তেইশ বছর আগের যুগ্ম নায়ক এ বার ইচ্ছাকৃত দূরে দূরে

তেইশ বছর আগে তো কী! এ বারের কাপ থেকে ইচ্ছাকৃত দূরে থাকছেন তো কী! শুধু অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডে হওয়া শেষ বিশ্বকাপ নয়, কাপ ইতিহাসই তো লেখা সম্ভব নয় ওঁদের দু’জনকে বাদ দিয়ে।

Advertisement

গৌতম ভট্টাচার্য

অ্যাডিলেড শেষ আপডেট: ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০৩:৫৬
Share:

তেইশ বছর আগে তো কী! এ বারের কাপ থেকে ইচ্ছাকৃত দূরে থাকছেন তো কী!

Advertisement

শুধু অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডে হওয়া শেষ বিশ্বকাপ নয়, কাপ ইতিহাসই তো লেখা সম্ভব নয় ওঁদের দু’জনকে বাদ দিয়ে।

আর বিরানব্বইয়ের বিশ্বকাপের প্রধান রূপকার তো তাঁরাই। ইমরান খান আর মার্টিন ক্রো। এক জন কাপ হাতে তুলেছেন। অন্য জন সেমিফাইনাল হেরে গিয়েছেন। কিন্তু তাঁদের পরম্পরা হার-জিতের ঊর্ধ্বে উঠে আজও ওয়ান ডে গঠনতন্ত্রকে শাসন করে চলেছে।

Advertisement

শুক্রবার তাঁর নিউজিল্যান্ডের বাড়িতে ফোনে ধরা হলে ক্রো বললেন, “তেইশটা বছর অনেক আগের কথা। এখন আর মাথায় আনতেও চাই না।” এ বার সেপ্টেম্বর মাসে তিপ্পান্ন বছর বয়স হবে তাঁর। কিন্তু ফোনে গলা শুনে মনে হবে তিরাশি। চিনতেই পারিনি তাঁর গলা। আসলে টার্মিনাল ক্যানসারে এমনই জরাজীর্ণ যে, বছরটা কাটবে কি না, তা-ও কেউ জানে না।

দীপক পটেলের মতো স্পিনারকে দিয়ে বোলিং ওপেন করানো আবার প্রথম বল থেকেই গ্রেটব্যাচকে দিয়ে ঝড় তোলা— দুটোই ক্রোর আইডিয়া ছিল। পরে যা যুগান্তকারী আখ্যা পেয়েছে। কারণ কম-বেশি সব টিম তা থেকে টুকেছে। ইমরান সে বারই চাপের মুখে ধূর্ত একটা চাল দেন যার প্রভাব আজও সুদূরপ্রসারী। আক্রমকে বলেছিলেন, “ওয়াইড, নো বল নিয়ে ভেবো না। রান চেক করার কথা ভেবো না। আমার উইকেট চাই।”

মার্ক টেলর সে দিনও বলছিলেন এটাই হবে এ বারের বিশ্বকাপে টিমগুলোর মডেল— “রান আটকাতে যেও না। বিপক্ষের উইকেট নেওয়ার কথা ভাবো। ইমরান এটা আমাদের সবাইকে শিখিয়ে গেছে যা আজও ধ্রুব সত্য।” কিন্তু খোদ ইমরানকে পাওয়া সম্ভব নয় এ বারের বিশ্বকাপ নিয়ে কথা বলার জন্য। অন্য বারের মতো টিভি শো, কলাম লেখা কিছুই করছেন না। স্বদেশীয় সাংবাদিকদের তীব্র জোরাজুরি সত্ত্বেও ভারত-পাক ম্যাচ নিয়ে মুখ খোলেননি। সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ পাক সাংবাদিককেও বলছেন, “আমাকে ছেড়ে দিন। আমি আর ক্রিকেটের খবরই রাখি না।” সাংবাদিকেরা অবশ্য নাছোড়বান্দা। একটু তো কিছু বলবেন। ইন্ডিয়া ম্যাচ বলে কথা। তা ছাড়া আপনি হলেন অস্ট্রেলিয়ায় কাপ জেতা অধিনায়ক।

