মোহনবাগান তাঁবুতে অমল দত্তকে শেষ শদ্ধা জানাচ্ছেন কোচ সঞ্জয় সেন। ছবি: উৎপল সরকার।
একটা সময়ের পর থেকে নিজেকে ক্রমশ গুটিয়ে নিচ্ছিলেন। মাঠ থেকে অনেক দূরে বাগুইআটির দোতলা বাড়ির ওই একতলাটাই তখন যেন হয়ে গিয়েছিল তাঁর জীবন। ছটফট করতেন। মাঠ যে টানত! কিন্তু, যেতে পারতেন না। শরীর দিত না যে! ভুলে যেতেন সব কিছু। কখনও কখনও খুব পরিচিতদেরও চিনতে পারতেন না। শেষ কয়েকটা মাস কেটেছে বিছানায়। যত দিন জ্ঞান ছিল, ময়দানের লোক দেখলে আনন্দে আত্মহারা হয়ে যেতেন। ছাড়তেই চাইতেন না। শুধু গল্প গল্প আর গল্প।
পুরনো স্মৃতি ঘুরে ফিরে চলে আসা। কখনও বলতে বলতে খেই হারিয়ে ফেলতেন। হাতড়ে বেড়াতেন পুরনো স্মৃতি। সেই সাফল্য, ব্যর্থতার গল্প। মনে করতে পারতেন না। কষ্টে ছটফট করতেন। সেই অমল দত্ত চলে গেলেন সবার অলক্ষ্যেই। অনেকটাই একা। স্ত্রীর গয়না বিক্রি করে এক দিন বিদেশে কোচিং শিখতে গিয়েছিলেন। তখন ফুটবলে টাকা কোথায়? কথায় কথায় সব সময় বলতেন। তবুও থেমে জাননি। বাংলার ফুটবলকে পেশাদার করে বিদায় নিলেন ৮৬ বছর বয়সে।
এই প্রজন্মের কাছে অমল দত্ত লিজেন্ড। তাঁকে সামনে থেকে কেউ দেখেননি। তবুও বাবার কাছে, দাদুর কাছে অনেক বার শোনা একটা নাম। রবীন্দ্র সদন প্রাঙ্গণে ইতস্তত ঘুরে বেড়ানো এই প্রজন্মও দাঁড়িয়ে পড়ছিল অমল দত্তকে এক ঝলক দেখার জন্য। কিন্তু কোথাও একটা হাহাকার যেন থমকে দাঁড়াল তাঁর শেষযাত্রায়। কোথায় গেল অমলের সেই ডায়মন্ড টিম? কোথায় গেলেন সেই সব ছাত্রেরা। দেখা গেল না হেমন্ত ডোরা, অলোক দাস, বাসুদেব মণ্ডল, দেবজিৎ ঘোষ বা ষষ্ঠী দুলেদের কাউকে। একমাত্র সত্যজিৎ চট্টোপাধ্যায় ছাড়া প্রায় কেউই ছিলেন না ‘অমল স্যার’-এর পাশে।
১৯৯৭-এর সেই ডায়মন্ড দল, ভারতীয় ফুটবলে যা সাড়া ফেলে দিয়েছিল। সাফল্য যে খুব একটা এসেছিল, তেমন নয়। কিন্তু ১৯ বছর আগে ভারতীয় ফুটবলে তিনি যা শুরু করেছিলেন, আজ সেটা অনেক সময়ই দেখা যায় বিশ্ব ফুটবলে। কিন্তু প্রাপ্য সম্মান পেলেন কি তিনি? শেষবেলায় যেন ঘুরে ফিরে এল এ কথাটাই। সবাই যে এককথায় বলে দিলেন, ‘‘অমলদা প্রাপ্য সম্মানটা যে পেলেন না।’’
সরকারি তরফে এলাহি আয়োজন ছিল বাংলার প্রথম পেশাদার কোচকে শেষ সম্মান জানাতে। কিন্তু, তার সিকি ভাগও দেখা গেল না প্রাক্তন ফুটবলারদের মধ্যে। যদিও চুনী গোস্বামী, প্রশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়, বাবু মানি, সত্যজিৎ চট্টোপাধ্যায়, সমরেশ চৌধুরী, শ্যাম থাপা, মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য, সুরজিৎ সেনগুপ্ত, মিহির বসু, অলোক মুখোপাধ্যায়, নঈমুদ্দিনের মতো প্রাক্তনেরা এসেছিলেন শেষ শ্রদ্ধা জানাতে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যখন জানিয়ে দিলেন, ‘অমল দত্তর নামে রাস্তা, স্টেডিয়াম হবে এই বাংলার বুকে’ ঠিক তখনই প্রশ্ন তুলেদিলেন চুনী গোস্বামী। বলছিলেন, ‘‘অমলদার যে সম্মান প্রাপ্য ছিল সেটা তিনি পাননি। দ্রোণাচার্যের মতো সম্মান পাওয়া উচিত ছিল এই মানুষটার।’’
ভারতীয় ফুটবলের আধুনিকতার জনক কী পেলেন তা হলে?
