হরিয়ানার লাহলিতে বংশীলাল স্টেডিয়ামে সচিন তেণ্ডুলকরের শেষ রণজি ম্যাচ। বাবার ঘাড়ে চেপে ন’বছরের এক বালিকা প্রাণপণে চেঁচিয়ে যাচ্ছিল, ‘স-চি-ন! স-চি-ন!’ তখন কে আর জানত একদিন স্বপ্নের নায়কের রেখে যাওয়া ব্যাটন হাতবদল হয়ে আসবে এই বালিকার কাছেই।
২০১৩ সালের সেই বালিকা শেফালি আজ ১৫ বছরের কিশোরী। সম্প্রতি ১৫ বছর ২৮৫ দিন বয়সে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে প্রথম অর্ধশতরান করলেন। ডারেন স্যামি ন্যাশনাল স্টেডিয়ামে জীবনের পঞ্চম আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি ম্যাচে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে শেফালি করেন ৪৯ বলে ৭৩ রান।
সচিন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তাঁর প্রথম অর্ধশতরান করেছিলেন ১৬ বছর ২১৪ দিন বয়সে। ১৯৮৯ সালে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে, ফয়জলাবাদে। তিন দশক ধরে অটুট থাকা সচিনের সেই রেকর্ড ভেঙে দিলেন শেফালি। তিনি- এখন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সবথেকে কম বয়সে অর্ধশতরান করা ভারতীয়।
ডারেন স্যামি ন্যাশনাল স্টেডিয়ামে খেলতে নেমে শুরু থেকেই আগ্রাসী মেজাজে ব্যাটিং শুরু করেছিল হরিয়ানার মেয়ে শেফালি। ছ’টি চার ও চারটি ছক্কা ছিল তাঁর ইনিংসে।
স্মৃতি মন্ধানার (৬৭) সঙ্গে ওপেন করতে নেমে ১৪৩ রানের জুটি তৈরি করেও নতুন রেকর্ড গড়েছেন দু’জনে। শুরুতে ব্যাট করে নির্ধারিত ২০ ওভারে চার উইকেটে ১৮৫ রান করেছিল ভারতীয় মেয়েরা। জবাবে ওয়েস্ট ইন্ডিজের ইনিংস শেষ হয় ১০১-৯।
শেফালির জন্ম ২০০৪ সালের ২৮ জানুয়ারি, হরিয়ানার রোহতকে। চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে প্রথম সুযোগ টি-২০ দলে। প্রথম ম্যাচ দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে, দেশের মাটিতে। টি-২০ খেলা ভারতীয় মহিলা ক্রিকেটারদের মধ্যে তিনি সর্বকনিষ্ঠ।
তবে চলার পথ ছিল প্রথম থেকেই বন্ধুর। ছোট থেকেই ক্রিকেট খেলার নেশা। কিন্তু রোহতকের কোনও অ্যাকাডেমিতে মেয়েদের ক্রিকেট খেলা শেখায় না। শেষে বাধ্য হয়ে মেয়েকে অ্যাকাডেমিতে ছেলের পরিচয়ে ভর্তি করান শেফালির বাবা, সঞ্জীব বর্মা।
রোহতকে ছোট্ট একটা গয়নার দোকান আছে সঞ্জীব বর্মার। নিজেও ক্রিকেটপাগল। বিভিন্ন অ্যাকাডেমিতে গিয়ে কার্যত কোচদের পায়ে ধরতে বাকি রাখলেন। কিন্তু সবাই অনড়, মেয়েদের ক্রিকেট শেখাবেন না।
কিন্তু সঞ্জীবের ধনুকভাঙা পণ। মেয়েকে ক্রিকেট শেখাবেনই। বাবার কথায় কাঁচি পড়ল মেয়ের লম্বা চুলে। যেমন পড়েছিল বড় পর্দায়, গীতা আর ববিতার চুলে। তাদের বাবা মহাবীর সিংহ ফোগতের নির্দেশে।
এরপর আর ক্রিকেট শিখতে বাধা থাকল না। ছেলের পরিচয়েই ক্রিকেট শিখতে লাগলেন শেফালি। দাঁতে দাঁত চেপে সব যন্ত্রণা সহ্য করতেন শেফালি। কিন্তু কেউ টেরও পায়নি তার আসল পরিচয়।
কয়েক বছর পরে ছবিটা পাল্টে গেল। ছাত্রীদের জন্য ক্রিকেট দল তৈরি হল শেফালির নিজের স্কুলে। একদিন নিজের পরিচয়েই আত্মপ্রকাশ করলেন তিনি। তখন আর ক্রিকেট অ্যাকাডেমি থেকে কেউ বাদ দিতে পারেনি শেফালিকে।
ছেলেদের সঙ্গে ক্রিকেট খেলতে থাকেন শেফালি। ঘরোয়া ক্রিকেটের এক মরসুমে দুর্দান্ত পারফরম্যান্সের পরে জাতীয় দলে ডাক পেতে সময় লাগেনি সেন্ট পলস স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্রী, শেফালির।
আজ প্রতিবেশী থেকে আত্মীয়স্বজন, সবার মুখে শেফালির নাম। অথচ একদিন এরাই আক্রমণ করেছিল কদর্য ভাষায়। ছেলেদের সঙ্গে ক্রিকেট খেলা নিয়ে চরম নিন্দা ও সমালোচনা হয়েছে। সবাই বলেছে, ক্রিকেটে মেয়েদের কোনও ভবিষ্যৎ নেই।
একদিন যারা এই তিক্ত কথা বলেছিল, তারাই হতভম্ব হয়ে গেল শেফালিকে টিভির পর্দায় খেলতে দেখে। সেদিন গর্বিত সঞ্জীবের মনে হয়েছিল, তাঁর থেকে সুখী এই পৃথিবীতে আর কেউ নেই।
সঞ্জীবের আরও এক ছেলে এবং মেয়ে আছে। তাঁর ছোট মেয়েও দিদির মতো ক্রিকেটার হতে চায়। সঞ্জীবের ইচ্ছে, তাঁর দুই মেয়ের হাত ধরেই ক্রিকেট মানচিত্রে উজ্জ্বল হোক রোহতকের নাম।
রাম নারায়ণ অ্যাকাডেমিতে ন’বছর বয়স থেকে ক্রিকেট শিখছেন শেফালি। তাঁর কোচ অশ্বিনী কুমার জানিয়েছেন, অকুতোভয় মনোভাবই শেফালির তুরূপের তাস। সচিনের মতো তাঁর ছাত্রীও প্রতিভাময়ী। যেমন খুচরো রান, সেরকমই বাউন্ডারি-ওভার বাউন্ডারি মারতে দক্ষ শেফালি। সংবাদমাধ্যমে জানিয়েছেন প্রত্যয়ী ও গর্বিত কোচ। (ছবি:সোশ্যাল মিডিয়া)