মার্টিন ক্রো অবশ্য জানালেন, পীড়াপীড়ির কোনও ব্যাপার নেই। তিনি শারীরিক ক্লান্তিতে এত বিপর্যস্ত যে, এই ফোনটা ছেড়ে কানেকশনটাই অফ করে দেবেন। দিনে নাকি চোদ্দো ঘণ্টা করে ঘুমোন। গত জানুয়ারিতে ওয়েলিংটন মাঠে তাঁকে পাওয়া গেছিল। কেমোথেরাপিতে চুল পুরো উঠে যাওয়া শ্রান্ত এক মানুষ। যিনি জীবনের শেষ স্টেশনের গাড়ি ধরার বিষণ্ণ অপেক্ষায়। টুকটাক দু’একটা অনুষ্ঠানে যান। আইসিসির তিনি ব্র্যান্ড অ্যাম্বাস্যাডরও। তা হলে কালকের উদ্বোধনীতে তাঁকে দেখা গেল না কেন?

ক্রো বললেন, “ইচ্ছে করে যাইনি।” পরের ম্যাচগুলোয় যাবেন? ক্রো বলেন, “মনে হয় না। এ বারের বিশ্বকাপই দেখতে যাওয়ার ইচ্ছে নেই।” কেন? কারণ বুঝলাম না। সম্ভবত অসুস্থতাই কারণ।

সবিস্তার জানতে ক্লিক করুন।

ইমরানের সঙ্গে তফাত হল, ইমরান যেমন ক্রিকেটের খবর রাখতেই আর ইচ্ছুক নন, ক্রো তা নন। সব খবর রাখেন। তাঁর যে মনে হচ্ছে বিশ্বকাপে ভারতের যথেষ্ট আশা নেই, সেটাও খোলাখুলি বলে দিলেন। ক্রোর ফেভারিট টিম দক্ষিণ আফ্রিকা। কিন্তু এর বাইরে কিছু বলতে রাজি নন। বললেন, “নেটে আমার কলামটা দেখে নিন।”

ইমরান দ্বিতীয় বিয়ের পর বোধহয় আরও মিডিয়া থেকে দূরত্ব বাঁচিয়ে চলছেন। তাঁর ইসলামাবাদ মোবাইল প্রায় সর্বক্ষণ বন্ধ। ঘনিষ্ঠরা জানালেন, পেশোয়ারে স্কুল-ছাত্রদের নৃশংস তালিবানি হত্যার পরিপ্রেক্ষিতে ঠিক করেছিলেন বিয়ের খবরটা ঠিক চল্লিশ দিন বাদে জানাবেন। কিন্তু তার মধ্যে খবরটা কোনও ভাবে ফাঁস হয়ে নেটে তাঁর নতুন বিবি রেহাম খান সম্পর্কে নানান কুৎসা রটা শুরু হয়। সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটের এই অপ্রত্যাশিত অত্যাচার থেকে নতুন স্ত্রীকে রক্ষার জন্য তিনি বিয়ের কথা স্বীকার করতে বাধ্য হন। এই সবেরই মধ্যে পাকিস্তান বোর্ড বারবার তাঁকে অনুরোধ করতে থাকে, পাকিস্তান টিম অস্ট্রেলিয়া রওনা হওয়ার আগে তিনি যেন মিসবার ছেলেদের উৎসাহ দেন। ইমরান রাজিও ছিলেন। কিন্তু ইসলামাবাদ ছেড়ে তাঁর পক্ষে লাহৌর যাওয়া সম্ভব নয় জানান। তখন কথা হয় পুরো টিম তাঁর সঙ্গে রাজধানীতে এসে দেখা করবে, কিন্তু কুয়াশার জন্য তখন সকালের ইসলামাবাদ ফ্লাইট টানা ক’দিন উড়তেই পারেনি। ফলে টিমের সঙ্গেও আর ইমরানের দেখা হয়নি। আগের বার মোহালি বিশ্বকাপ ম্যাচের প্রাক্কালে দুটো টিমকেই ইমরানের পরামর্শ ছিল, চাপ হজম করার জন্য স্লিপিং ট্যাবলেট খেয়ে ঘুমোও আর টিকিটপ্রার্থীদের দূরে রাখো। এ বার এই পর্যন্ত কোনও কাপ-পরামর্শ তাঁর থেকে অনুপস্থিত। যদি কিছু বলেনও, সেটাও নিতান্ত অনিচ্ছার সঙ্গে বলবেন। রাজনীতির ওপারে নতুন করে তিনি ক্রিকেট মাঠ দেখতে চান না।