শেষযাত্রায় যে দেখা গেল না উপচে পড়া মানুষের ঢল। সব থেকে বেশি সাধারণ মানুষের ভিড় দেখা গেল মোহনবাগান ক্লাব তাঁবুতে। মোহনবাগান কর্তাদের কাঁধে চেপেই ক্লাব তাঁবু থেকে বেরিয়ে চলে গেলেন নিমতলায়। যেখানে গান স্যালুট দিয়ে বিদায় জানানোর কথা রবীন্দ্র সদনেই ঘোষণা করে দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। তবুও ক্ষোভ থেকে গেল অনেকটা। অমল দত্তর আর এক ছাত্র প্রশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়ও সেই একই প্রশ্ন তুলেদিলেন শেষবেলায়— ‘‘ভারতীয় ফুটবলের আধুনিকতার জনক হিসেবে ন্যায্য মূল্যায়ণটাই তো হল না।’’ তাঁর সব থেকে কাছের ছাত্র সত্যজিৎ চট্টোপাধ্যায় শেষযাত্রায় পুরোটাই সঙ্গে ছিলেন। ছোট ক্লাব থেকে তুলে এনে মোহনবাগানের হয়ে বড় আসরে নামিয়ে দেওয়ার মতো ভরসা রেখেছিলেন তাঁর উপর। আজ সেই স্মৃতির কথা বলতে গিয়ে অনেকটাই নস্টালজিক ময়দানের সত্য। ডায়মন্ড দলের একমাত্র সদস্য এ দিন ফিরে গেলেন ১৯৯৭-এ। বললেন, ‘‘ময়দানের গাছের তলায় শুয়ে ছিলেন। হঠাৎই আমাকে ডেকে শোনালেন তাঁর ডায়মন্ড সিস্টেম আবিষ্কারের কথা। তার পরটা তো ইতিহাস। আমার ময়দানের অভিভাবক আমার বাবার মতো ছিলেন তিনি।’’
গ্ল্যামার থেকে অনেকটা দূরে থেকেও ভারতীয় ফুটবলকে সমৃদ্ধ করে গিয়েছেন অমল দত্ত। শেষ বয়সে সব স্মৃতি মুক্ত হয়ে গিয়েছিলেন তিনি। স্মৃতিগুলো আর যন্ত্রণা দিত না। কিন্তু রেখে গেলেন অনেক ময়দানি গল্প, অনেক রূপকথা, যা বাংলাদের ফুটবলকে দিয়ে গিয়েছেন তিনি। ইস্টবেঙ্গল ও মোহনবাগান ক্লাবে আজ অর্ধনমিত থাকল পতাকা। দুই ক্লাবেই কর্তারা ছিলেন শেষ সম্মান জানাতে। পিকে বন্দ্যোপাধ্যায় যেমন, মাঠের চিরাচরিত লড়াইয়ের বাইরের বন্ধুত্বের কথাটাই বলে গেলেন এ বেলায়— ‘‘আমাদের মাঠের লড়াইটাই সবাই জানে। কিন্তু তার বাইরে আমরা ছিলাম দাদা-ভাই, আমরা ছিলাম বন্ধু। আমি স্বজন হারালাম।’’
অমল দত্তর সঙ্গেই শেষ হয়ে গেল একটা যুগের।
আরও খবর
কোচ অমল থেকে যাবেন বাংলার ফুটবলে