে, আজ আর আলাদা করে বলতে হয় না। তাঁর স্বর্গীয় আবেগ, শিশুসুলভ লম্ফঝম্ফ, যৌবনের তেজে উত্তেজিত হয়ে পড়া, যে কোনও কিছু নিয়ে অকপট স্বীকারোক্তি ভারতীয় ক্রিকেটে খুব চেনা, খুব পরিচিত হয়ে গিয়েছে। একশো দশ কোটির ভারতবর্ষ এখন জানে, বিরাট কোহালি নামক ব্যক্তিত্ব যে দিন যেখানে থাকবেন, কিছু না কিছু ঘটাবেন। রোজ এমন কিছু না কিছু ঘটাবেন, যা আগে ক্রিকেট দেখেনি। রোজ এমন কিছু দৃশ্যপট সৃষ্টি করে যাবেন, যা যে কোনও আর্ট গ্যালারি নিজেদের হল অব ফেমে রেখে দিতে পারবে।
কিন্তু সতেরো নম্বর জার্সি? আব্রাহাম বেঞ্জামিন ডে’ভিলিয়ার্স? তাঁকে তো এত দিন দেখা যায়নি আবেগের মহাসমুদ্রে নিজেকে এতটা ভিজিয়ে নিতে। আজও প্রতিক্রিয়াহীন ছিলেন একটা সময় পর্যন্ত। অসম্ভব একটা প্রাচীরকে একক প্রতিভায় গুঁড়িয়ে হেলমেট খুলে দাঁড়িয়ে যখন ছিলেন তিনি, ঘাড়ে যখন উঠে পড়ছিল একের পর এক সতীর্থ, কোথায় তখনও তো না! কিন্তু অধিনায়ককে দেখামাত্র কোনও জাদুমন্ত্রে যেন সব পাল্টে গেল।
তার পরই চুল ঘেঁটে দেওয়া। তার পরই গায়ে-মাথায় বুলিয়ে দেওয়া হাত। একে একে সব!
ক্রিকেট আজ পর্যন্ত প্রচুর স্মরণীয় জুটিকে জন্ম নিতে দেখেছে। কী ব্যাটিংয়ে। কী বোলিংয়ে। সচিন তেন্ডুলকর-সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। ওয়াসিম আক্রম-ওয়াকার ইউনিস। মাহেলা জয়বর্ধনে-কুমার সঙ্গকারা। নিখাদ ক্রিকেটীয় বিচারে এঁরা, এঁদের জুটি নিঃসন্দেহে স্মরণীয়, ক্রিকেটীয় রাজকোষে সসম্মানে জমিয়ে রাখার মতো কোহিনুর। গভীর বন্ধুত্ব, সেটাও কোনও কোনও জুটিতে ছিল। কিন্তু এমন নিঃসঙ্কোচে একজনের অন্য জনকে বিশ্বের সেরা ব্যাটসম্যানের তাজ মুহুর্মুহু তুলে দেওয়া, একজনের তাণ্ডবে অন্য জনের প্রতিক্রিয়া ধরতে হোস্ট ব্রডকাস্টারের এমন তীব্র আকুতি, পৃথিবীর সমস্ত প্রেমিক-প্রেমিকার কাছে টিভি কমেন্টেটরের এমনই ভালবাসার প্রার্থনা করে যাওয়া— কোথায় ক্রিকেট তো এত দিন দেখেনি এ সব। আর ঠিক এখানেই বোধহয় বিরাট কোহালি-এবি ডে’ভিলিয়ার্সের পার্টনারশিপ স্বতন্ত্র। যে পার্টনারশিপ বাইশ গজে শুধু নয়, বাইশ গজের বৃত্তের বাইরেও সমান চলে। যেখানে ক্রিকেট, আবেগ, শ্রদ্ধা, সম্মান সব একাকার হয়ে যায়।
ধন্য, বিরাট কোহালি। ধন্য, এবি ডে’ভিলিয়ার্স। ধন্য, তাঁদের ক্রিকেট-ব্রোমান্স! মঙ্গলবারের বেঙ্গালুরু ক্রিকেট দর্শক শুধু সাউথ আফ্রিকান উইজার্ডের অনির্বচনীয় ক্রিকেট-প্রতিভা দেখল না। হৃদস্পন্দন বন্ধ করে দেওয়ার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি করে মহানাটকীয় জয় তুলে টিমের ফাইনালে পদার্পণ— না, সেটাও দেখল না। দেখল, এক অসামান্য ক্রিকেট-জুটির দেড় ঘণ্টা ধরে একে অন্যের জন্য আপ্রাণ লড়ে যাওয়া।
মাঠে এবি ডে’ভিলিয়ার্স।
মাঠের বাইরে বিরাট কোহালি।
রাতে বেঙ্গালুরুতে যা চলছিল, তার মধ্যে ম্যাচ রিপোর্ট লেখা এক কথায় দুঃসাধ্য। গ্যালারির তীব্র শব্দব্রহ্মকে শিশুতে রূপান্তর করে বাজি ফাটছে একের পর এক, কালো আকাশ সযত্নে সাজিয়ে দিচ্ছে আতসবাজির অনন্ত রোশনাই। কিন্তু একটা সময় মনে হচ্ছিল, বোধহয় অভিশপ্ত এক রাতের কথা লিখতে হবে। যেখানে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মুখ্যমন্ত্রীত্ব ছেড়ে দেওয়ার মতোই অকল্পনীয় ভাবে বিরাট কোহালি শূন্য রানে আউট। আইপিএল নাইনে এই প্রথম। গুজরাত লায়ন্সকে মাত্র ১৫৮ রানে আটকে রেখেও আরসিবি ২৯-৫! বিরাট নেই, গেইল বোল্ড, ওয়াটসন কট, শুধু এবি। কিন্তু তাঁর একার পক্ষে কতটা সম্ভব হবে? একশোর উপর তো এখনও চাই। আর তার চেয়েও ভয়ঙ্কর ধবল কুলকার্নিকে আচমকা গ্লেন ম্যাকগ্রা মনে হচ্ছে!
চিন্নাস্বামী দর্শকের মতো চিন্নাস্বামী প্রেসবক্স ধরে নিয়েছিল যে, ম্যাচ শেষ। হার শুধু সময়ের অপেক্ষা। বোঝা যায়নি, ম্যাচটা শেষ নয়, সবে তখন শুরু হল।
আইপিএলে ৪৭ বলে অপরাজিত ৭৯ রানের যে ইনিংসটা এবি এ দিন খেলে গেলেন, তা তাঁর খেলা সেরা টি-টোয়েন্টি ইনিংসের প্রথম দুইয়ে নিশ্চিত থাকবে। প্রবীণ কুমারকে মারা তাঁর চকিত রিভার্স সুইপ, জাকাতিকে সুইপে ফাইন লেগ দিয়ে গ্যালারিতে ফেলে দেওয়া ইম্প্রোভাইজেশনের দেরাজে সযত্ন রাখা থাকবে। কিন্তু মঙ্গলবারের মতো বোধহয় ডে’ভিলিয়ার্সের অকল্পনীয় সব শটের গরিমা চাপা পড়বে এবি-ভিকে যুগলবন্দির কাছে। এবি-র একটা ছক্কা উড়ে যাওয়ার পর দেখা গেল, প্যাড পরা বিরাট কোহালি তীব্র চেঁচাতে চেঁচাতে ডাগআউটের বাইরে চলে এসেছেন। উত্তেজনায় লাফাচ্ছেন! আর এক বার এবি-র বাউন্ডারি লাইন পেরোল না, তার আগেই কোহালি আবির্ভূত। ছবি সেই এক। বড় বড় চোখ। উত্তেজিত গ্রীবা। দাঁতমুখ খিঁচিয়ে চিত্কার। আসলে আবেগের বিরাট বিস্ফোরণ অনেকক্ষণ ধরেই চলছিল। স্টুয়ার্ট বিনিকে সন্দেহজনক এলবিডব্লিউ দেওয়ায় সোজা ফোর্থ আম্পায়ারের কাছে গিয়ে দরবার করতে লাগলেন। পরে তো মাঠেই ঢুকে গেলেন স্ট্র্যাটেজিক টাইমআউটে। আর হ্যাঁ, টাইমআউটে আর একটা ব্যাপার নিয়ম করে করছিলেন। এবি-র সঙ্গে কথাটথা বলে তাঁর পিঠ বারবার চাপড়ে আসা।
আগামী রবিবার এখানে আইপিএল ফাইনাল। টানা পাঁচ ম্যাচ জেতা আরসিবি যেখানে খেলবে। যেখানে ‘ল অব অ্যাভারেজের’ রাহুগ্রাস কাটিয়ে কোহালি আবার অপেক্ষা করবেন তাঁর কুঠার নিয়ে। কিন্তু এ দিনের রূপকথা দর্শনের পর মনে হচ্ছে, প্রতিপক্ষকে জিততে হলে শুধু কুঠারাঘাতকে হারালে চলবে না। হারাতে হবে ক্রিকেটের এই নবতম রসায়নকেও। কিন্তু সেটা করবে কে?
ক্রিকেটের আধুনিক ডনকেই ধরা যায় না, তো আবার ডন টু!
সংক্ষিপ্ত স্কোর
গুজরাত লায়ন্স ২০ ওভারে ১৫৮ (স্মিথ ৭৩, ওয়াটসন ৪-২৯)
রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরু ১৮.২ ওভারে ১৫৯-৬ (ডে’ভিলিয়ার্স ৭৯ ন.আ, ধবল ৪-১৪)।