ক্রো আবার এই অসুস্থতার মধ্যেই নিজের কলামে কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে সম্ভাব্য ম্যাচের ফল-সহ তালিকা করে দিয়েছেন। শুনলাম আর জীবনের শেষ ক’টা দিন কেমো না করাবার সিদ্ধান্ত নিজেই নিয়েছেন। বলেছেন, “লিম্ফোমাকে হারাবার বহু চেষ্টা করেও পারলাম না। এ এক সাঙ্ঘাতিক প্রতিপক্ষ।”

এমন যন্ত্রণার মধ্যেও কী করে বিশ্বকাপের সব ম্যাচ তিনি আগাম বিশ্লেষণ করেছেন, ভাবাই যায় না। দশ জনে সাড়ে নয় জন এমন পরিস্থিতিতে কোনও কিছুতে মন দিতে পারত না। কিন্তু বিরানব্বই বিশ্বকাপে ৫৫ গড় নিয়ে শেষ করা অধিনায়ক এত সহজে উইকেট দেওয়ার পাত্র নন। শুক্রবারের এই বিকেলে হয়তো শরীর আরও খারাপ বলে উদাসী গলায় বললেন, “বিশ্বকাপে আমার মন্তব্য, গুড লাক টু অল দ্য টিম্স।” কিন্তু নিজের কলমে চাঁছাছোলা বিশ্লেষণ করেছেন।

কোয়ার্টার ফাইনালে নিউজিল্যান্ড হারাবে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে।

অস্ট্রেলিয়া হারাবে পাকিস্তানকে।

দক্ষিণ আফ্রিকা হারাবে শ্রীলঙ্কাকে।

ভারতকে হারাবে ইংল্যান্ড।

সেমিতে দক্ষিণ আফ্রিকা ছিটকে দেবে অস্ট্রেলিয়াকে।

নিউজিল্যান্ড হারাবে ইংল্যান্ডকে।

তার পর ফাইনালে দক্ষিণ আফ্রিকা হারাবে নিউজিল্যান্ডকে।

নেটে মার্টিন ক্রোর পূর্ণাঙ্গ বিশ্লেষণটা দেখার পর বোঝা গেল কেন তিনি বারবার বলছেন, ভারতের আশা নেই। লিখেছেন, ‘চাপের মুখে ইন্ডিয়ার সন্দেহজনক বোলিং বড় টিমগুলোকে থামাতেই পারবে না।’ কিন্তু কথা বলে মনে হল না বিশ্বকাপের মধ্যে তিনটে কলামও তাঁর লেখার ক্ষমতা থাকবে বলে। নেহাত আইসিসি কর্তার কাছ থেকে তাঁর নতুন মোবাইল নম্বরটা নেওয়া। নইলে বিশ্বাসই হত না ক্রোর গলা এমন বুড়োটে, থুরথুরে হয়ে যেতে পারে। আর ইমরান? তিনি তো লিখতেই চান না। যে বিষয়টার আর কিছু জানেন না, যেটায় পুরনো হয়ে গিয়েছেন, সেটায় অনর্থক মন দিয়ে লাভ কী, এই হল তাঁর আধুনিক ক্রিকেট নীতি!

একজন ক্রিকেটের সঙ্গে সুতো কেটে দিয়েছেন। অন্য জন জীবনের সঙ্গে সুতো কেটে যাওয়ার আতঙ্কিত প্রতীক্ষায়। ওয়ান ডে ইতিহাস অবশ্য তাঁদের ইচ্ছের ওপর নির্ভর করে বসে নেই। তারা প্রাক্তন দুই নেতাকে চিরকালীন যুক্তই করে নিয়েছে নিজের সঙ্গে!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement